আসাদ হোসেন রিফাতঃ নুর নাহার ও মহির উদ্দিন দম্পতি পেশায় চায়ের দোকানদার। লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার গোতামারী ইউনিয়নের মাঠেরপাড় এলাকার বাসিন্দা তাঁরা। শীতের মৌসুমে বাড়তি আয়ের জন্য বিক্রি করেন ভাপা পিঠা। তাঁদের ঘরে একটি কন্যা সন্তান ছিলো, তার বিয়ে দিয়েছেন অনেক আগেই৷ আর তাঁদের ক্ষুদ্র এই সংসারে ছেলে সন্তান থাকলেও জন্মের ১০ দিনের মধ্যেই মারা যান। এরপর তাদের আর নতুন করে বাবা-মা হওয়ার শখ অনুভব করেনি। তাই এখন পরিবার বলতে তাঁরা দু’জন ছাড়া আর কেউ নেই।

সোমবার (৯ জানুয়ারি) রাত ৮টার দিকে হাতীবান্ধা উপজেলার গোতামারী ইউনিয়নের দইখাওয়া বাজার মাঠে খোলা আকাশের নিচে ভাপা পিঠা বিক্রি করতে দেখা যায় তাঁদের। পিঠা বিক্রি করে যা রোজগার হয় তা দিয়ে ভালোই চলে তাঁদের সংসার। তাই যেকোনো বাঁধা বিপত্তি এলেও এই ব্যবসাকে তারা টিকিয়ে রাখতে চান।

মহির উদ্দিন পেশায় একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। শীতের মৌসুমে তাঁদের জন্য বাড়তি আয়ের আরেকটি সুযোগ এসে হাজির হয়। আর তা হলো পিঠা বিক্রি। সামনে তিনটি বেঞ্চ। আর বেঞ্চের সামনেই চারটি চুলা জ্বলছে। দু’টি চুলাতে ভাপা, একটিতে চিতই পিঠা আর একটিতে ডিম। স্ত্রী নুর নাহার তাওয়াতে করে পিঠা বানাচ্ছেন আর স্বামী মহির উদ্দিন পাশে বসে চুলায় লাকড়ি ঠেলে সহযোগীতা করছেন৷ দাঁড়িয়ে কেউবা সামনে বেঞ্চে পিঠা নেওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছেন।

পিঠা বিক্রেতা নুর নাহার ও মহির দম্পতির সফলতায় অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই জড়িয়ে পড়েছেন এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়। একজন নারী হয়েও স্বামী সঙ্গে ব্যবসায় যোগ দিয়ে স্থানীয়দের মাঝে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন নুর নাহার। স্বামীর মতো সংসার চালাতে অর্থ উপার্জনে ভূমিকা রাখতে পেরে খুশি নাহারও। সমাজের সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে জীবন যুদ্ধের ময়দানে টিকে থাকতে চান তাঁরা।

নুর নাহার বলেন, শীতকাল এলেই আমরা ভাপা পিঠা বিক্রি করি। যেটাকে বলা যায় একপ্রকার মৌসুমি ব্যবসা। শীতের সময় ভাপা পিঠা ও চিতই পিঠা’র ব্যবসা বেশ ভালোই চলে। আর লাভও হয় আশানুরূপ। তাই চায়ের দোকানের পাশাপাশি শীতের সময়টা পিঠা বিক্রি করি। তবে চিতই আর ডিমের চেয়ে বেশি বিক্রি হয় ভাপা।

পিঠা বিক্রেতা মহির উদ্দিন বলেন, দীর্ঘ ২ বছর ধরে পিঠা বিক্রি করে আসছি। বছরে ৯ মাস চায়ের দোকান আর বাকি ৩ মাস পিঠা বিক্রি করি। পিঠার উপকরণে যাতে ভেজাল না থাকে সেজন্য ঢেঁকি ছাটা চালের গুড়া দিয়ে পিঠা বানাই। পিঠা সুস্বাদু ও মান ভালো দেখে হাতীবান্ধার বিভিন্ন জায়গা থেকে ক্রেতারা পিঠা খেতে আসে। অনেকে পরিবারের জন্য বাড়িতে নিয়ে যান। দোকানে সকাল ৬টা থেকে ৯টা এবং বিকেল ৫টা থেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত পিঠা বিক্রি চলে। বিশেষ করে চিতই ও ভাপা পিঠা বেশি তৈরি হয়।

পিঠা খেতে আসা আব্দুর মালেক বলেন, সব ধরনের খাবার বাড়িতে তৈরি হয়না। ভাপা ও চিতই পিঠা খেতে খুবই ভালো লাগে। আমি একটু ফাঁকা সময় পেলে চলে আসি মহির ভাইয়ের দোকানে পিঠা খেতে। মাঝে মধ্যে বাড়ি’র জন্য নিয়ে যাই৷

আরেক ক্রেতা জাহাঙ্গীর কবির বলেন, শীতকাল এলেই ভাপা পিঠা বিক্রির আমেজ বেড়ে যায়। প্রায় প্রতিদিনই ভাপা আর চিতই পিঠা খেতে আসি। ভাপা’র দাম ১০ টাকা হলেও বেশ সুস্বাদু এই পিঠা। স্থানীয় এই বাজারে অন্যান্য দোকানের চেয়ে নুর নাহার ও মহির উদ্দিন দম্পতির পিঠা বেশি বিক্রি হয় বলে জানান তিনি।

হাতীবান্ধা আলিমুদ্দিন কলেজে’র প্রভাষক ও বাংলা বিভাগীয় প্রধান আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, বাংলাদেশ সরকারের যে দর্শন- গ্রাম হবে শহর, সেই লক্ষ্যকে বাস্তবায়ন করতে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ তাদের নিজের জীবনকে সুসজ্জিত করার জন্য জীবন সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছেন। একজন অশিক্ষিত নারীও যার একসময় হয়তো তিনবেলা খাবার ঠিক মতো জুটতো না, তারা-ও আজকে উদ্যোক্তা হিসেবে পরিগনিত হয়েছেন। তাঁদের কারণে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী আজকে ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। যে মানুষ গুলো একসময় দিনমজুর ছিলো, তাঁরাই এখন নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে পরিবার এবং সমাজের প্রয়োজন মেটাচ্ছেন।

প্রভাষক আসাদুজ্জামান আসাদ আরও বলেন, নুর নাহারের মধ্যে দিয়ে অবহেলিত নারী সমাজ চার-দেয়ালে বন্দি না থেকে বেড়িয়ে এসেছে নতুন কিছু সৃষ্টি করতে। তাঁরাই দেশের অর্থনীতির চাকা সমৃদ্ধি করতে ভূমিকা রাখছেন। প্রতিটি মানুষ হবে কর্মক্ষম, প্রতিটি নারী হবে নুর নাহারের মতো। এভাবেই এগিয়ে যাবে সমাজের অবহেলিত নুর নাহাররা, আর এভাবেই বির্নিমান হবে স্মার্ট বাংলাদেশ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে