ডেস্ক রিপোর্টঃ রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যর্থতায় হতাশা ব্যক্ত করেছে বাংলাদেশ। গতকাল শুক্রবার ভোরে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক বলেন, ‘আমাদের পূর্ণ আন্তরিক প্রচেষ্টার পরও মিয়ানমারে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি। এর থেকে দুর্ভাগ্যজনক আর কী হতে পারে?’ পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘আমি দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে মিয়ানমার থেকে আসা লোকজনকে আশ্রয় দেওয়ার মতো পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ আর নেই।’ তিনি প্রশ্ন করেন, ‘নিগৃহীতদের মানবিক আশ্রয় দেওয়ার জন্যই কি বাংলাদেশকে এই মূল্য দিতে হচ্ছে?’

নিরাপত্তা পরিষদে গতকাল ভোরের বৈঠকের মধ্য দিয়ে প্রায় এক মাস পর রোহিঙ্গা ইস্যু আবার আলোচনায় ফিরলেও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বরং এ বৈঠক হওয়া নিয়েই অনিশ্চয়তা ছিল। চীন ও রাশিয়া মিয়ানমার ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদে বৈঠক করাকে সমর্থন করে না। নিরাপত্তা পরিষদের ১৫টি সদস্যের মধ্যে অন্তত ৯টি সদস্য বৈঠকে বসতে আগ্রহী হওয়ায় চীন ও রাশিয়া তা ঠেকাতে পারেনি। তবে গতকালের বৈঠকেও চীন ও রাশিয়ার মিয়ানমারপ্রীতি প্রকাশ পায়। বৈঠকে বিশেষ আমন্ত্রণে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার অংশ নেয়। 

পররাষ্ট্রসচিব মিয়ানমারের সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে সন্ত্রাসের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোনো ধরনের ছাড় না দেওয়ার নীতিও পরিষদে তুলে ধরেন। তিনি পরিষদের বিবেচনার জন্য তিনটি প্রস্তাবও উত্থাপন করেছেন। এগুলো হলো প্রত্যাবাসনের আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করতে এবং আনান কমিশনের সুপারিশগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্তের অগ্রগতির জন্য নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা, নিরাপত্তা পরিষদের আবারও কক্সবাজার ও রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন এবং মিয়ানমারের ভেতর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রস্তাবিত অসামরিক ‘সেফ জোন’ (নিরাপদ অঞ্চল) সৃষ্টি করা।

পরিষদের এবারের বৈঠকেও মিয়ানমারের সমালোচনা করেছে পশ্চিমা শক্তিগুলো। জাতিসংঘে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত কারেন পিয়ার্স বলেন, ‘আমরা খুবই হতাশ। শরণার্থীরা ফিরতে আগ্রহী হয় এমন পরিবেশ সৃষ্টিসহ প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।’ জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের উপরাষ্ট্রদূত জনাথন কোহেন বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবিরকে অগ্রাহ্য করতে পারে না।’ জাতিসংঘ মহাসচিবের মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি ক্রিস্টিন শ্রেনার-বার্গনার পরিষদকে জানান, মিয়ানমারের রাখাইনে জাতিসংঘের প্রবেশাধিকার বর্তমানে অত্যন্ত সীমিত। তিনি দাবি করেন, সংকট সমাধানে দৃশ্যমান পদক্ষেপ অত্যন্ত ধীরগতির হলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পূর্ণ সহযোগিতায় এ সংকটের সমাধান সম্ভব হতে পারে। পরিষদের অস্থায়ী সদস্য জার্মান রাষ্ট্রদূত হিউসজেন বলেন, রাখাইনে এখনো কঠিন ও উত্তেজনাকর সময় চলছে। স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনের পরিবেশ সৃষ্টি হলেই শুধু রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হওয়া উচিত। পশ্চিমা শক্তিগুলো মিয়ানমারের মিত্র চীন ও রাশিয়ার ভূমিকারও সমালোচনা করে।

জাতিসংঘে চীনের উপরাষ্ট্রদূত উ হাইতোও বলেন, রোহিঙ্গা মূলত মিয়ানমার ও তার প্রতিবেশী বাংলাদেশের সংকট, সমাধানের দায়ও শুধু এই দেশ দুটির। বক্তব্যটিতে সমর্থন জানান রাশিয়ার উপরাষ্ট্রদূত দিমিত্রি পলিয়ানস্কি।

 পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীরও ক্ষোভ : রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের ভূমিকায় বাংলাদেশ ক্ষুব্ধ ও হতাশ বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহিরয়ার আলম। নিরাপত্তা পরিষদে গতকাল ভোরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিবের খোলাখুলি হতাশা প্রকাশের পর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বিবিসিকে একই ধরনের হতাশার কথা জানান। তিনি বলেন, এ দেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করা হোক—এটিই এখন চায় বাংলাদেশ। প্রতিমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমারকে বাধ্য না করতে পারলে এই সমস্যার সমাধান আসবে না।

চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে এই ইস্যুতে বাংলাদেশের যোগাযোগের বিষয়ে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ওই দেশ দুটির কথা হলো, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যাটি বেশ জটিল। তাই মিয়ানমারকে সময় দিতে হবে।

প্রশংসা জাতিসংঘ মহাসচিবের : পররাষ্ট্রসচিব গত বৃহস্পতিবার রাতে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে বৈঠক করেন। জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন জানায়, বৈঠকে জাতিসংঘ মহাসচিব রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে উদ্বেগ জানান। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে উদারতা ও মানবিকতা দেখিয়েছে তিনি তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। মিয়ানমারের নিপীড়নের শিকার হয়ে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর মধ্যে গত ১৮ মাসে এসেছে সাত লাখেরও বেশি।

K/K/N.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে