মুহম্মদ আলতাফ হোসেন

altaf-sir-muktomot

বিডি নীয়ালা নিউজ(১৬ই এপ্রিল১৬):- একজন আইনজীবীকে যদি বার কাউন্সিল সনদ গ্রহণ করে পেশা শুরু করতে হয়, একজন চিকিৎসককে যদি ইন্টার্নীশিপ শেষ করে মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের সনদ নিয়ে কাজ করতে হয়, তাহলে একজন সাংবাদিককে কেন বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল থেকে সনদ গ্রহণ করতে হবে না ? এটা অবশ্যই একটি কঠিন প্রশ্ন। আইন পেশা,  চিকিৎসা পেশা তো সর্বকালেই একটি মহৎ পেশা। সাংবাদিকতাও একটি মহৎ পেশা। অতএব তফাতটা কোথায়?  দেশে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে কেন সনদ প্রবর্তন করা হবে না?

আইন, চিকিৎসা, সাংবাদিকতা পেশায়ও আছে দুষ্টগ্রহ। সাংবাদিকতায় এমন দুষ্টগ্রহ ও দুষ্ট চক্রই হলুদ সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত। হলুদ সাংবাদিকতাই  সাংবাদিকতার মতো মহৎ পেশাকে করছে কলূষিত। এক সময় দেশে সংবাদপত্র কম ছিল আর তাই সাংবাদিকের সংখ্যাও ছিল কম।

বর্তমান সময়ে  প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাথে যোগ হয়েছে অনলাইন মিডিয়া। সাংবাদিকের সংখ্যাও তাই অগণন। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ ফেডারেল ইউনিয়ন অব জার্নালিষ্টস, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি ও জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা ছাড়া আশির দশকের গোড়ার দিকেও সাংবাদিকদের জাতীয় ভিত্তিক কোন সংগঠন ছিলনা। বর্তমানে সংগঠনের সংখ্যা অনেক। আঞ্চলিক ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে সংগঠন। বেড়ে চলছে সদস্য সংখ্যা। জেলা-উপজেলা-গ্রাম-গঞ্জেও আছে প্রেসক্লাব কিংবা সংগঠন সমূহের শাখা প্রশাখা। সাংবাদিকতার বিকাশে অবশ্য এটা একটা শুভ লক্ষণ। কিন্তু পরিশীলিত বিন্যাস, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, পেশাগত মানোন্নয়ন ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে বিকাশ কতটুকু সাধিত হয়েছে বা হচ্ছে তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন অস্বীকার করা যাবেনা।

আমাদের দেশে সব সাংবাদিক যে জার্নালিজমে অনার্স-মাস্টারস করে সাংবাদিকতায় আসছেন তা কিন্তু নয়। এমনকি বেশির ভাগ সাংবাদিকই যে ন্যূনতম মাস্টার্স-গ্রাজুয়েশন কিংবা ইন্টার করে এসেছেন তাও কিন্তু সঠিক নয়। বরং বলা যায় এস,এস,সি কিংবা নাইন-টেন পর্যন্ত পড়াশুনা করেও অনেকে দক্ষতার সাথে সাংবাদিকতা করছেন। তার মধ্যে প্রাইমারী লেভেল মাত্র পড়েছেন এমনও অনেকে আছেন বলেও শোনা যায়। কিন্তু এদের মধ্যে অনেকেই ভালো পত্রিকার সাথে ভালো ভাবেই সাংবাদিকতা করে সুনাম অর্জন করেছেন। দীর্ঘ অভিজ্ঞতাও হয়তো অনেকের আছে। কিন্তু এভাবে দক্ষ হওয়া এক কথা, আর প্রাথমিক ন্যূনতম জ্ঞান নিয়ে এ পেশায় আসা ভিন্ন কথা। দুটোর মধ্যে কিন্তু ফারাক থেকেই যাচ্ছে।

মানসম্পন্ন সাংবাদিকতায় আসতে হলে ন্যূনতম ধারণা নিয়েই আসতে হবে। এ বিষয়টি মাথায় রাখলেই প্রয়োজন একটি সনদপত্র। আর এ সনদপত্রটি দিতে পারে প্রেস কাউন্সিল। এজন্যে প্রয়োজন হলে প্রেস কাউন্সিলকে বিকেন্দ্রীকরণ করা যেতে পরে। জেলায় জেলায় না হলেও প্রাথমিকভাবে বিভাগীয় পর্যায়ে প্রেস কাউন্সিল থাকাটাও বাঞ্ছনীয়। এতে সাংবাদিকদের সনদ গ্রহণ হবে সহজতর। এ পেশায় যারা আসতে চাইবেন তাদের ক্ষেত্রে এ ধরাবাঁধা অবস্থান তাদের আগ্রহকে এগিয়ে দিতে সহায়তা দেবে।

বর্তমানের শিক্ষা ব্যবস্থায় জেএসসি চালু করা হয়েছে। গ্রামগঞ্জে অনেক সময় বহু মেধাবী ছাত্রছাত্রী ঝরে পড়তে বাধ্য হয়। জেএসসি লেভেলে বিষয় ভিত্তিক সিলেবাসে সাংবাদিকতা বিষয়ে ন্যুনতম ধারণা দেয়া যেতে পারে। কিংবা এসএসসি পর্যায়েও এসংক্রান্ত পাঠ অন্তর্ভূক্ত করা সম্ভব। এর মাধ্যমে সাংবাদিকাতার প্রাথমিক ন্যুনতম জ্ঞান লাভ করা সম্ভব হতে পারে। এ লদ্ধজ্ঞানই এক সময় সাংবাদিকতাকে তার নিজস্ব গতি-প্রকৃতির সাথে পরিচিত করাতে সহায়তা দেবে। শুধু তাই নয় শিক্ষার্থী বিষয়টি নিয়ে ভাবতে পারবে, মূল বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করতে বিলম্ব হবেনা। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হতে পারে। ধরা যাক প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় এসএসসি‘তে ইংরেজী বিষয়ে ১০ বা ১৫ মার্কের একটি রিপোর্ট লিখতে হয়। রিপোর্ট লেখার স্টাইলটি কি এটা না জেনেই শিক্ষার্থী তা মুখস্ত করে কিংবা লিখে ফেলে পরীক্ষার খাতায়। আবার অনেক শিক্ষার্থী মূল বিষয়টি বুঝতে না পারার কারণে ‘কমন’  না পড়লে ঐ প্রশ্নের উত্তর লেখেনা। একটি রিপোর্ট লেখার ক্ষেত্রে ইংরেজী শিক্ষককেও স্টাইলটি জানতে হবে। এক কথায় বিষয়জ্ঞান থাকতে হবে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর। অন্যথায় গৎবাঁধা প্রশ্নের বাইরে এলেই হোঁচট খেতে হবে।

প্রেস কাউন্সিল যে সনদ দেবেন ক্যাটাগরি ভিত্তিক হলে উপযুক্ত মূল্যায়নও সহজ হতে পারে। মুড়ি-মিছরিকে এক দরে বিক্রির ব্যবস্থা যাতে না হয় এই ধারনাটাও এখান থেকে সহজেই অর্জন করা সহজ হতে পারে। আবার মনোন্নয়ন পর্ব সমাপ্ত হলে প্রেস কাউন্সিল তার মেয়াদও নির্দিষ্ট করে দেয়ার সুযোগ রাখতে পারে। অর্থাৎ বিষয় ভিত্তিক শিক্ষাকে প্রেস কাউন্সিল অগ্রাধিকার দিতে পারে। এর মাধ্যমে স্বচ্ছতা স্পষ্ট হবার সুযোগ থেকে যাবে।

আরও একটি বিষয় এখানে স্মর্তব্য, তা হলো, শিক্ষার্থী সাংবাদিকতাকে তার জীবনের লক্ষ্য হিসেবে পছন্দ করতে পারেন। লক্ষ্য করা যায় যে একজন শিক্ষার্থী কম্পোজিশন লেখার সময় সাধারণত: লিখে থাকেন তিনি একজন বড় ডাক্তার হবেন। ডাক্তার হয়ে তিনি মানুষকে সেবা দেবেন। গ্রামে-গঞ্জে ছুটে যাবেন, দু:স্থ মানুষকে চিকিৎসা সেবা  প্রদান করবেন। কিন্তু মহৎ পেশা হিসেবে একজন শিক্ষার্থী সাংবাদিকতার মাথ্যমে দেশসেবা করবেন, মানুষের সুখে দুখে পাশে দাঁড়াবেন, কিংবা জনগনের মনের কথাকে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণে তুলে ধরবেন, এমন কথা সাধারণত:  কম্পোজিশনে কোন শিক্ষার্থী লেখেন না। এর কারণ মূলত: একটিই, আর তা হলো এসবের ধারণা শিক্ষার্থীর কাছে স্বচ্ছ নয়।

প্রেস কাউন্সিলের সনদ একজন সাংবাদিককে স্বাভাবিকভাবেই দায়িত্বশীল ও উদ্যমী করে তুলবে। তার ভেতরে ইতিবাচক মানসিকতা কাজ করবে।পক্ষান্তরে সনদের ক্যাটাগরী মানে এই নয় যে, এতে কারো অবমূল্যায়ন হবে। চাকুরী ক্ষেত্রে নিয়োগের বেলায় সার্টিফিকেট, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, সাক্ষাৎকার ইত্যাদিতে যেভাবে নম্বর বন্টন থাকে সনদপত্রের বেলায়ও প্রেস কাউন্সিল যদি এমন ব্যবস্থা নেয় তাতে তো দোষের কিছু থাকার কথা নয়। এতে শিক্ষার দক্ষতা, বিষয়-জ্ঞানের দক্ষতা, কাজের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার দক্ষতা স্বাভাবিক ভাবেই উঠে আসবে। শুধু পত্রিকা থেকে একটি আইডেনটিটি কার্ড কিংবা নিয়োগপত্র নিলেই যে সাংবাদিক পরিচিত পাবেন সনদপত্র তা রহিত করবে। এর মাধ্যমে সাংবাদিকতার দুষ্টগ্রহ অনেকাংশে বিদায় নেবে। এর মাধ্যমে প্রকৃত সাংবাদিকতার লক্ষ্যে পৌছাতে সক্ষম হবার পথ সুগম হবে। সনদপত্রধারী একজন সাংবাদিককে অবমূল্যায়ন করার পথ বন্ধ হবে এবং সুষ্ঠু সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সনদ প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ প্রেস কাউন্সিল প্রয়োজনীয় ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।

আজকাল অহরহ সাংবাদিক নির্যাতনের বিভিন্ন ঘটনা চোখে পড়ে। সাংবাদিকদের ওপর মামলা করে ভীতি প্রদর্শন এবং দৈহিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়। প্রেস কাউন্সিলের সনদ প্রবর্তনের ব্যবস্থা থাকলে এ বিষয়টিরও সহজ সুরাহা হতে পারে। যদি প্রেস কাউন্সিল কোন বিষয়ের সুরাহা করতে ব্যর্থ হয় কেবল তাহলেই একজন সাংবাদিককে আদালতে নেয়া যেতে পারে। পক্ষান্তরে কাউন্সিল তাদের রায়ের মাধ্যমে বিষয় নিত্তির যে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে তাতে আদালত হস্তক্ষেপ নাও করতে পারেন। কারণ কাউন্সিলের প্রদত্ত রায় স্বাভাবিক ভাবেই আদালত সুদৃষ্টিতে দেখবেন।

সাংবাদিকতা সবচেয়ে ঝুকিপূর্ণ পেশা। তাছাড়াও সুনাম দুর্নাম দুটাই এ পেশার সাথে জড়িত আছে। একজন সাংবাদিক যেমন সাহসিকতার সাথে কাজ করে দেশের সেবা করেন আবার তাকে ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে দুর্নামের ঘানিও টানতে বাধ্য করা হয়। অথবা কেউ কেউ নিজেদের উদরপূর্তি করতে গিয়ে ন্যায়নীতিকে নিমেষে জলাঞ্জলি দিয়ে হাতের প্রতিবেদন প্রত্রিকায় জমা দেননা। আবার কেউ আপেষহীন ভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গিয়ে প্রতিবেদন পত্রিকায় জমা দিয়ে নানা ভাবে আক্রান্ত হন। প্রেস কাউন্সিল এসব অনিয়মগুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে পারে এবং  এভাবে কাউন্সিলের নিস্ক্রীয় অবস্থানও কেটে যেতে পারে। তাই বিষয়টি নিয়ে প্রেস কাউন্সিলেরই উদ্যোগী হওয়া দরকার। দেশের খ্যাতিমান সাংবাদিক নেতৃত্বের পরামর্শ, উপদেশ ও দিক-নির্দেশনা নিয়ে যথাশীঘ্র সম্ভব বিষয়টির সুরাহা করা প্রয়োজন। সুস্থ ও সমৃদ্ধ সাংবাদিকতার স্বার্থে সরকারও এ ব্যাপারে সহায়তার হাত বাড়াতে পারে। ‘‘অধিক বিলম্ব’ সুন্দর চিন্তার মানসিকতাকে কুলষিত করে’’ এ কথাটি প্রসঙ্গত সংশ্লিষ্ঠ সবার মনে রাখা উত্তম।

লেখকঃ সভাপতি, জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে