ডেস্ক রিপোর্টঃ সবুজ পাহাড়ে ধূসর রঙের ছনের চালার ঘর এখন আর তেমনটা চোখে পড়ে না। রোদে চিকচিক করা রূপালী ঢেউটিনের চালা বহু দূর থেকেই জানান দেয় তার সদম্ভ অস্তিত্বের কথা। সবুজের ফাঁকে তাই সাদার ঝিকিমিকি। সময়ের স্রোতে গা-ভাসাতে গিয়ে কমদামি ঢেউটিনের ব্যাপক ব্যবহারের মুখে চাহিদা কমে যাওয়ায় পাহাড়ে আর আগের মতো ছন চাষ করছেন না চাষিরা। ফলে দ্রুত ছনের চালার স্থান দখলে নিয়েছে কমদামি টিন। দীর্ঘদিন ধরে ছনের চাষ ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন পার্বত্য এলাকার অনেক মানুষ। আর হাজার বছরের পরম বন্ধু ‘ছন’ আজ নিজের অস্তিত্ব বিলীন করে চলেছে।
সম্প্রতি বর্নাল ইউনিয়নের বড়পাড়ার গিয়ে দেখা যায়, ছন বিক্রির জন্য পাহাড় থেকে নিয়ে আসা হচ্ছে গ্রামে। তাদের একজন সন্তোষ ত্রিপুরা সাথে কথা বলে জানা যায়, বাংলা বর্ষের আশ্বিন থেকে চৈত্রমাস পর্যন্ত ছন আহরণ করা হয়ে থাকে। চাষাবাদে তেমন পরিশ্রম নেই। শুধুমাত্র পাহাড়ের যে অংশে ছন চাষ করা হবে তা পরিষ্কার করে দিলেই কিছুদিন পর প্রাকৃতিকভাবেই ছনের কুঁড়ি জন্ম নেয়।
তবে বাণিজ্যিকভাবে ছন চাষ করলে দেড় দুই হাত দৈর্ঘ্য হলে আগাছা পরিষ্কার করে একবার ইউরিয়া সার প্রয়োগ করলে ছন লম্বা ও ঘন হয়ে থাকে। আর ৬-৭ ফুট লম্বা হলেই কাটার উপযুক্ত হয়। আহরণের পর পর্যাপ্ত রোদে ১৫ থেকে ২৫ দিন শুকিয়ে নিতে হয়। এরপরই তা ব্যবহার উপযোগী হয়। অন্যদিকে বাগানে বড় কোন গাছ থাকলে তার ছায়া ও পাতা পড়ে শণের বৃদ্ধিতে যেমনি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তেমনি ছনে পচন ধরে নষ্ট হয়। ফলে উৎপাদন হ্রাস পায়।
ছন বিক্রেতা ও চাষি দম্পতি শোভা রাণী ত্রিপুরা ও কার্তিকজয় ত্রিপুরা বলেন, তাদের দুই একর পাহাড়ে ছন প্রাকৃতিক ভাবে হয়ে থাকে। দিনে একজন শ্রমিক ৬ বোঝা ছনকাটতে পারে। শ্রমিককে ২০০টাকা দিতে হয়। কিন্তু কাঁচা অবস্থায় তা দূর পাহাড় থেকে বহন করে আনা সম্ভব হয় না। আবার শুকোতেও সময় লাগে ১৫ থেকে ২৫ দিন।
শংকা প্রকাশ করে তারা আরো বলেন, আগে যে কোন পাহাড় থেকে ইচ্ছে মতো ছন সংগ্রহ করা যেত এখন মালিকেরা দিতে চায় না। তাছাড়া আগের মতো চাহিদা না থাকায় দামও ভালো পাওয়া যায়না ।
মাটিরাঙ্গা তবলছড়ি থেকে আসা ছন ক্রেতা আব্দুল জলিল বলেন, ৩০০টাকা দিয়ে তিন ভার ক্রয় করেছেন তিনি। জানালেন ছন মাত্র এক দু’বছর ব্যবহার করা যায়। তবে অর্থের সংকুলান না হওয়ায় রান্না ঘরের চালায় টিন লাগাতে পারেননি। ছন ক্রয় ও চালা মেরামতে শ্রমিকের পেছনে যে অর্থ ব্যয় হয় ওই পরিমাণ অর্থ দুই বা তিন বছর জমা করে ঘরে ঢেউটিন লাগানো যায়। তাই টিনের ব্যবহার দ্রুতই বাড়ছে।
পানছড়ি উল্টাছড়ি ইউনিয়নের মরাটিলার বাসিন্দা পান চাষি বরেন্দ্র ত্রিপুরা বলেন, ছন পানবরজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে আগের মতো ছন আর পাওয়া যায় না। তাই অনেকে ছন ব্যবহার না করে বাঁশ ব্যবহার করছেন। বিশেষত: ধনিয়া পাতা চাষের জন্য ক্ষেতের চারপাশে বেড়া এবং উপরে রোদ প্রতিরোধক চালা তৈরি করছেন এই ছন ব্যবহার করে।
মাটিরাঙ্গা উপজেলার বর্ণাল ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্যা অনি রজ্ঞন ত্রিপুরা জানান, আগে আমাদের এলাকা ছনের জন্য বিখ্যাত ছিল। বর্তমানে পাহাড়ে ছনের উৎপাদন ও ব্যবহার কমে যাওয়ায় এটি এখন বিলুপ্তির পথে। তবে এক সময় হাজার বছর ধরে ব্যবহৃত মাথা গুজার ঠাঁই ছন হারিয়ে যাবে। এর ব্যবহার বিভিন্নভাবে বাড়ানো গেলে হয়তো ছনরক্ষা করা সম্ভব হতো।

বি/এস/এস/এন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে