সাব্বির আলম বাবু, বিশেষ প্রতিনিধি: পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে দেশকে রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বাংলার দামাল ছেলেরা। মার্চে মুক্তি সংগ্রামে উত্তাল হয়ে উঠেছিল সারা দেশ।

সবার প্রত্যয় ছিল একটাই- দেশকে শত্রুমুক্ত করা। যুবক-তরুণরা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন এই যুদ্ধে। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর অবশেষে আসে মুক্তি।

সারা দেশের ন্যায় মুক্তি সংগ্রামের সেই ঢেউ পৌঁছে গিয়েছিল উপকূলীয় জনপদের তটরেখা পর্যন্ত। মুক্তিযুদ্ধের সেইসব ঐতিহাসিক তথ্যাবলী নিয়ে ধারাবাহিকের আজকের পর্বে ভোলা জেলা ‘ওইখানে লাইনে দাঁড় করিয়ে নিরীহ বাঙালিদের হত্যা করেছে পাকিস্তানি হায়েনারা।

দূরে গ্রামবাসী শুনেছে আর্তচিৎকার। বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়ে মানুষগুলো ঢলে পড়েছে ছোট তেঁতুলিয়ার পানিতে। গুলি করে যাওয়ার পর আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে জীবিত মানুষদের বাঁচিয়ে দিয়েছি।

রাতভর পাহারা দেওয়ার পর অরুণ কুমার নামের একজনকে চিকিৎসার জন্য নৌকায় তুলে দেই। দূরের এক মুক্তিযোদ্ধা ঘাঁটিতে যাওয়ার পর তার চিকিৎসা হয়।

তিনি বেঁচে যান।’ ভোলার খেয়াঘাটের গণহত্যার চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে এই কথাগুলো বলছিলেন ভোলা সদরের চর সামাইয়া ইউনিয়নের পূর্ব চরকালি গ্রামের খোরশেদ আলম (৭৫)। তিনি জানান, ভোলা খেয়াঘাট নামে পরিচিত স্থানটি এখন লঞ্চঘাট।

লঞ্চ টার্মিনালের কাছে ছিল খেয়া ঘাট। এপার থেকে ওপারে মানুষজন পারাপার করতো ছোট্ট একটি নৌকা। যুদ্ধকালে ভোলার বিভিন্ন স্থান থেকে নিরীহ বাঙালিদের ধরে এনে এখানে হত্যা করা হতো।

একদিনের গল্প বলছিলেন খোরশেদ আলম। তিনি বলেন, ‘‘প্রতিদিনই আমরা হত্যার শিকার মানুষদের আর্তচিৎকার শুনতাম। একদিন হানাদার বাহিনী হত্যাকাণ্ড শেষ করে চলে যাওয়ার পর আমরা খেয়াঘাটের দিকে এগোই। সঙ্গে ছিলেন সিদ্দিক হাওলাদার নামের আরেকজন সমবয়সী স্থানীয় বাসিন্দা।

তারা শুনতে পান- একজন বলছে- ‘মা, তুমি তো পাগল হয়ে গেছো। আমি এখনো বেঁচে আছি। আমাকে গুলি করেছে ওরা।’ খোরশেদ ও সিদ্দিক ওই জীবিত ব্যক্তিকে ধরে বাগানের মধ্যে তুলে আনেন। সারা রাত নদীর পাড়ে ভয়ের জঙ্গলে একটি মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা চলে।

ভোর হওয়ার আগে নদীতে একটি নৌকা দেখতে পান খোরশেদ। ধমক দিয়ে, ভয় দেখিয়ে নৌকাটি থামিয়ে আহত মানুষটিতে তুলে দেন নৌকায়।

মানুষটি এভাবে বেঁচে যান।’’ এমন হাজারো গল্প রয়েছে দ্বীপ জেলা ভোলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে। ভোলার লঞ্চ ঘাটে নেমে মুক্তিযুদ্ধের সন্ধান করি।

বয়সী ব্যক্তিদের মধ্যে পূর্ব চরকালি গ্রামের রফিকুল ইসলাম ওরফে দাইমুদ্দিন (৬২), একই গ্রামের ফজলুর রহমান মিয়া (৬৩), নূরুল ইসলাম ওরফে বাগন আলী (৬০), সিদ্দিক হাওলাদারসহ (৭০) আরো অনেকে মুক্তিযুদ্ধের তথ্য দেন। পূর্ব চরকালি গ্রামে কোনো ধরনের আক্রমণ না হলেও এখানে মানুষের মধ্যে সারাক্ষণ আতঙ্ক বিরাজ করেছে। বহু নারী-পুরুষ ও শিশু পালিয়ে বেরিয়েছে দিনের পর দিন।

এই খেয়াঘাটটি ছিল হানাদার বাহিনীর আসা-যাওয়ার স্থল। এক পর্যায়ে খেয়াঘাটকেই হানাদার বাহিনী গণহত্যার স্থান হিসেবে চিহ্নিত করে। প্রতিদিন বিকেলে ও সন্ধ্যায় বিভিন্ন স্থান থেকে নিরীহ বাঙালিদের এখানে ধরে আনা হতো। খেয়াঘাটে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হতো। অনেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণরক্ষার চেষ্টা করেছে। কেউ কেউ সাঁতরে অন্য কিনারে পৌঁছাতে পেরেছে, অনেকে আবার স্রোতের তোড়ে ভেসে গেছে। খেয়াঘাটের এই হত্যাকাণ্ডের কারণে আশপাশের এলাকায় সব সময় আতঙ্ক বিরাজ করত।

ফজলুর রহমান মিয়া, যার বড় ভাইকে হানাদার বাহিনী ঘর থেকে ডেকে নিয়ে প্রকাশ্যে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছে, তিনি স্মৃতিচারণ করছিলেন। তিনি জানান, দেশ স্বাধীনের নয় দিন আগে হানাদার বাহিনী খেয়াঘাটে অবস্থান নিয়েছিল। তার বড় ভাই মোস্তাফিজুর রহমান রাতে ঘুমিয়ে ছিলেন।

তাকে এবং ইউনুস তালুকদার নামে আরো একজনকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে হত্যা করা হয়। তিনি জানান, খেয়াঘাটের পাড়ে দুটো তালগাছ ছিল।

ওই তালগাছের পাশে এনে মানুষদের হত্যা করা হতো। লঞ্চ টার্মিনালের নিকটে খেয়াঘাটের স্থানটি দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘এখানেই বহু মানুষকে পাক বাহিনী গুলি করে মেরেছে। স্বাধীনতার পর হানাদার বাহিনীর মধ্য থেকে যারা ধরা পড়েছে, তাদেরকে ওই তালগাছের সঙ্গে বেঁধেই মেরে ফেলা হয়।’ ঐতিহাসিক সূত্রগুলো বলছে, হানাদার বাহিনী ভোলা শহরে প্রবেশ করে ১৯৭১ সালের ২ মে।

পানি উন্নয়ন বিভাগের অতিথিশালায় তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। হানাদার বাহিনীর কমান্ডার জাহান জেব খান এই ভবনে অবস্থান করতেন। পানি উন্নয়ন বিভাগের পূর্ব পাশের দুটি ঘরই ছিল হানাদার বাহিনীর টর্চার সেল। ভোলার বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে আনা বহু লোককে এই টর্চার সেলে নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো। এদের লাশ পুঁতে রাখতো প্রাচীরের পাশে।

প্রতি রাতে অন্তত ১০ থেকে ১৫ জনকে এখানে নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো বলে বিভিন্ন তথ্যে পাওয়া যায়। অধিকাংশকে হত্যা করা হতো বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে। শুধু হত্যা আর নির্যাতন নয়, বিভিন্ন স্থান থেকে নারীদের ধরে এখানে ধর্ষণ করা হতো। এরপরও এরা প্রাণে রক্ষা পাননি। তাদের হত্যা করে মাটিতে পুঁতে রাখতো পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা। ধর্ষণ, নির্যাতন আর লুটপাটের নায়ক ছিল ক্যাপ্টেন মুনীর হোসেন এবং সুবেদার সিদ্দিক। আর এসব কাজে সহযোগিতা করে শান্তি কমিটির সদস্য আর রাজাকাররা।

ভোলায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণে জানা যায়, যুদ্ধকালে এ জেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে হানাদার বাহিনীর ৭টি সম্মুখ যুদ্ধ হয়েছে।

এরমধ্যে দুটি সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন প্রবীণ সাংবাদিক বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ তাহের। সাহসী ভূমিকা রাখায় বরিশাল বিভাগে ‘বিজয়ের ৪০ বছর’ পদক পান তিনি।

এম এ তাহের জানান, দ্বিতীয় সম্মুখ যুদ্ধ হয়েছিল বোরহানউদ্দিনের দেউলা তালুকদার বাড়ি। দেউলার দ্বিতীয় যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মারা যায় সাত সেনা।

আবুগঞ্জের গরুচোখা নামক এলাকায় সন্ধ্যার পর নৌপথে কয়েকজন রাজাকার নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে আসছিল। কিছুক্ষণ পর খবর পেয়ে বিপুল সংখ্যক মুক্তিবাহিনী তাদের পাল্টা আক্রমণ করে ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে বিজয়ের মিছিলে যোগ দেয়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে