2016-10-15_2_722088

ডেস্ক রিপোর্টঃ নারী সমাজের অশিক্ষার অন্ধকার ঘুচিয়ে শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের জন্য সরকার অনেক কর্মসূচি নিয়েছে। ক্ষমতায়নে নারীদের মূল সম্পৃক্ত করার কারণে তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জেগে উঠেছে। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবার পথ খুঁজে পেয়েছে। মেহেরপুরের নারী শ্রমিকদের সাথে কথা বলতে গেলে রাজিয়া সুলতানা নামে এক নারী এমনটাই বলেন।
নকশী কাঁথা তৈরী করি, আমরা ইমারত নির্মানের মতো কঠিন কাজে জোগালি দেয়া, মাঠে ফসলকাটার কাজ, এলজিইডির গ্রামীন উন্নয়নে রাস্তাঘাটে শ্রম বিক্রিসহ বিভিন্ন কাজে অন্তত ৫ হাজার নারী জড়িত। পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি কাজ করেন নারীরা। তারপরেও তাদের পুরুষের সমান মুজুরি দেয়া হয়না। ব্যাংকগুলোও তাদের ঋণ দিতে আগ্রহী হয়না। পুরুষের মতো সুবিধা দেয়া হলে নারীরা বিভিন্নখাতে আরও বেশী অবদান রাখতে পারবে বলে বিশ্বাস করে সমাজের ধারক বাহকেরা। মেহেরপুরের নারী শ্রমিক ও বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ এমনটাই বলেছেন।
নারীরা এতটা পথ অতিক্রান্ত করেছে বঞ্চনার মধ্যদিয়ে। নারীর সচেতনতার মধ্যদিয়ে নারী আন্দোলন ব্যক্তিকেন্দ্রিক থেকে সামষ্টিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। নারী আন্দোলন এখন শুধুমাত্র সংগঠনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, সংগঠনের বাইরেও নারীরা আন্দোলন করে যাচ্ছেন। নারী আন্দোলনের পুরোধা বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন ছিল- নারী কেরানি থেকে জজ-ব্যারিস্টার হবেন। বেগম রোকেয়ার সেই স্বপ্ন নারীরা বাস্তবায়ন করেছেন। তারা এগিয়ে চলছেন সদর্পে। মেহেরপুরের নারীরা তার প্রমান করছেন।
সরেজমিনে মেহেরপুরের সহগলপুর গ্রামে দেখা যায় দলবদ্ধভাবে নারীরা নকশী কাঁথা তৈরী করছেন। তাদের তৈরী কাঁথা চলে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশে। সম্প্রতি নেদারল্যান্ডের সরকারি প্রতিষ্ঠান পামের প্রতিনিধি প্রকৌশলী বার্নাডেট ডেম হুইস সহগলপুর এই গ্রামের নারীদের নকশী কাঁথা তৈরী দেখতে আসেন। তিনি এই কাজের ভূয়সী প্রসংশা করে বলেন এই নকশী কাঁথা বাংলাদেশকে আলাদাভাবে পরিচিতি এনে দেবে বিশ্বে।
মেহেরপুরের সহগলপুর গ্রামের নকশী কাঁথার কারিগর আলতাফন। সে সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট এ্যান্ড পিস (সিডিপি) থেকে নকশী কাঁথার কাজ শেখে। মাত্র দুই হাজার টাকা পুঁজি দিয়ে পুরাতন কাপড়, সুই আর সুতা কিনে নকশী কাঁথা তৈরী করে বিক্রি শুরু করে। এখন সে বাড়িতে বসেই কাঁথার অর্ডার পান। কাঁথা বিক্রি করেই এখন তার মাসে তিন থেকে চার হাজার টাকা আয় হয়। কাজের অবসরে এই কাঁথা তৈরীতে গ্রামের নারীরা ধীরে ধীরে তার কাছে ছুটে আসেন কাজ শিখতে। তার সহযোগিতায় গ্রামের অন্য নারীদেরও অবস্থার উন্নতি হয়। নকশী কাঁথায় আয়ের টাকায় অনেকের পাকা বাড়ি হয়েছে, কিনেছে আবাদি জমি, বসিয়েছেন নলকূপ ও স্বাস্থ্য সম্মত পায়খানা। একদিন সমাজে মাথা নিচু করে থাকতে হতো, দিন কাটতো অনাহারে। এখন সবাই ডেকে কথা বলে, সমাদর করে, প্রসংশা করে আলতাফনকে।
একই গ্রামের তসলিমা খাতুন ছেলে-মেয়ের লেখা পড়ার খরচ জোগান নকশী কাঁথা সেলাইয়ের কাজ করে। তসলিমা মেয়ে রাবেয়াকে সাথে নিয়ে দিন পনেরোর মধ্যে একটি কাঁথা তৈরী করেন। এ উপার্জনের টাকায় তিনি একটি গাভী গরুও কিনেছেন। স্বামীর টাকায় চলে সংসার। নকশী কাঁথার টাকা তাদের উন্নয়নের চাবিকাঠি।
সহগলপুর গ্রামের আবদুর সাদেক জানান- এখন এ গ্রামের তৈরী কাঁথার কদর বেড়ে গেছে, কিন্তু কারিগরেরা চাহিদা অনুযায়ী কাঁথা সরবরাহ করতে পারছে না। গ্রামটির বেশির ভাগ বাড়ির নারীরা এখন কাঁথায় নকশা তোলার কাজ করছে।
গ্রামের রিতার বাড়ীর উঠানে দেখা গেল ২৫-৩০ জন নারী নিপুন হাতে কাঁথায় ফুল, কলস, পাখি, নৌকা, হাতি, ঘোড়া, বর, বধু, পালকিসহ বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সংগে যুক্ত নানান বিষয়ে সুই-সুতা দিয়ে ফুটিয়ে তুলছেন। একটি উন্নতমানের কাঁথায় নকশার কাজের পর কতটা অসাধারণ হয়ে ওঠে তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। নারী কারিগর খুরশিদা ও নিলুফা অভিন্নসুরে জানান- এখন তারা সম্মানের সাথে বেঁচে আছেন। কাঁথা, জায়নামাজ, বিছানা ও গায়ের চাদর, তোয়ালা, বালিশে কভারে নকশা তোলার কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন। তাদের সন্তানেরাও স্কুল-কলেজে যায়। সংসারে তাদের মতামত গুরুত্ব পায়।
সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট এ্যান্ড পিস (সিডিপি) মেহেরপুর সংস্থার পরিচালক তৃপ্তিকণা বিশ্বাস জেলার দুস্থ, অসহায়, তালাকপ্রাপ্তা ও বিধবা নারীদের জীবন বদলে দিয়েছে। গ্রামের গাড়াবাড়িয়া গ্রামের মালা খাতুন, সান্তনা, পারুলা, তসলিমা, হাসিনা, ময়না, ফিরোজা, রিতা, খুরশীদা, নিলুফা, জেসমিন, আসমা, আনজিরা, আলতাফুননেছা সহ অনেকেই এই শিল্পের সংগে জড়িত। তারা জানালেন সংসারের কাজের সাথে সাথে কাথা সেলাই করে মাসে প্রায় তারা দুই হাজার টাকা করে আয় করেন। এই বাড়তি আয়ের টাকা দিয়ে সংসারের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটিয়ে ছেলে-মেয়েদের লেখা পড়ার খরচ জোগান দেয়ার কাজ করেন।
মেহেরপুরের ইতিহাস ঐতিহ্য গ্রন্থের লেখক প্রবীন সাংবাদিক তোজাম্মেল আযম এ প্রসঙ্গে বলেন, নকশী কাঁথা শিল্পের গ্রামীন মহিলা কারিগরদের প্রতিটি সুইয়ের ফোড় থাকে তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন। একটা সময় এই অঞ্চলের মেয়েদের নকশী কাঁথা তৈরী শেখানো হতো পারিবারিকভাবে যাতে শ্বশুরবাড়িতে তার কদর বাড়ে। সেই কাঁথা এখন এ অঞ্চলের মেয়েদের স্বাবলম্বী করছে। দেশের মধ্যে জেলার সুনাম হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে মেহেরপুরের মেয়েদের তৈরী কাঁথার কদর বাড়ছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তারা এই শিল্পে আরও অবদান রাখতে পারবে।
এই লেখক আরও জানান, আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে নকশি কাঁথা প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে আছে। তান্ত্রিক বৌদ্ধদের মাধ্যমেই আমাদের পুর্ব বাংলায় এই নকশার ব্যাপক প্রবর্তন হয় যদিও এটা আরও অনেক আগে থেকেই চলে আসছিল।

বি/এস/এস/এন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে