কাওছার হামিদ, কিশোরগঞ্জ, নীলফামারী: এখানে প্রায় প্রতিটি বাড়িই যেন ছোট ছোট পোশাক কারখানার রূপ নিয়েছে; সৈয়দপুরের জ্যাকেট, ট্রাউজার, টি-শার্ট রপ্তানি হচ্ছে ভারত-ভুটান-নেপালে।

বছর দশেক আগের ঘটনা। রাস্তা পার হচ্ছিলেন মো. ঝণ্টু মিয়া। এসময় হঠাৎ আসা দ্রুতগামী ট্রাকের ধাক্কায় হারান এক পা। এই দুর্ঘটনার আগে তিনি ট্রাকের গ্যারেজে কাজ করতেন। পা হারিয়ে বেকার হন। পরে দক্ষ হন নতুন কর্মে। এখন কাজ করছেন ঝুট কাপড় থেকে তৈরি করা পোশাক কারখানায়। এখানে জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে অনেকটা নিরাপত্তা পেয়েছেন। সংসার চলছে কারখানায় কাজের আয় দিয়েই।

শুধু ঝণ্টু নয়, একসময়ের পিছিয়ে পড়া নীলফামারি জেলার সৈয়দপুর উপজেলায় অন্তত ৫০০ পরিবার ঝুট কাপড়ের কারখানাকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এখানে প্রায় প্রতিটি বাড়িই যেন ছোট ছোট পোশাক কারখানার রূপ নিয়েছে। একেকটি বাড়িতে ৩ থেকে ৪৫টি মেশিনে সারা বছর চলে কাজ। তাদের উৎপাদিত পণ্য যাচ্ছে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববাজারে। সৈয়দপুরে ঝুট কাপড় থেকে তৈরি পোশাককে কেন্দ্র করে রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস মালিক সমিতি গড়ে তোলা হয়েছে। এখানেও প্রায় ২৫০ জন ব্যবসায়ী বা কারখানার মালিক রয়েছেন।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, সৈয়দপুরে ঝুট কাপড়ের ব্যবসা পাকিস্তান আমল থেকে। তবে কে প্রথম শুরু করেছিলেন তা নির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারেন না। শুরু থেকেই ঝুট কাপড় থেকে তৈরি হচ্ছে নানামুখী পোশাক। এর পরিধি বেড়ে যায় ২০০২ সালে। মূলত চাহিদার প্রেক্ষাপটে এই সময়ে গড়ে ওঠে রপ্তানিমুখী ক্ষুদ্র গার্মেন্টস মালিক গ্রুপ। মূলত পোশাক প্রস্তুতকারকদের সংগঠন এটি।

ব্যবসায়ীরা ঢাকার মিরপুর, কালীগঞ্জ, সাভার, গাজীপুর, টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম সহ বিভিন্ন স্থানের পোশাক কারখানাগুলো থেকে ঝুট কাপড় কিনে আনেন। পাশাপাশি সুতা, বোতাম, ইলাস্টিক, প্যান্টের পকেট বানানোর স্টিকার, পুরোনো সেলাই মেশিনও সংগ্রহ করেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। ঝুট কাপড় থেকে কারখানাগুলোতে তৈরি হচ্ছে ট্রাউজার, শর্টস (হাফ প্যান্ট), জ্যাকেট, টি-শার্ট, জিনস প্যান্টসহ নানা ধরনের পোশাক। দেশের চেয়ে এই পোশাকগুলোর চাহিদা ভারত, নেপাল ও ভুটানে বেশি বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

ঝুট কাপড় ও উপকরণসমূহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কেনা হয় কেজি হিসেবে। এর মধ্যে প্রতি কেজি ব্লেজারের ঝুট ৭৫ থেকে ১৬০ টাকা। জ্যাকেট তৈরির ঝুট ১২০ থেকে ১৮০, গ্যাবার্ডিন প্যান্টের ঝুট ৯০ থেকে ১৭০, জিনসের ঝুট ৯০ থেকে ২০০, জিপার ৮০ থেকে ১৫০, সুতা ২০০ থেকে ২৫০ টাকা দরে কিনতে হয় বলে ব্যবসায়ীরা জানান। এসব থেকে তৈরি করা পণ্য ২০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে বিক্রি করা হয়।

ঝুট কাপড় থেকে পোশাক ব্যবহার উপযোগী করার জন্য সৈয়দপুরে হাজারো শ্রমিক কাজ করছেন। এই কারিগরদের একজন হলেন ‍উপজেলার সোনামুখী এলাকার বাসিন্দা ঝণ্টু। এইচআর গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করা শারীরিক প্রতিবন্ধী ঝণ্টু জানান, ‘ট্রাকের গ্যারেজের চেয়ে পোশাক কারখানায় কাজ সহজ। এখানে দৌড়াদৌড়ি করতে হয় না। তবে কর্মঘণ্টা বেশি। কিন্তু এই কাজের জন্য ওভারটাইম পাওয়া যায়। সব মিলে মাসে ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা আয় হয়।’

সৈয়দপুরের বিভিন্ন কারখানায় প্রায় ৩২ বছর ধরে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন মো. সেলিম হোসেন। জানান, “ঝুট কাপড় থেকে অনেক রকমের পোশাক তৈরি হয় এখানে। আগে কাজের চাহিদা ব্যাপক ছিল। কিন্তু করোনার পর থেকে কিছুটা কমেছে। এ কারণে আমাদের মজুরিও কমেছে। তারপরও সৈয়দপুরে আশেপাশের জেলা থেকে শত শত শ্রমিক পোশাক কারখানায় কাজ করছেন। বাড়ির নারীরাও কাজ করতে পারেন।”

সৈয়দপুর থেকে যেকয়টি প্রতিষ্ঠান দেশের বাইরে পোশাক রপ্তানি করে তার মধ্যে অন্যতম হলো ইনভেন্ট ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক হুমায়ন কবির প্রায় ৩০ বছর ধরে ব্যবসা করছেন। তিনি বলেন, “আমরা সাধারণত ঝুট কাপড়ের তৈরি ট্রাউজার, জ্যাকেট, শর্টস রপ্তানি করি। পাবনায়ও আমাদের ঝুট কাপড়ের কারখানা আছে। সেখান থেকে যায় শুধুমাত্র টিশার্ট। সব মিলে বছরে অন্তত ৫ কোটি টাকার পোশাক রপ্তানি করা হয় ভারত, নেপাল ও ভুটানে।”

এইচআর গার্মেন্টস কারখানার ম্যানেজার মো. সুজন আলী দাবি করেন, ঝুট কাপড়ের তৈরি পোশাকের রপ্তানি তাদের হাত ধরেই শুরু হয়। এরপর এই অঞ্চলের ৫ থেকে ৬ জন ব্যবসায়ী রপ্তানি করে আসছেন। তবে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ভারত আমাদের তৈরি জ্যাকেট, ট্রাউজার, শর্টস কিনে নিয়ে গিয়ে দুবাই-কাতারে রপ্তানি করে।

সৈয়দপুরে ঝুট কাপড়ের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক হিসেবে পরিচিত মো. মতিয়ার রহমান দুলাল। তিনি জানান, এখানে ৫০০ কারখানায় ৮ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। সৈয়দপুর থেকে পোশাক রপ্তানি শুরু হয় ২০২১ সালের দিকে। তার প্রতিষ্ঠান এমআর ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে বছরে অন্তত ৫ লাখ ডলার কাপড় ও টুপি রপ্তানি করা হয়। এর মধ্যে তার টুপির ফ্যাক্টরি ঢাকায়। আর ঝুট থেকে তৈরি হাফ প্যান্ট, ট্রাউজার সৈয়দপুরের বিভিন্ন কারখানা থেকে সংগ্রহ করা হয়। এরপর তারা রপ্তানি করেন।

প্রায় ২০ বছর ধরে ঝুট কাপড়ের পোশাক রপ্তানিকারক আরএস ইন্টারন্যাশনালের ফাইয়াজুল হক সাজু বলেন, “আমরা আসলে ফেলনা কাপড় সম্পদে পরিণত করতেছি। এখানে অনেক মানুষের জীবন-জীবিকা চলছে। আমার প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি বছর গড়ে ১০ কোটি টাকার টাই, টিশার্ট সহ অন্যান্য পোশাক তৈরি হয়। এর মধ্যে অধিকাংশই ভারত, নেপাল, ভুটানে যায়। দামে কম ও মানে ভালো হওয়ার কারণে বিদেশে আমাদের তৈরি পোশাকের চাহিদা বেশি। তবে এর মধ্যে ঝুট কাপড়ের যোগান কমেছে কিছুটা। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের ভাবতে হবে।”

তবে মোট কী পরিমাণ পোশাক সৈয়দপুর থেকে রপ্তানি করা হয় তার কোনা পরিসংখ্যান নেই রপ্তানিমুখী ক্ষুদ্র গার্মেন্টস মালিক গ্রুপের কাছ।

রপ্তানিমুখী ক্ষুদ্র গার্মেন্টস মালিক গ্রুপের সভাপতি আকতার হোসেন খান বলেন, “ঝুট কাপড়কে কেন্দ্র করে সৈয়দপুরে দারুণ এক কর্মযজ্ঞ চলে। বলতে গেলে সৈয়দপুরে ঘরে ঘরে পোশাক কারখানা। এখানে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। তবে বর্তমানে ঝুটের দাম বেড়েছে কিন্তু সেই তুলনায় পোশাকের দাম বাড়েনি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে