ইউনিয়ন পর্যায়ে টেংরা, গুলশা ও পাবদা জাতীয় মাছের চাষ ছড়িয়ে দিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। পাঁচ বছরের প্রকল্পটি যে খরচে অনুমোদিত হয়েছিল, সেই খরচে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। মেয়াদ ঠিক রেখে ২৪২ কোটি টাকার প্রথম সংশোধনীতে প্রায় ২৮ কোটি টাকা খরচ বাড়ানো হয়েছিল। এবারে প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাব করার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় যেমন বাড়ছে ২ বছর, তেমনি আরও ১০৭ কোটি টাকা বাড়তি খরচ প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রকল্পের মূল খরচের ৪৪ ভাগ বাড়ছে এই সংশোধনীতে।

এদিকে, এই প্রকল্পের আওতায় মৎস্য চাষ প্রযুক্তি শিখতে ১৪ কর্মকর্তার বিদেশ সফরের সংস্থান রাখা হয়েছে। জনপ্রতি ৪ লাখ টাকা খরচ হিসেবে এই খাতে ব্যায় অর্ধ কোটি টাকারও বেশি— ৫৬ লাখ। জানা গেছে, প্রকল্পটিতে কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বাবদ আরও অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কোভিড-১৯ তথা করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতির কারণে পরিকল্পনা কমিশন সে বরাদ্দ প্রস্তাবনায় ভেটো দেয়। তবে ১৪ কর্মকর্তার বিদেশ সফরের অংশটুকু বাদ দেওয়া যায়নি।

‘ইউনিয়ন পর্যায়ে মৎস্যচাষ প্রযুক্তি সেবা সম্প্রসারণ (দ্বিতীয় পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাব বিশ্লেষণ করে এ চিত্র দেখা গেছে। পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রকল্পটির দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাবটি নিয়ে গত ১০ জুন অনুষ্ঠিত হয় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা। ওই সভায় দেওয়া সুপারিশগুলো প্রতিপালন করায় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) আগামী সভায় সংশোধনী প্রস্তাবটি উপস্থাপনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রকল্পটির মূল ব্যয় ছিল ২৪২ কোটি ২৮ লাখ টাকা। ২০১৫ সালের মার্চ থেকে চলতি বছরের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু প্রকল্পের শুরু থেকে গত এপ্রিল মাস পর্যন্ত ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় ২১৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা, যা প্রকল্পের মোট অনুমোদিত ব্যয়ের ৭৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এ অবস্থায় এখন প্রকল্পে নতুন এলাকা অন্তর্ভুক্ত করায় বিভিন্ন অংশের ব্যয় বেড়েছে। তাছাড়া নানা কারণে গত জুন মাসে মেয়াদ শেষ হলেও এর মধ্যে বাস্তবায়ন শেষ না হওয়ায় ফের মেয়াদ বৃদ্ধির কারণে প্রকল্পটি সংশোধন করতে হচ্ছে।

এর আগে প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনীতে ব্যয় বাড়ানো হয় ২৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা। তাকে প্রকল্পের ব্যয় ২৭০ কোটি ৫৮ লাখ টাকায় দাঁড়ায়। এরপরও প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শেষ না হওয়ায় এখন আরও ১০৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা বাড়িয়ে মোট ৩৭৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাৎ মূল প্রকল্প থেকে ব্যয় বাড়ছে প্রায় ৪৪ শতাংশ, প্রথম সংশোধনী থেকে প্রায় ৪০ শতাংশ। আর মেয়াদ বাড়ছে দুই বছর।

প্রকল্পের প্রস্তাবনায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, মৎস্য অধিদফতর গত কয়েকবছর ধরে মাছের উৎপাদন বাড়াতে তৃণমূল পর্যায়ে উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। এজন্য ‘ইউনিয়ন পর্যায়ে মৎস্য চাষ ও প্রযুক্তি সেবা সম্প্রসারণ (প্রথম পর্যায়)’ শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০০৯ সালের জুন থেকে ২০১৪ সালের জুন মেয়াদে এটি বাস্তবায়িত হয়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) প্রকল্পটি মূল্যায়ন করে দ্বিতীয় পর্যায় বাস্তবায়নের সুপারিশ করে। সে অনুযায়ী দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়, যা এখনো বাস্তবায়নের কাজ চলছে।

প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, এই প্রকল্পের আওতায় ইউনিয়ন পর্যায়ে গুলশা,পাবদা ও টেংরা মাছ চাষের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার জনপ্রিয় করা হয়েছে এবং তাতে উৎপাদন বাড়ছে। তিন হাজার ইউনিয়নে প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিদের মধ্যে এই কার্যক্রম সফলতা পেয়েছে। ফলে দেশের সবগুলো ইউনিয়নে এই প্রযুক্তি ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। এ কারণে আট বিভাগের ৪ হাজার ৩০০টি ইউনিয়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে দ্বিতীয় সংশোধনীতে।প্রকল্পের আওতায় ২২ হাজার ৩৯১টি প্রদর্শনী পুকুর ও সিবিজি প্রদর্শনী স্থাপন, প্রকল্প এলাকায় ১ হাজার ১০৯টি সিবিজি গঠন, মৎস্য প্রযুক্তি বিষয়ক যন্ত্রপাতি (৬১৫টি অ্যারোটর ও ১ হাজার ৪২৫টি ডিজিটাল ওয়াটার টেস্টিং কিট) সংগ্রহ ও দফতরের জন্য সমঞ্জাম সংগ্রহ করা হবে। এছাড়া প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজনও করা হবে প্রকল্প এলাকায়।

প্রকল্পটির দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) মো. জাকির হোসেন আকন্দ বলেন, প্রস্তাবিত সংশোধিত প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দেশের ইউনিয়ন পর্যায়ে মাছের উৎপাদন বাড়বে। এতে জনগণের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বাড়বে। প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষিত, কারিগরি জনবল তৈরি হবে, যেটি টেকসই মৎস্য উৎপাদনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সহায়ক হবে। অন্যদিকে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আত্মকর্মসংস্থান বাড়বে, যা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নকেও ত্বরান্বিত করবে। এসব বিবেচনায় প্রকল্পটির সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদনযোগ্য বলে মত দেওয়া হয়েছে।

সংশোধনীতে বিদেশ সফরের একটি অংশ পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তির মুখে বাদ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ১৪ কর্মকর্তার বিদেশ সফরের অংশটিও বাদ দেওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক জৈষ্ঠ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, কোভিড মহামারি বিবেচনায় নিয়ে বিদেশ সফর খাতে বর্ধিত বরাদ্দ প্রস্তাব বাদ দিয়ে পরিকল্পনা কমিশন ভালো কাজ করেছে। তবে আগে থেকেই রয়ে যাওয়া অংশটিও বাদ দেওয়া উচিত ছিল। কেননা সরকার অর্থ সংকটে রয়েছে। এ অবস্থায় উন্নয়ন প্রকল্পে কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যয় যেকোনো মূল্যে প্রতিহত করা উচিত।

BD/P

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে