স্মৃতিতে ১৬ই ডিসেম্বর
………… মাহফুজার রহমান মণ্ডল

 

ডিসেম্বর মাস আসলেই শান্তির বাতাস বহে। যে দিকে যাই চারিদেকে দাঙ্গা হাঙ্গামার বালাই নেই। মনে হয় গুন গুন করে গান গাচ্ছে উড়ে বেড়া পাখিগুলো, দুঃখের কোন ছোয়া নেই, আনন্দে নেচে উঠেছে সবার মন। কে যে কি নিয়ে ব্যস্ত তা বুঝা বড় মুসকিল। কেউবা আগে থেকে স্মৃতি স্তম্ভ মাল্য প্রদানের জন্য পুস্পের বায়না দিয়ে রেখেছে। কেউবা সারা বছর পুস্পের বাগান করেছে এই দিনে স্বপুষ্প ছিড়ে মালা গাঁথবে বলে। যাই হোক যে যেই করুক না কেন সেই সাত বছর বয়সে কি আর এত বুঝা যায়। তাই বড়দের কাজকর্ম দেখা আর হেঁসে খেলে বেড়ান ছাড়া আর উপায় কি?

সেই সাত বছর বয়সী ছোট্ট বাবু এবার ফুল কুড়ায়, একদিকে চার পাঁচটা ফুল হলে তার পকেট ভর্তি হয়ে যায়। কিন্তু কি করবে সামনে তো আরো অনেক ফুল, ফুলগুলোত নিতে হবে। এ দিকে সে একটি করে ফুল পকেটে রাখে আর উপচে পরা ফুলগুলো পকেট থেকে কোথায় পড়ে যায় সে নিজেও জানে না। তাই সে মনের আনন্দে ফুল শুধু কুড়ায় আর কুড়ায়, এছাড়াই বা তার উপায় কি?

মাঝে মাঝে মানুষের ভীড়ে বাবাকে হারিয়ে ফেলি কিন্তু বাবা কি আর আমায় হারায়। শত ব্যস্ততার মাঝে আমার হাতটি আঁকরে ধরে আর বলে বাবু বেশি দূরে যেওনা। এদিকে ব্যানার হাতে আর খণ্ড খন্ড দলে বিভক্ত অনেক স্কুল, কলেজ, সংগঠন, এনজিও, আর বেশি প্রাধান্য পায় রাজনৈতিক দলগুলো। দাবী-দফার শেষে নেই সেই রাজনৈতিক দলগুলোর। তখন কি আর চিনতাম; তাদেরই দিকে শুধু বেশী করে তাকাতাম যারা সুসজ্জিত ফুলের তোরা নিয়ে এগিয়ে আসতেন।

হঠাৎ এক ধাক্কা, আমি একদিকে আর বাবা অন্যদিকে, এবার বাবা বাবা বলে চিৎকার, কার ডাক কে শুনে কাঁদতে লাগলাম কিন্তু কোন লাভ হলো না, আসেপাশের সবাই তাকায় আর বলে কি হয়েছে। ইতিমধ্যে তারা জেনে গেছে আমার বাবাকে হারিয়ে ফেলেছি, পার্শ্বে দাদুর বয়সে এক বৃদ্ধের কাঁধে ঠাঁই পেলাম ওনাকে অনেকেই চিনে, কেউ কেউ বলে তোমার বাবা এখানেই আসবে অন্য কোথাও যেও না আবার কেউ বলে কাকুর কাঁধ থেকে কোথাও যাস না। পাশে দাঁড়ানো এক কাকী মায়ের মত উনি বলেন- তোমার খিদা পেয়েছে মনে হয় কিছু কিনে দিব।বললাম না, আমার বাবাকে চাই। সেই বৃদ্ধসহ বসে রইলাম। ইতিমধ্যে আমার পকেট থেকে কয়েকটা ফুল কোথায় যে পরে গেছে তার কোন হদিস নেই তাই কাঁদলাম, বৃদ্ধ বলে কাঁদছিস যে, দেখো না কত কষ্ট করে ফুলগুলো নিয়েছিলাম মাত্র কয়েকটা আমার কাছে বাকীগুলো কোথায়? বলা মাত্র বৃদ্ধ বলল দাদু তোমার কত ফুল চাই, একটু অপেক্ষা কর অনেক ফুল এনে দিব। সেই যে ভোর ৫ টায় এসেছিলাম, আর ভোর হওয়ার সাথে সাথে লোকের সমাগম, যেন আর শেষ হতে চায় না। সাইজে ছোট ছিলাম তাই উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা আমার অব্যাহত থাকে মাঝে মাঝে বৃদ্ধকে বলি দাদু চল না বাবার কাছে যাব। এভাবে দুপুর হয়ে যায়, দাদু চকলেট কিনে দেয়। কিন্তু মজার বিষয় বৃদ্ধ আমাকে আঁকড়ে ধরেছিল যেখানে সে আমাকে পেয়েছিল ঠিক সেই জায়গায়। তাই বাবাকে খুঁজে পেতে কষ্ট হয়নি। বাবা আমাকে খুঁজতে খুঁজতে পাগল প্রায়। আমাকে পাওয়া মাত্রই কষে এক থাপর আর বলতে লাগলো তোমাকে না বলেছিলাম আমার হাত ধরে থাকতে। সঙ্গে সঙ্গে কান্না শুরু হল আমার। বৃদ্ধ বলল যা হবার হইছে ছেলে পাইছো এবার বাড়ি ফিরে যাও। অবশেষে তাই হলো দু’জনেই বাড়ীর দিকে রওনা হলাম।

এখন আমি ভার্সিটির ছাত্র। সেই সাত বছর বয়সের কথাগুলো মনে পরে। তখন মনটা এমনেই ছিল যে হাঁসি বা কান্নার কোন অনুষ্ঠান অনুধাবন করার ক্ষমতা ছিল না। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বার ছিল এক বিজয়ের দিন, এইদিনটাকে তখন বুঝতে পারিনি। আজ যখন বুঝতে পারলাম তখন সেই ছোটবেলার ফুলগুলো আর পকেটে রাখার ইচ্ছা করে না। মনে হয় ফুল কুড়িয়ে পকেট নয় সাথে আরো হাজারো ফুল নিয়ে স্মৃতিস্তম্ভে অর্পণ করি। প্রতিজ্ঞা বদ্ধ যে প্রতি বছরে ফুলের নতুন নতুন বাগান করার প্রত্যয়ে ছোট বড় সবাইকে অনুপ্রাণিত করা। পুষ্পাপর্ণে পরিবারবর্গকে সাথে নেওয়া যেন অন্যরা বুঝতে পারে দিনটি হঠাৎ একদিন ময়ূরপঙ্খীতে ভর করে আসেনি, দিনটির সাথে জরিয়ে আছে হাজার মায়ের আজাহারি আর ধর্ষিতা নারীর কাহিনী, মিশে আছে শত শত ভাইয়ের রক্তের দাগ যা সহজে মুছে যাবে না বা কেউ মুছে দিতে পারবে না।

বীরের খাতায় যাদের নাম খোদিত হয়েছে শত চেষ্টায় বা শত ঘূর্ণিঝড় ও টর্নেডোতে মুছে যাওয়ার চিন্তা যেমন নেই তেমনি নতুন নাম খোদিত কোন প্রয়াস নেই যদি না দেশ শত্রু মুক্ত থাকে। ছেলে বেলায় বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীরের নাম শুনলে বড় ভাই জাহাঙ্গীরকে দেখতাম কিংবা বীরশ্রেষ্ঠ মতিউরের নাম শুনলে চাচা মতিউরকে দেখতাম এভাবে সাত বীরশ্রেষ্ঠের নামে মহল্লার লোকদের চিনতাম বয়স বাড়ার সাথে সাথে আজ বীরশ্রেষ্ঠের তালিকায় ওরা নেই আছে প্রকৃত বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল(সিপাহী), মুন্সি আব্দুর রউফ(ন্যান্স নায়েক), মতিউর রহমান(ফ্লাইট ল্যাফটেন্যান্ট), নুর মুহাম্মদ শেখ(সিপাহী), হামিদুর রহমান(সিপাহী), রুহুল আমিন(স্কোয়াডন ইঞ্জিনিয়ার), এবং মহিউদ্দিন জাহাঙ্গির(ক্যাপ্টেন)। এবার সেই রাজনৈতিক দল, সংগঠন, এনজিও ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিনতে পেরেছি তাই বাবার সাথে নয় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় বা সংগঠনের পক্ষে থেকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানাতে দল বেঁধে পুষ্পাপর্ণ করতে যাই। এই দিন দলমত নির্বিশেষে সকলেই এমনকি বিদেশীরাও আমাদের সাথে সামীল হয় পুষ্পাপর্ণ করতে। আমাদের এ এক চরম পাওয়া “স্বাধীনতা দিবস” যা দেশের দামাল ছেলেরা ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে