ডেস্ক রিপোর্ট: সরকার-নির্ধারিত সময়ে অর্থাৎ ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতু চালু করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এখন পর্যন্ত সেতুর একটি ইস্পাতের কাঠামো (স্প্যান) উঠেছে। আগামী ১২ মাসের মধ্যে আরও ৪০টি স্প্যান পিলারের ওপর বসাতে হবে। অর্থাৎ এখন থেকে প্রতি মাসে অন্তত তিনটির বেশি করে স্প্যান বসাতে হবে।

একই গতিতে চালাতে হবে নদী শাসনের কাজও। প্রকল্প কর্মকর্তারা বলছেন, তিন ভাগের এক ভাগ গুরুত্বপূর্ণ পাইল বসানোর বিষয়ে এখনো কারিগরি জটিলতা রয়ে গেছে। ফলে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা বেশ কঠিন হবে।

দুর্নীতির ষড়যন্ত্রসংক্রান্ত জটিলতার পর সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। শুরুতে যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়, তাতে চার বছরে অর্থাৎ ২০১৮ সালের মধ্যে সেতুটি যানবাহনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়।

সেতু কর্তৃপক্ষের মাসিক অগ্রগতিসংক্রান্ত প্রতিবেদন বলছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৪৯ শতাংশ। এর মধ্যে মূল সেতুর অগ্রগতি ৫২ শতাংশ। আর নদী শাসনের কাজের অগ্রগতি ৩৪ দশমিক ২০ শতাংশ। অবকাঠামো উন্নয়ন, দুই পাড়ে সংযোগ সড়ক ও টোল প্লাজা নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে একই ধরনের কথা বলা হয়েছে। গত ২০ নভেম্বর সেতু বিভাগে পাঠানো প্রতিবেদনে বলা আছে, পদ্মা সেতু নির্মাণের নির্ধারিত সময় শেষ হতে বাকি আর মাত্র ১৪ মাস। কিন্তু এই পর্যন্ত নির্মাণকাজে অগ্রগতি মাত্র ৪৮ শতাংশ। ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকার মধ্যে গত অক্টোবর পর্যন্ত খরচ হয়েছে মাত্র ১৪ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে আট মাস পিছিয়ে আছে নির্মাণকাজ।

 এ অবস্থায় পদ্মা সেতুর ব্যয় আবার এক দফা বাড়ছে। পদ্মা বহুমুখী সেতু বাস্তবায়নে ২০০৭ সালে একনেকে ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকার প্রকল্প অনুমোদিত হয়। এরপর দুই দফা ব্যয় সংশোধন করা হয়। যেমন, ২০১১ সালে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকা

এবং ২০১৬ সালে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। আর এখন জমি অধিগ্রহণের জন্য বাড়তি যুক্ত হচ্ছে আরও ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ফলে মোট ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে মূল প্রকল্প প্রস্তাব থেকে ব্যয় বেড়েছে ২০ হাজার ৩১ কোটি ২৫ লাখ টাকা।

সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত আইনে বিশেষ কোনো অবস্থার সৃষ্টি না হলে দুবারের বেশি প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করা যায় না। কিন্তু পরিকল্পনা কমিশন পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য এই আইন শিথিল করার বিষয়ে একমত হয়েছে।

সময়মতো চালুর বিষয়ে জানতে চাইলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সেতু চালুর সম্ভাবনা কম। আরও কয়েক মাস বেশি লাগবে। তবে কত সময় বেশি লাগবে, তা পাইলিংসংক্রান্ত ঝামেলা মিটে গেলে বোঝা যাবে।

নতুন জটিলতা

পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তে এখন দুটি পিলার তোলার কাজ চলছে। এগুলোতে দুটি স্টিলের অবকাঠামো (স্প্যান) বসানো যাবে। চলতি ডিসেম্বরের মধ্যে অন্তত একটি, সম্ভব হলে দুটি স্প্যান বসানোর পরিকল্পনা ছিল। তবে ঘন কুয়াশার কারণে কাজ আশানুরূপ এগোয়নি বলে তা সম্ভব হচ্ছে না। এখন জানুয়ারিতে দুটি স্প্যান বসানোর পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা।

তবে মাঝনদী ও মাওয়া প্রান্তে ১৪টি পিলার নির্মাণ নিয়ে অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি। এই ১৪টি পিলারের নিচে ৮৪টি পাইল বসানো নিয়ে জটিলতার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না।

সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পের পিলারের নিচে ৯৮ থেকে ১২৮ মিটার পর্যন্ত গভীর পাইল বসানো হচ্ছে। বিশ্বে এত গভীরে পাইল বসিয়ে সেতু নির্মাণের নজির নেই বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ১৪টি পিলারের নিচে যে গভীরতায় পাইল বসানোর কথা, এর ৩ থেকে ৭ মিটার ওপরে কাদামাটি পাওয়া গেছে।

সাধারণত কাদামাটির স্তরের ওপরে থাকা শক্ত মাটিতে পাইলের শেষাংশ থাকা বাঞ্ছনীয়। এ জন্যই এই ৮৪টি পাইল আরও গভীরে বসানো হবে, নাকি গভীরতা কমিয়ে সংখ্যা বাড়িয়ে দেওয়া হবে—এটা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় আছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। মাটি থেকে পানি পর্যন্ত একটা নির্দিষ্ট উচ্চতায় পিলারের চারপাশে বেড়া দিয়েও এর সমাধান হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য কাউই ইউকে লিমিটেড নামে একটি ব্রিটিশ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এখনো তাদের সিদ্ধান্ত দেয়নি। আগামী মাসের মধ্যে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত না পাওয়া গেলে কাজ অনেক পিছিয়ে যাবে। কারণ পদ্মার এই অংশে মাঝনদী ও মাওয়া অংশ খুবই গভীর ও খরস্রোতা। বর্ষাকালের বৈরী আবহাওয়ায় এই অংশে কাজ করা সম্ভব নয়। নভেম্বর থেকে এপ্রিল—এই সময়টাতেই এই অংশের কাজ করতে হবে।

ওই কর্মকর্তারা আরও বলছেন, সেতুর কাজ দ্রুত করার বিষয়ে রাজনৈতিক চাপ আছে। কিন্তু এত বড় ও জটিল একটি স্থাপনায় জোর করে কোনো কাজ করা ঠিক হবে না। কারণ এর স্থায়িত্ব হবে ১০০ বছর। তাড়াহুড়ো করে কোনো ভুল হলে এর দায় কে বহন করবে? নিশ্চয়ই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানসহ কেউ বড় ঝুঁকি নিতে চাইবে না।

এ বিষয়ে জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, কিছু পাইল নিয়ে যে কারিগরি সমস্যা দেখা দিয়েছে, তা সমাধানে বেশ কয়েকটি বিকল্প প্রস্তাব এসেছে। পাইলের সংখ্যা বাড়ানো লাগতে পারে। নতুবা গভীরতায় পরিবর্তন আনতে হবে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই এ বিষয়ে একটা সিদ্ধান্তে আসা যাবে।

ব্যয় ও সময়

সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, সর্বশেষ ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ছে নদী শাসনের জন্য তোলা বালু ফেলার জায়গা কেনায়। প্রথমে নদীর ডুবোচরে এসব বালু ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছিল এবং এসব জমি খাস হিসেবে বিবেচনা করেছিল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বালু ফেলতে গেলে স্থানীয় লোকজন স্থাপনা নির্মাণ করে ও চাষাবাদ শুরু করে দিয়ে মালিকানা দাবি করেন। তখন সরকার প্রায় দেড় হাজার হেক্টর জমি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। এই কাজে আরও জমির প্রয়োজন হতে পারে বলে সূত্র জানিয়েছে।

প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে রডের মূল্য কম। অর্থাৎ পণ্যের মূল্যের কারণে এখনো খেসারত দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তবে মাঝনদী ও মাওয়া প্রান্তে পাইলিং নিয়ে যে ঝামেলা তৈরি হয়েছে, এর জন্যও পুনরায় ব্যয় বাড়তে পারে। আরও জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হলে সে ক্ষেত্রেও ব্যয় বাড়বে। অর্থাৎ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার আগে এর ব্যয় কত দাঁড়াবে, তা নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না।

আর্থিক মূল্যায়ন

বড় প্রকল্পের আর্থিক বিশ্লেষণ করে বেসরকারি খাতের কীস্টোন বিজনেস সাপোর্ট কোম্পানি।তারা পদ্মা সেতুর আর্থিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির করা মূল্যায়ন অনুযায়ী, প্রকল্পটি নেওয়ার সময় বলা হয়েছিল যে চালুর পর প্রথম ছয় বছর ২২ শতাংশের বেশি যান চলাচল বাড়বে। এরপর প্রতিবছর আরও ৩ শতাংশ হারে বাড়বে, যা অনেকটা অস্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধু সেতুতে এই হারে যানবাহন বাড়েনি। যদিও উত্তরের পথে সেটি একমাত্র পথ। আর পদ্মা সেতুর বেলায় বিকল্প আরও পথ আছে।

কীস্টোন বিজনেস সাপোর্ট কোম্পানির মূল্যায়ন অনুযায়ী, তারপরেও পদ্মা সেতু প্রকল্পটি যেসব বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে নেওয়া হয়েছিল, তাতে এটি ছিল খুবই লাভজনক। কিন্তু ব্যয় বৃদ্ধি ও বাস্তবায়নের সময় বেড়ে যাওয়ায় প্রকল্পের লাভজনকতা কমে গেছে। কমে গেছে প্রকল্পটির নিট বর্তমান মূল্য (এনভিপি) ও অভ্যন্তরীণ প্রত্যাবর্তনের হার (ইন্টারনাল রেট অব রিটার্ন)।

চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ

সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পে এখন প্রায় চার হাজার লোক কাজ করছেন। তবে কর্মীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ে-কমে। শুকনা মৌসুমে বেশি লোক কাজ করেন। আবার বর্ষায় কিছুটা কমে যায়। কর্মরত মানুষের মধ্যে এক হাজারের বেশি বিদেশি, যাঁদের বেশির ভাগই চীনের। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, জাপানসহ আরও অনেক দেশের নাগরিকও আছেন। তাঁদের বেশির ভাগ পরামর্শক।

পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকায় শতাধিক ক্রেন মজুত আছে। এর মধ্যে বড় একটি ক্রেনের ভার বহনের ক্ষমতা ৪ হাজার টন। এটি দিয়েই প্রায় ৩ হাজার ২০০ টন ওজনের স্টিলের কাঠামো তুলে খুঁটিতে বসানো হবে। আর ২ হাজার ৪০০ ও ১ হাজার ৯০০ কিলোজুল ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি হাইড্রোলিক হাতুড়ি দিয়ে পাইল বসানোর কাজ চলছে। সম্প্রতি সাড়ে ৩ হাজার কিলোজুল ক্ষমতাসম্পন্ন আরেকটি হাতুড়ি এসেছে। এর বাইরে নদী শাসনে সক্রিয় আছে বেশ কিছু ড্রেজার।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম  বলেন, পদ্মা সেতুতে যে গভীরতায় পাইল বসানো হচ্ছে, তা বিশ্বে রেকর্ড। নদী শাসনের কাজটাও বেশ জটিল। ফলে কারিগরি নানা চ্যালেঞ্জ আসছে। বিশেষজ্ঞ কমিটি, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা একটি সুন্দর সেতু উপহার দেওয়ার জন্য কাজ করছেন।

নির্ধারিত সময়ে সেতু চালু হবে কি না—জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ৮৪টি পাইলের বিষয়ে নতুন করে নকশা করতে হচ্ছে। এই নকশা এবং সেই অনুযায়ী পাইল বসানোর ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। তবে সময়মতো সেতু চালু করার লক্ষ্য নিয়েই তাঁরা কাজ করছেন।

একনজরে

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতু চালুর ঘোষণা

* কাজ হয়েছে ৪৯ শতাংশ

* ২০০৭ সালে ১০,১৬১কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন

* ব্যয় বেড়ে এখন ৩০,১৯৩ কোটি টাকা

 

 

 

 

Pr/A/N.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে