robindronath-Thakur

ডেস্ক রিপোর্টঃ ঠিক ৭৫ বছর আগে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে প্রয়াত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জীবনের শেষ প্রায় এক বছর সময় তাঁর কেটেছিল রোগশয্যায়।

ওই সময়ে ঠিক কী কী ঘটেছিল কবির জীবনে, কেমন ছিল সেই সময়ে তাঁর সৃজন, তাঁর অসুখটা ঠিক কী ছিল – এগুলো যদিও কবির আত্মীয়-বন্ধুরা লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন, তবে অনেক সাধারণ মানুষই সেটা বিস্তারিতভাবে জানেন না।

কবিপ্রয়াণের ৭৫ বছরে তাঁর শেষ জীবন নিয়ে জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রতি শুরু করেছে একটি বিশেষ প্রদর্শনী। গবেষকদের জন্য নয়, সাধারণ মানুষের জন্য এই প্রদর্শণী।

জোড়াসাঁকোর মহর্ষি ভবনের দোতলায় পাথরের ঘর বলে পরিচিত রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ কক্ষ। যাঁরা জোড়াসাঁকোয় গেছেন, তাঁদের কাছে এটা পরিচিত। কিন্তু অনেকের কাছেই এই তথ্য অজানা যে, পাথরের ঘরের পুবদিকের বারান্দায় তাঁর অস্ত্রোপচারের জন্য রীতিমতো একটা অপারেশন থিয়েটার বানানো হয়েছিল।

অপারেশন থিয়েটারের মডেল

নতুন যে প্রদর্শনী শুরু হয়েছে এ বছর ২২শে শ্রাবণ থেকে, সেখানে রাখা হয়েছে ওই অপারেশন থিয়েটারের একটা মডেল। কাঁচের বাক্সে ঘেরা ওই মডেলে দেখা যাচ্ছে কীভাবে কবির অপারেশন হয়েছিল ১৯৪১ সালের জুলাইয়ের শেষে।

এখানেই প্রদর্শনীটি শেষ, আর শুরুটা হয়েছে কয়েক বছর আগের ঘটনাক্রম দিয়ে – ১৯৩৭ সালে যখন তিনি একবার কিডনির সমস্যায় ভোগেন। তার আগে পর্যন্ত যে রবীন্দ্রনাথ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন, সেটাও জানানো হয়েছে প্রদর্শনীতে।

এরপরেই দেখানো হয়েছে ১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে শুরু হওয়া একের পর এক ঘটনাক্রম।

“শান্তিনিকেতন থেকে সে বছরের ১৯শে সেপ্টেম্বর পূত্রবধূ প্রতিমা দেবীর কাছে গিয়েছিলেন দার্জিলিং পাহাড়ের কালিম্পং-এ। সেখানেই ২৬ তারিখ রাতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন কবি। দার্জিলিংয়ের সিভিল সার্জন বলেছিলেন তখনই অপারেশন না করলে কবিকে বাঁচানো যাবে না। প্রতিমা দেবী এবং মৈত্রেয়ী দেবী তখনই অপারেশন না করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন,” বলছিলেন বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগের অধ্যক্ষ ও সাহিত্যিক রামকুমার মুখোপাধ্যায়।

একটু সুস্থ হওয়ার পরে পাহাড় থেকে নামিয়ে কবিকে কলকাতায় আনা হয়। তারপরে তিনি ফিরে যান শান্তিনিকেতনে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের নানা বিষয় স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে
                                       রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের নানা বিষয় স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে

অপারেশন করানো হবে কী না, তা নিয়ে যে একটা দোলাচল ছিল, সেই তথ্যও রয়েছে প্রদর্শনীতে।

শ্যামল চক্রবর্তীর কথায়, “সেই ১৯১৬ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথের চিকিৎসা করছিলেন যে কিংবদন্তী ডাক্তার নীলরতন সরকার, তিনি কখনই কবির অপারেশন করানোর পক্ষে ছিলেন না। কবি নিজেও চাননি অস্ত্রোপচার করাতে। ডা. সরকার যখন স্ত্রী বিয়োগের পরে গিরিডিতে চলে গেছেন, সেই সময়ে আরেক বিখ্যাত চিকিৎসক বিধান চন্দ্র রায় শান্তিনিকেতনে গিয়ে অপারেশন করিয়ে নেওয়ার কথা জানিয়ে দেন।”

“রাণী চন্দের ‘গুরুদেব’ বইটিতে উল্লেখ রয়েছে যে কবিকে বলা হয়েছিল ছোট্ট একটা অপারেশন; এটা করিয়ে নিলেই তাঁর আচ্ছন্নভাবটা ঠিক হয়ে যাবে, পরের দশ বছর আবার আগের মতোই লিখতে পারবেন। নীলরতন সরকারকে একবার জানানোও হয়নি এত বড় একটা সিদ্ধান্ত।”

জোড়াসাঁকোর সেই বাড়ি, যেখানে জীবনের শেষ দিনগুলো কটিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ
                              জোড়াসাঁকোর সেই বাড়ি, যেখানে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ

“পেনিসিলিনবিহীন যুগে ওই অপারেশনের ফল যে খারাপ হওয়ারই সম্ভাবনা বেশী ছিল, সেটা একবারও বলা হয়নি কবি বা তাঁর পরিবারকে। ওইভাবে অপারেশন করানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং ভাল করে না বুঝিয়ে সম্মতি আদায় করাটা মেডিক্যাল এথিক্স বিরোধী,” বলছিলেন চিকিৎসক শ্যামল চক্রবর্তী।

রবীন্দ্র গবেষক রামকুমার মুখোপাধ্যায় বলছেন, এই অসুস্থতার মধ্যেও কবির সৃষ্টি কিন্তু বন্ধ হয়নি। “এই সময়ে তাঁর সৃষ্টিশীলতা একটা অন্য মাত্রায় পৌঁছে যাচ্ছে। মৃত্যুটাকে মানুষ কীভাবে দেখে, সেই দর্শন প্রকাশ পাচ্ছে তাঁর ‘রোগশয্যায়’, ‘আরোগ্য’ এবং ‘জন্মদিনে’ এইসব রচনার মাধ্যমে। শেষ একবছরে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা-ভাবনার আরও তথ্য পাওয়া যায় প্রতিমা দেবীর ‘নির্বান’ এবং নির্মল কুমারী মহলানবীশের ‘২২শে শ্রাবণ’-এ।”

জন্মদিন পালিত হওয়ার কিছুদিন পরেই সাধের শান্তিনিকেতন থেকে শেষবারের মতো রওনা হন রবীন্দ্রনাথ। আধশোয়া অবস্থায় তাঁকে নামিয়ে আনা হয় বাসভবন থেকে। চারপাশে তাঁর প্রিয় আশ্রমিকেরা।

বোলপুর স্টেশনে তখন অপেক্ষায় ছিল একটি বিশেষ ট্রেন, যেটির মডেলও রাখা হয়েছে জোড়াসাঁকোর মহর্ষি ভবনের দোতলার নতুন প্রদর্শনীতে।

গাইড গোপাল আদক সেটা দেখিয়ে বলছিলেন, “এই বিশেষ ট্রেনের মডেলটিকে আমরা বলি দা লাস্ট জার্নি।”

জোড়াসাঁকোর যে বাড়িতে কবি ফিরে এলেন শেষবারের মতো, সেই বাড়িরই ভেতরের দিকে একটি ঘরে প্রায় ৮০ বছর আগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। প্রদর্শিত আছে সেই আঁতুরঘরটিও।

রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ দিনগুলোর খুটিনাটিও জানা যাচ্ছে প্রদর্শনী থেকে
                                রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ দিনগুলোর খুটিনাটিও জানা যাচ্ছে প্রদর্শনী থেকে

আরও রয়েছে অসুস্থ কবির দেখাশোনার ভার কাদের ওপরে ছিল, কী ছিল পথ্য তালিকা, সেসবের বিবরণও। প্রদর্শণীর একটি প্যানেলে দেখা যাচ্ছে অপারেশনের ঠিক আগে পরের দিনলিপি।

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সব্যসাচী বসুরায়চৌধুরী বলছিলেন, “রবীন্দ্রনাথের শেষ সময়টা কীভাবে কেটেছিল, গবেষকদের কাছে তা হয়তো নতুন নয় কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে এই তথ্যের অনেকটাই প্রায় অজানা। তাঁদের জন্যই এই নতুন প্রদর্শনী।”

আসলে রবীন্দ্রনাথের রোগটা কী ছিল, তা নিয়েও এখন উঠে আসছে নানা মত। সব্যসাচী বসুরায়চৌধুরী জানাচ্ছিলেন, “আমাদের কাছে প্রস্টেট ক্যান্সার ফাউন্ডেশনের চিকিৎসকরা সম্প্রতি প্রমাণ পেশ করেছেন যে রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষ দিকে আক্রান্ত হয়েছিলেন প্রস্টেট ক্যান্সারে। এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটা সাধারণ মানুষের কাছে জানানো জরুরী ছিল। তবে এ নিয়ে বিতর্ক বা গবেষণা চলতেই পারে।”

রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর আঁতুরঘর থেকে বেশ কিছুটা দূরে রোগশয্যায় – পাথরের ঘর বলে পরিচিত ঘরটিতে, সেখানে দাঁড়িয়ে প্রদর্শনীর গাইড মি. আদক দেখাচ্ছিলেন অপারেশনের ঠিক আগে তাঁর শেষ রচনাটির প্রতিলিপি।

কয়েকজন দর্শনার্থী বলছিলেন তাঁদের কাছে রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের এই অংশটা ছিল একেবারেই অজানা।

“তাঁর আসলে কী রোগ হয়েছিল বা একেবারে শেষ সময়ে যে একটা অপারেশন হয়েছিল, সেটা জানা ছিলনা। এই প্রদর্শনী দেখে জানতে পারলাম ব্যাপারটা,” বলছিলেন এক দর্শনার্থী।

যেদিন মারা গেলেন কবি
                                                                      যেদিন মারা গেলেন কবি

আরেক জন দর্শনার্থীর কথায়, “এই বারান্দায় যে রীতিমতো একটা অপারেশন থিয়েটার বানানো হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের জন্য, সেটা এই মডেলটা দেখে জানলাম। সেই যুগেও যে জীবানুমুক্ত করে বাড়িতে অপারেশন করা হয়েছিল, এটা এখনও আমরা ভাবতে পারি না। শেষ সময়ে কারা কবির পাশে ছিলেন, সেইসব তথ্যও জানতে পারলাম এখানে।”

“অপারেশনের পরে ধীরে ধীরে তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, জ্ঞান নেই তাঁর। সকলেই যখন বুঝতে পারছে কী ঘটতে চলেছে, তখনই গিরিডি থেকে খবর দিয়ে আনানো হয় কবির সুহৃদ ও বিশিষ্ট চিকিৎসক নীলরতন সরকারকে। তিনি এসে নাড়ি দেখলেন, পরম মমতায় কপালে হাত বুলিয়ে দিলেন, তারপরে উঠে দাঁড়ালেন। হেঁটে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে ডা. সরকারের দু’চোখে ছিল জল,” বলছিলেন গবেষক শ্যামল চক্রবর্তী।

কবির অবস্থার তখন দ্রুত অবনতি ঘটছে – ৫ ও ৬ অগাস্টের দিনপঞ্জিতে লেখা আছে সেই দিনের ঘটনা পরম্পরা।

আর শেষের যে তিনটি প্যানেল আছে, সেখানে রয়েছে ৭ই অগাস্টের বর্ণনা। ১৯৪১ সালে সেটাই ছিল ২২শে শ্রাবণ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ যাত্রা, ছবিতে
                                                                    শেষ যাত্রায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

“বেলা ন’টায় দেওয়া হল অক্সিজেন। শেষবারের মতো দেখে গেলেন বিধান রায় ও ললিত বন্দ্যোপাধ্যায়। কানের কাছে অবিরাম পড়া হচ্ছিল তাঁর জীবনের বীজমন্ত্র ‘শান্তম, শিবম্, অদ্বৈত্যম’। খুলে দেওয়া হল অক্সিজেনের নল। ধীরে ধীরে কমে এল পায়ের উষ্ণতা, তারপরে একসময়ে থেমে গেল হৃদয়ের স্পন্দন। ঘড়িতে তখন বাজে ১২টা ১০ মিনিট,” প্যানেলগুলি দেখাতে দেখাতে বলছিলেন গাইড মি. আদক।

শেষমুহুর্ত উপস্থিত হওয়ার আগেই জোড়াসাঁকোতে হাজির হাজারে হাজারে মানুষ। একদিকে যখন ভেঙ্গে পড়েছেন তাঁর আত্মীয়, বন্ধু, ঘনিষ্ঠরা, তেমনই বাইরে তখন আবেগে উদ্বেল সাধারণ মানুষ। কবিকে কীভাবে শেষযাত্রার জন্য সাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল, প্রদর্শণীর একটি প্যানেলে আছে সে কথাও।

সাহিত্যিক ও বিশ্বভারতীর গ্রন্থনবিভাগের অধ্যক্ষ রামকুমার মুখোপাধ্যায় অবশ্য বলছিলেন কবি নিজে এই ভাবে নিজের শেষটা চাননি। “তাঁর ইচ্ছা ছিল কোনও জয়ধ্বনি ছাড়া সাধারণভাবে শান্তিনিকেতনে প্রকৃতির কোলেই তিনি যেন মিশে যেতে পারেন। তাঁর শেষ ইচ্ছাটা আর রাখা যায়নি।”

বি/বি/সি/এন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে