ডেস্ক রিপোর্টঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে সংঘবদ্ধ অপরাধী দলের তিনটি চক্রকে শনাক্ত করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এই জালিয়াতচক্রের সদস্যরা অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের ভর্তি এবং সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায়ও জালিয়াতি করে আসছিল। সিআইডি কর্মকর্তারা জানান, ওই চক্রের জালিয়াতি থেকে বাদ যায়নি বিসিএস পরীক্ষাও। সিআইডি গত ১০ মাসে চারটি ধাপে অভিযান চালিয়ে ওই চক্রের ৩৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। ভর্তি জালিয়াতি করে তারা কোটিপতি বনে গেছে। তাদের মধ্যে চারজনের ১০ কোটি টাকার সম্পদের হিসাব পাওয়ার কথাও জানিয়েছেন সিআইডির সংঘবদ্ধ অপরাধ তদন্ত দলের কর্মকর্তারা।

সিআইডি সব শেষ ধাপে গত পাঁচ দিনে গ্রেপ্তার করেছে ৯ জনকে। তাঁদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) সহকারী পরিচালক (বরখাস্ত) অলিপ কুমার বিশ্বাস, বিএডিসির সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল এবং রাজধানীর দুটি স্কুলের শিক্ষক। সিআইডি জানায়, আগে গ্রেপ্তার করা ২৮ জনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। পরের ৯ জনের মধ্যে তিনজন গতকাল বৃহস্পতিবার আদালতে স্বীকারোক্তি দেয়। বাকি ছয়জনকে দুই দিনের রিমান্ড (জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজত) মঞ্জুর করেছেন আদালত।

জালিয়াতচক্রের সহায়তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গিয়ে বিশেষ ডিজিটাল ডিভাইসসহ আরো ১২ জন আটক হয়েছিল সিআইডির হাতে। তাদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, ভর্তি পরীক্ষা ও নিয়োগে জালিয়াতি করা একটি বড় সিন্ডিকেটের সদস্যদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে। তদন্তের শুরুতেই একটি চক্রের হোতা, বিকেএসপির সহকারী পরিচালক (বরখাস্ত) অলিপের নাম উঠে আসে। এরপর গা ঢাকা দেন তিনি। দীর্ঘদিন তদন্তের পর তাঁর অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তাঁকে আটক করে সিআইডির সংঘবদ্ধ অপরাধ তদন্ত দল।

সিআইডি কর্মকর্তাদের দাবি, তিন বছরে তিনটি চক্র জালিয়াতি করে শতাধিক  শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করিয়েছে। শতাধিক লোককে চাকরি পাইয়ে দিতেও হয়েছে জালিয়াতি। দুটি চক্র বিশেষ ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে প্রশ্ন সমাধান করে উত্তর পাঠায়। কেন্দ্র থেকে প্রশ্ন ফাঁস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলে এবং আলিয়া মাদরাসার দুটি কক্ষে বসে তারা প্রশ্নের সমাধান করত। এরপর ডিভাইসের সাহায্যে পরীক্ষার্থীদের কাছে উত্তর পাঠানো হতো। একটি চক্র ছাপাখানা থেকে প্রশ্ন ফাঁস করে প্রার্থীদের কাছে বিক্রি করত।

তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রেস থেকে প্রশ্ন ফাঁসকারী দলের হোতা নাটোর ও পাবনা জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা রকিবুল হাসান এসাহীকে আগেই গ্রেপ্তার করা হয়। ডিজিটাল জালিয়াতির একটি চক্রের হোতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী (বহিষ্কৃত) নাভিদ আনজুম তনয়কেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সর্বশেষ ধরা পড়লেন অপর ডিজিটাল জালিয়াত চক্রের প্রধান অলিপ কুমার বিশ্বাস।

গতকাল দুপুরে সিআইডি সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে সংঘবদ্ধ অপরাধ তদন্ত দলের প্রধান বিশেষ সুপার (এসএস) মোল্যা নজরুল ইসলাম জানান, গত পাঁচ দিনের সাঁড়াশি অভিযানে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁরা হলেন মাস্টারমাইন্ড বিকেএসপির অলিপ কুমার বিশ্বাস (৩২), বিএডিসির সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল (২৮), ৩৬তম বিসিএসে নন-ক্যাডার পদে সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত ইব্রাহিম (২৮), ৩৮তম বিসিএসের প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ আইয়ূব আলী বাঁধন (২৮), রাজধানীর অগ্রণী স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক গোলাম মোহাম্মদ বাবুল (৩৫), পিয়ন আনোয়ার হোসেন মজুমদার (৪২), নূরুল ইসলাম (৪৭), ধানমণ্ডি গভ. বয়েজ স্কুলের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক হোসনে আরা বেগম (৪০) ও পিয়ন হাসমত আলী শিকদার (৪০)।

চারজনের ১০ কোটি টাকার অর্থ-সম্পদের সন্ধান : নজরুল ইসলাম বলেন, ‘অলিপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ডিজিটাল জালিয়াতির মূল হোতা। কয়েক বছরে সে জালিয়াতির মাধ্যমে তিন কোটি টাকার বেশি আয় করেছে। গণমাধ্যমে নাম প্রকাশের পর সে গা ঢাকা দেয়। আর ইব্রাহিম, মোস্তফা ও বাঁধন বিসিএসসহ সব নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতির মূল হোতা। এরা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায়ই নয়, মেডিক্যাল, ব্যাংকসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস করত। এ ছাড়া বিভিন্ন বোর্ড পরীক্ষারও প্রশ্নপত্র ফাঁস করে আসছিল। এই চারজনের প্রায় ১০ কোটি টাকার নগদ অর্থ ও সম্পদের সন্ধান পেয়েছে সিআইডি।’ তিনি জানান, গত শুক্রবার অলিপ কুমার বিশ্বাসকে প্রথমে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর দেওয়া তথ্য মতেই অন্যদের গ্রেপ্তার করা হয়।

নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ভর্তি বা নিয়োগ পরীক্ষায় মূলত দুইভাবে জালিয়াতি হয়। একটি চক্র আগের রাতে প্রেস থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস করত। আরেকটি চক্র পরীক্ষা শুরুর কয়েক মিনিট আগে বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্র নিয়ে দ্রুত তা সমাধান করে ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে পরীক্ষার হলে পরীক্ষার্থীকে সরবরাহ করত। জিজ্ঞাসাবাদে অলিপ, ইব্রাহিম, বাঁধন ও মোস্তফা জানায়, কেন্দ্র থেকে প্রশ্ন ফাঁসের পর আলিয়া মাদরাসা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলের দুটি কক্ষে বসে অভিজ্ঞদের দিয়ে সমাধান করে ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে তারা পরীক্ষার্থীদের সরবরাহ করত। এই চারজন মূলত ডিজিটাল ডিভাইস চক্রে জড়িত। আর বাকি পাঁচজন (শিক্ষক ও পিয়ন) পরীক্ষার কেন্দ্র থেকে পরীক্ষা শুরুর কয়েক মিনিট আগে প্রশ্নপত্র সরবরাহ করত। গত বুধবার গ্রেপ্তারের সময় পিয়ন হাসমতের কাছে ৩৯তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষার কয়েক কপি প্রশ্নপত্র এবং ৬০ হাজার টাকা পাওয়া গেছে।’

এসএস নজরুল আরো বলেন, ‘গত কয়েক বছরে জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও সরকারি চাকরিতে শতাধিক ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়েছে চক্রটি। জালিয়াতির মাধ্যমে যারা নিয়োগ পেয়েছে, তাদের বেশ কয়েকজনের তথ্যও আমরা পেয়েছি। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করছি। যাচাই-বাছাই শেষে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ইব্রাহিমের ছিল বিলাসী জীবন : সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, আটক ব্যক্তিদের মধ্যে ইব্রাহিমের ছিল বিলাসী জীবন। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হলেও খুলনার মুজগুন্নী এলাকায় সাড়ে ৬ শতাংশ জমির ওপর চারতলা ভবন নির্মাণ করেন তিনি। নড়াইলে রয়েছে ডুপ্লেক্স বাড়ি। চলাচল করতেন ৩৬ লাখ টাকা দামের গাড়িতে। রাজধানীতে রূপালী মানি এক্সচেঞ্জ নামে তাঁর একটি অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। মাদরাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের ইব্রাহিম যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও জালিয়াতির মাধ্যমে ৩৬তম বিসিএসে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হন।

সংবাদ সম্মেলনে মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ছিল চক্রটির মূল উৎপাটন করা। সর্বশেষ অভিযানে ৯ জনকে আটকের মধ্য দিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের মূলোৎপাটন করা হয়েছে। এ মামলায় গ্রেপ্তারের সংখ্যা দাঁড়াল ৩৭।’

এসএস মোল্যা নজরুল ইসলাম গত রাতে বলেন, গতকাল ৯ আসামিকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করা হলে অলিপ কুমার বিশ্বাস, শিক্ষক গোলাম মোহাম্মদ বাবুল ও হোসনে আরা বেগম আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। বাকি ছয়জনকে দুই দিন করে রিমান্ডের অনুমতি দিয়েছেন আদালত।

তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ২০ অক্টোবর জালিয়াতি ধরার পর ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। শাহবাগ থানায় দায়ের করা একটি মামলায়ই আসামিরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ ছাড়া জালিয়াতি করে পরীক্ষা দিতে গিয়ে আটক হওয়া ১২ শিক্ষার্থীকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এরপর আরো চারজনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। ডিসেম্বরে গ্রেপ্তার করা হয় রাজধানীর ইন্দিরা রোডের ‘পিপলস প্রিন্টিং প্রেস’-এর কর্মচারী খান বাহাদুর ও তাঁর প্রতিবেশী সাইফুল ইসলাম এবং ওই চক্রের হোতা নাটোর ও পাবনা জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা রকিবুল হাসান এসাহীকে। অন্য সিন্ডিকেটের হোতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নাভিদ আনজুম তনয়কেও তখন গ্রেপ্তার করা হয়।

বিদেশ থেকে ডিভাইস আনা হয় : সিআইডির একাধিক সূত্রে জানা যায়, তিন বছর ধরে বিশেষ ডিভাইস ব্যবহার করে ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতি করা কয়েকজন ধরা পড়ে। তবে চক্রের মূলহোতা ছিল আড়ালে। এবারের তদন্তে নেপথ্যের কারিগরকে খুঁজে বের করার মিশন নিয়ে নামে সিআইডি। প্রেস থেকে প্রশ্ন ফাঁসকারীদের ধরা গেলেও ডিজিটাল ডিভাইস কোথা থেকে কারা সরবরাহ করছে তা বের করা যাচ্ছিল না। একপর্যায়ে জানা যায়, অলিপ ও তনয়সহ কয়েকজন বিদেশ থেকে ডিভাইসগুলো নিয়ে আসেন। এরপর তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশপাশে বসেই প্রশ্নের সমাধান করতেন। তাঁদের সহায়তা করেন কতিপয় শিক্ষক।

প্রশ্ন বাইরে পাঠাতে সহায়তা করতেন দুই শিক্ষক : সিআইডির কর্মকর্তারা বলেন, গ্রেপ্তারকৃতরা পরীক্ষা শুরু হওয়ার কয়েক মিনিট আগে প্রশ্নপত্র বাইরে নিয়ে যেতেন। এ কাজে সহায়তা করতেন অগ্রণী স্কুলের শিক্ষক গোলাম মোহম্মদ বাবুল, অফিস সহায়ক আনোয়ার হোসেন মজুমদার ও নুরুল ইসলাম, ধানমণ্ডি গভ. বয়েজ স্কুলের শিক্ষক হোসনে আরা বেগম ও পিয়ন হাসমত আলী শিকদার। তাঁদের প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পরীক্ষা হতো। গতকাল আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়ে দুই শিক্ষক বাইরে প্রশ্ন বের করে দেওয়ার দায় স্বীকার করেছেন। অলিপও ডিভাইস দিয়ে জালিয়াতির কথা স্বীকার করেন।

সিআইডি সূত্রে জানা যায়, রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দী থানার সুনিল কুমার বিশ্বাসের ছেলে অলিপ বিকেএসপিতে চাকরি করার পাশাপাশি ভর্তি জালিয়াতি করে আসছিলেন। ধানমণ্ডির এলিফ্যান্ট রোডে একটি বাসা নিয়ে থেকে তিনি ওই কাজ করতেন। গত ২০ অক্টোবর জালিয়াতি ধরা পড়ার পরই তাঁর নাম উঠে আসে। এরপর তাঁকে বরখাস্ত করে বিকেএসপি। সূত্র মতে, এটিএম কার্ডের মতো দেখতে বিশেষ ডিভাইসে এক ধরনের সিম ব্যবহার করা হয়। পরীক্ষার্থীর শরীরে ওই ডিভাইস দিয়ে কানে ছোট হেডফোন দেওয়া হতো। বাইরে আরেকটি ডিভাইস থেকে উত্তর বলে দেওয়া হতো। ওই ডিভাইসটি বাংলাদেশের বাজারে পাওয়া যায় না। অনলাইনে অর্ডার করে ভারত ও চীন থেকে এটি সংগ্রহ করা হয়েছে।

সিআইডির সংঘবদ্ধ অপরাধ তদন্তদলের অতিরিক্ত সুপার রায়হান উদ্দিন খান ও আসলাম উদ্দিন জানান, এসএস মোল্যা নজরুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে তাঁদের দলের সিনিয়র এএসপি সুমন কুমার দাসসহ মাঠপর্যায়ের সদস্যরা গভীর অনুসন্ধান চালিয়ে পুরো সিন্ডিকেটটি শনাক্ত করেন।

K/K/N.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে