ডেস্ক রিপোর্টঃ লিফট। বহুতল ভবনে ওঠানামার সহজতম এক যন্ত্র। সুউচ্চ ভবনে দ্রুত ওঠানামায় যার বিকল্প নেই। শুধু রাজধানীতেই বহুতল ভবনগুলোতে প্রতি মাসে অন্তত দু’শ লিফট স্থাপন হচ্ছে। ফলে প্রতি বছর এ সেক্টরের ব্যবসা আরও সম্প্রসারিত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর লিফটে অনেকগুলো নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য থাকে। এর মধ্যে সেন্সর অন্যতম। সেন্সরের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে লিফটের ওঠানামা ও ধারণক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত হয়। তাই বলা যায়, সেন্সরবিহীন লিফট অনেকটাই মরণফাঁদ।প্রসঙ্গত, শুক্রবার সেন্সরবিহীন লিফটে আটকে রাজধানীর শান্তিনগরে পিতা-মাতার সামনেই শিশু আলভিরার মর্মান্তিক মৃত্যু সবাইকে ব্যথিত করেছে। এ শোক কেউ যেন ভুলতে পারছে না। মনে পড়লেই গা শিউরে ওঠে।

যারা নিয়মিত লিফট ব্যবহার করেন তাদের এখন নতুন করে লিফট সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আগ্রহী করে তুলেছে। কি কি কারণে লিফট দুর্ঘটনা হয় এবং বিশেষ করে লিফটের অকার্যকর সেন্সর বা সেন্সর ব্যবস্থা না থাকলে সাবধানতা অবলম্বনের উপায়ও জানতে চান অনেকে।বহুলত ভবনে নিন্মমানের লিফট এবং এ সংক্রান্ত দুর্ঘটনার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী শনিবার বলেন, বাংলাদেশে যেসব লিফট বহুতল ভবনগুলোতে স্থাপন করা হচ্ছে তা মানসম্পন্ন কিনা যাচাই করা এখন খুব জরুরি।

এটা বিএসটিআইকে (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউট) দিয়ে পরীক্ষা করাতে হবে। বিএসটিআই ফিটনেস সনদ দিলেই সেটি ব্যবহার করা যাবে। নইলে নয়। তাছাড়া সারা বিশ্বে লিফট তৈরির অনেক কোম্পানি গড়ে উঠেছে।ফলে মান নিশ্চিত করতে হলে সরকারকে আমদানির ক্ষেত্রেও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ১৯৯৩ সালের বিল্ডিং কোডে সুস্পষ্টভাবে বহুতল ভবনে লিফট স্থাপন সংক্রান্ত বিধিমালা দেয়া আছে। কিন্তু বিল্ডিং কোড বাস্তবায়নের দায়িত্ব যাদের তারাই সঠিকভাবে এ কাজটি করছে না।

এদিকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান শনিবার  বলেন, প্ল্যান পাসের সময় ভবনে স্থাপিত লিফটের মানের বিষয়ে কিছুই বলা হয় না। ফলে এক্ষেত্রে রাজউকের করণীয় সীমিত।তবে তিনি মনে করেন, বহুতল ভবনগুলোতে মানহীন লিফট স্থাপন নিয়ে যে অরাজকতা চলছে তার অবসানও হওয়া দরকার। এজন্য রাজউক মানসম্পন্ন লিফট স্থাপনে তালিকাভুক্ত আবাসন ব্যবসায়ীদের জোরালোভাবে তাগিদ দেবে।

নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যের ঘাটতি : প্রকৌশলীরা বলছেন, নিুমানের লিফটে সেন্সর ব্যবস্থা থাকে না। আবার রক্ষণাবেক্ষণ ঝামেলা এড়াতে অনেকে লিফটের ধারণক্ষমতা চিহ্নিতকারী স্বয়ংক্রিয় সেন্সর বন্ধ রাখেন।ফলে মাত্রাতিরিক্ত আরোহী ওঠানামা করলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে লিফট বন্ধ হয় না। তাছাড়া সেন্সর না থাকলে নির্ধারিত সময়ের আগেই লিফট চলতে শুরু করে। এতে আরোহী লিফট গহ্বরে পড়ে যেতে পারেন।

বেশির ভাগ সময় সেন্সরবিহীন লিফটের দরজাও আকস্মিক দুদিক থেকে আরোহীকে সজোরে ধাক্কা দেয় বা ভয়ঙ্করভাবে চেপে ধরে। এমনকি সেন্সর অচল থাকলে কেবিনে পুরোপুরি ঢোকার আগেই লিফট চলতে শুরু করে। এতে প্রাণহানির আশঙ্কা দেখা দেয়।বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. খন্দকার সাব্বির আহমেদ রোববার  বলেন, লিফটের স্পেসিফিকেশন আপ-টু দা মার্ক আছে কিনা জানতে হবে। কারণ স্পেসিফিকেশনের মধ্যেই বলা থাকে কতগুলো সেন্সর থাকতে হবে। সেন্সর একটা থাকলেই হয় না।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ধরেন সেন্সর একটা নির্দিস্ট হাইটে (উচ্চতায়) দেয়া আছে। একটা বাচ্চা ওই হাইটের নিচে। তখন কিন্তু ওই সেন্সর তাকে শনাক্ত করতে পারবে না।আমাদের দেশের লিফট সরবরাহকারীরা বেশি লাভের জন্য সেন্সরের সংখ্যা কমিয়ে দেন, আবাসন কোম্পানিগুলোও খরচ কমাতে লিফটে সেন্সর সংখ্যা কমিয়ে বা সেন্সরবিহীন লিফট লাগায়, এতেই ঘটে যেতে পারে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা।’

তিনি বলেন, তবে সেন্সর ঠিকমতো থাকলে লিফটে আটকে কখনও মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে না। তিনি জানান, এছাড়া অনেক সময় সেন্সর বিকল হয়ে যেতে পারে। সেজন্য প্রতিটি লিফটে দুর্ঘটনা প্রতিরোধী রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থাও রাখতে হয়। অর্থাৎ নষ্ট হওয়ার আগেই নির্দিষ্ট সময় অন্তর রক্ষণাবেক্ষণ করা। কারা কখন লিফট রক্ষণাবেক্ষণ কাজ করেছেন তাদের স্বাক্ষরযুক্ত একটি তালিকাও লিফটের ভেতরে টাঙিয়ে রাখার নিয়ম রয়েছে।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লিফটের সেন্সর এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে ধারণক্ষমতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। নির্ধারিত ওজন ধারণক্ষমতার বেশি হলেই অটোমেটিক সংকেত বেজে ওঠে এবং লিফটের চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

তাছাড়া উন্নতমানের লিফটে সেন্সর ছাড়া আরও অন্তত ২৪টি নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য থাকে। এগুলোকে ইএন-৮১ সেফটি স্ট্যান্ডার্ড কোড বলা হয়। মধ্যে স্পিড গভর্নর ও কন্ট্রোলার স্টপ সুইচসহ অন্তত ৫টি বৈশিষ্ট্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর যে কোনো একটি না থাকলে বা সাময়িকভাবে বন্ধ করা হলে লিফট ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ।প্রোপার্টি লিফটের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা রাশেদুর রহমান  বলেন, লিফটে স্পিড গভর্নর বলে একটি ব্যবস্থা থাকে। যার মাধ্যমে দরজার দুটি অংশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়।

নির্দিষ্টসংখ্যক আরোহী ওঠার পর দরজার দুটো অংশ (মেল ও ফিমেল) মিলিত হয়। এরপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় সংকেত গেলে লিফট চলতে শুরু করে। কিন্তু কোনো কারণে এ ব্যবস্থাটি বন্ধ থাকলে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অকার্যকর থাকায় অনেক সময় দরজার দুটো অংশ ঠিকমতো মিলে যাওয়ার আগেই লিফটের কেবিন চলতে শুরু করে। ফলে কেবিনে ওঠার আগেই আরোহী লিফট গহ্বরে পড়ে গেলে মৃত্যু নিশ্চিত।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সর্বোপরি লিফটের রক্ষণাবেক্ষণ একটা বড় বিষয়। ব্যবহারকারীকেও লিফট ব্যবহার সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা রাখতে হয়।প্রকৌশলীরা বলছেন, লিফটে সাধারণত দু-তিনটি কমন অসুবিধা হয়ে থাকে। যেমন লিফটের দরজা ঠিকমতো না লাগা, ওঠানামার সময় কাঁপতে থাকা বা ঘড়ঘড় শব্দ হওয়া ইত্যাদি। স্থাপনের পর নিরবচ্ছিন্ন রক্ষণাবেক্ষণ প্রক্রিয়া চালু থাকলে লিফটে এ ধরনের সমস্যা হয় না।

কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ও খরচ এড়িয়ে যাওয়ার জন্য অনেক অসৎ ব্যবসায়ী ভয়ঙ্কর পথ বেছে নেন। তারা লিফটের কয়েকটি নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য বন্ধ করে দেন। এ ধরনের লিফটে ওঠা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।বিল্ডিং কোডে যা আছে : বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ১৯৯৩-এর ৮ নম্বর অধ্যায়ের ৫ নম্বর অনুচ্ছেদে লিফট স্থাপন ও পরিচালনার সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এতে লিফট স্থাপন, রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার বিস্তারিত উল্লেখ করা আছে।

বিল্ডিং কোড লংঘন করলে সাত বছরের কারাদণ্ডের বিধানও রয়েছে। হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক আবু সাদেক শনিবার যুগান্তরকে বলেন, সামগ্রিকভাবে বিল্ডিং কোড মানার জন্য কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। রাজউক ও বিদ্যুৎ বিভাগ উদ্যোগ নিলে লিফট দুর্ঘটনা অনেকটাই প্রতিরোধ করা সম্ভব।দুর্ঘটনায় যা করতে হবে : লিফটে থাকা অবস্থায় কোনো দুর্ঘটনায় পড়লে মাথায় হাত দিয়ে দ্রুত শুয়ে পড়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এতে ক্ষতির পরিমাণ কম হবে। কারণ লিফট নিচে পড়া শুরু করলে মধ্যাকর্ষণজনিত কারণে প্রতি মুহূর্তেই ভরবেগ বাড়তে থাকে। ফলে লিফটের কেবিনটি মাটিতে আছড়ে পড়ার সময় শরীরের ওজন প্রকৃত ওজনের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হয়ে যায়।

এই অতিরিক্ত ওজনের ফলে দুর্ঘটনার সময় সজোরে ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এতে পা ও ঘাড় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে লিফটে ওঠার সময় দরজায় কাপড় আটকেও বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কারণ লিফটের সেন্সরে কাপড় চিহ্নিত হয় না। তাই লিফটে ওঠার সময় সতর্ক থাকতে হবে।সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পৃথিবীর উচ্চতম অট্টালিকা বুর্জ খলিফার (৮১৮ মিটার) কোনো কোনো লিফটের গতিবেগ ঘণ্টায় ৪০ মাইল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৮১ মিটার উঁচু গগনচুম্বী অট্টালিকা এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ে এলিভেটর বা লিফট রয়েছে ৭৩টি।

এসব লিফটে কখনও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ লিফট ব্যবহার করছে। কারণ এর প্রযুক্তিগত সব দিক সার্বক্ষণিক মনিটরিং নিশ্চিতভাবে করা হয়। ফলে উন্নত বিশ্বে লিফট ব্যবহার কোনো আতঙ্কের বিষয় নয়, বরং স্বাচ্ছন্দ্যের।

 

 

 

 

 

 

 

J/N.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে