ডেস্ক রিপোর্টঃ আজ বাংলা ভাষার প্রথম টেলিভিশন বাংলাদেশ টেলিভিশন-বিটিভি ৫২ বছরে পদার্পণ করছে। দিনটি উদযাপনের জন্য এদিন বিটিভির রামপুরার সদর কার্যালয়ে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত এক প্রীতি সম্মিলনের আয়োজন করা হয়েছে।

১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর তৎকালীন ডিআইটি ভবনের নিচতলায় বিটিভির আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৬৭ সালে টেলিভিশন করপোরেশন ও স্বাধীনতা-উত্তর ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে বাংলাদেশ টেলিভিশন একটি সরকারি গণমাধ্যমে রূপান্তরিত হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে আধুনিক প্রযুক্তি সংযুক্ত করে ১৯৭৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ডিআইটির ক্ষুদ্র পরিসর থেকে রামপুরার বৃহত্তর পরিমণ্ডলে টেলিভিশন কেন্দ্র স্থানান্তর করা হয়। সারা দেশের নানা প্রান্তের বিটিভির ১৪টি উপকেন্দ্রের মাধ্যমে ঢাকা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠান রিলে করা হয়ে থাকে।

পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল হচ্ছে বিটিভি 

—এস এম হারুন অর রশিদ, মহাপরিচালক, বিটিভি

বিটিভির ৫২ বছর পূর্তির প্রারম্ভে পাঁচ মাত্রিক সরাসরি অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে, এ বিষয়ে কিছু বলুন—

প্রথমত মনে করি, টিভি বিংশ শতাব্দীর মাধ্যম। একবিংশ শতাব্দীতে এসে আগের অবস্থা নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। একে সময় উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। তাই টেকনোলজির উন্নয়ন দরকার। যোগাযোগ প্রযুক্তির অবিশ্বাস্য উত্থানের যুগ এই একুশ শতক। এটা এমন একটা সময় যখন দর্শকদের জীবনে দর্শনযোগ্য পর্দা মানে শুধু টেলিভিশন স্ক্রিন নয়। এ এমন একটা সময় যখন যেখানে যেমন ইচ্ছা অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ দর্শকের হাতের মুঠোয়। স্মার্ট ফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ মানে যে কোনো ডিভাইসে নিজের সুবিধা ও ইচ্ছামতো অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারে একুশ শতকের মানুষ। ডিজিটালাইজেশনের এই যুগে যখন মিডিয়াকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে তখন দর্শকের কাছে তার সুবিধামতো অবস্থা ও অবস্থানে অনুষ্ঠান পৌঁছানো এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পথপ্রদর্শক হিসেবে দেশে প্রথমবারের মতো পাঁচ মাত্রিক সরাসরি অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু করেছে বিটিভি। টেকনোলজির এই উন্নয়নের ফলে দর্শক এখর যে মাধ্যমে কমফোর্ট করবে সেখানেই অনুষ্ঠান দেখতে পারবে। এক কথায় বলব টিভি হচ্ছে অন্যতম একটি যোগাযোগ মাধ্যম। তাই একে হালনাগাদ করতে হবে।

এই ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট কোনো অনুষ্ঠান থাকছে নাকি সব ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার হবে?

আপাতত সুপ্রভাত সংগীতানুষ্ঠান দিয়ে এই কার্যক্রম শুরু করা হলো। পর্যায়ক্রমে দর্শক পছন্দের সব অনুষ্ঠান এতে স্থান পাবে।

বিটিভির ৫২ বছর পূর্তিতে বিশেষ কোনো পরিকল্পনা কি আছে?

বিটিভি হচ্ছে পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্ট। মানে এই বিটিভি জনমানুষের এবং সব মানুষ এর মালিক। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনের কারণ হলো বাঙালী হচ্ছে উৎসবপ্রিয়। তাই উৎসবের অংশ হিসেবে পূর্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। তা ছাড়া এমন অনুষ্ঠানে নতুন পুরনোর মিলনমেলা হয়। সবার সঙ্গে সবার যোগাযোগের সুযোগ ঘটে। যা এমনি সময় সম্ভব নয়। এই মিলনমেলায় নতুনদের প্রত্যাশা আর পুরনোদের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের আলাপের মাধ্যমে নতুন দিগন্তের সূচনা সম্ভব। আমরা মিউজিয়ামসহ অনেক কিছু করেছি। এখর বিটিভির সবাই মিলে জনমানুষের এই টিভিকে আরও সমৃদ্ধ করতে হবে। তাই বিটিভির অনুষ্ঠান মানোন্নয়নে যা দরকার সবই করা হবে।

আগামী সময়ে তা হলে নতুন আঙ্গিকে বিটিভি যাত্রা করছে। এতে আর কী নতুনত্ব থাকছে?

একটা সময় বিটিভি একাই ব্রডকাস্ট করত। এখন অনেক টিভি চ্যানেল। তাই বিটিভি যা দেখাবে দর্শক আর তা দেখবে না। তাই দর্শক কী চায় অনুষ্ঠানে তার প্রতিফলন থাকতে হবে। নতুন ধ্যান ধারণায় সমৃদ্ধ নতুন প্রজন্মের মনের মতো করে অনুষ্ঠান সাজাতে হবে। যাতে নতুন প্রজন্মকে বিটিভির সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায়। ৩ মাসের জন্য অনুষ্ঠান নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে। বিদ্যমান প্রযুক্তির সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটানো হবে। বিটিভি এখনো অ্যানালগ পদ্ধতিতে রয়ে গেছে। সরকার একে ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিয়ে যেতে সব রকম সহযোগিতা দিয়েছে। তাই ২০১৮ সালের মধ্যে বিটিভি, বিটিভি ওয়ার্ল্ড ও চট্টগ্রাম টেলিভিশনকে পূর্ণাঙ্গ ডিজিটালাইজেশন করে তোলা হবে। আমরা চাই মানুষ বিটিভি দেখুক, জ্ঞানী ও বোদ্ধা শ্রেণি এর সঙ্গে যুক্ত হোক এবং জাতি ও জাতীয় জাগরণের জন্য কাজ করুক বিটিভি।

প্রথম বাংলায় চেক লেখা শুরু হয়

মোস্তফা মনোয়ার

সাবেক মহাপরিচালক, বিটিভি

পাকিস্তান আমলে যখন টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হয় তখন টেলিভিশনে পাকিস্তানি কালচার প্রচার করার জন্য চাপ থাকা সত্ত্বেও আমরা বাঙালি কালচারের অনুষ্ঠান প্রচার করতে সক্ষম হয়েছিলাম গোঁড়া থেকেই। আর আগে বাংলায় চেক লেখার প্রথা ছিল না কোথাও। বাংলায় চেক লিখলে তা ভাঙানো যেত না।

আমরা এর থেকে প্রথম বেরিয়ে এসে ইতিহাসে প্রথম বাংলায় চেক লেখা শুরু করি। আর মনোগ্রামের প্রসঙ্গে এলে বলব এখন যে মনোগ্রাম দেখছেন তখন পুঁথির অক্ষর দিয়ে আমি এই মনোগ্রাম তৈরি করেছিলাম যা এখনো বিদ্যমান। তখন টেলিভিশনের প্রথম মহাপরিচালক জামিল চৌধুুরী ভাই, অনুষ্ঠান প্রধান সেলিম ভাই সবাই একসঙ্গে কাজ করতাম। সেই সময়ের টেলিভিশন অনুষ্ঠানের সঙ্গে বর্তমানে বিভিন্ন চ্যানেলে যে সব অনুষ্ঠান প্রচারিত হয় তার পার্থক্য অনেক।   বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

বাংলাদেশের কালচারে কোথায় যেন একটা অবহেলা। এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। ভালো মানের অনুষ্ঠান প্রচার করতে হবে সব চ্যানেলে। আমাদের সময়ে আমরা রবিন্দ্রনাথের ডাকঘর নাটক থেকে শুরু করে চমৎকার কিছু কাজ করেছিলাম। যা এখনো স্মৃতির পাতায় সমুজ্জ্বল।

বাংলাদেশ টেলিভিশনের নাম হূদয়ে রয়ে যাবে

— মোস্তফা কামাল সৈয়দ

অনুষ্ঠান প্রধান, এনটিভি

শুরুতেই বিটিভিকে ৫২ বছর পূর্তিতে অন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। আমি ভাবতে পারছি না যে এতগুলো বছর এত তাড়াতাড়ি কেটে যাবে। আমার ভালো লাগছে একদিন এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলাম। যতদিন বেঁচে খাকব বাংলাদেশ টেলিভিশনের নাম হূদয়ে রয়ে যাবে।

বিটিভির উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি। এই মুহূর্তে বিটিভির প্রথম মহাপরিচালক জামিল চৌধুরী ভাই, সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা মনোয়ার ভাইসহ আরও অনেকের কথা মনে পড়ছে। এখনকার সময় এবং তখনকার সময়ের মধ্যে রয়েছে অনেক পার্থক্য। আমাদের সময় এত আধুনিক প্রযুক্তি ছিল না। এখনকার ছেলেমেয়েরা আধুনিক প্রযুক্তির এবং উন্নত সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। তবে আমি বলব কোন কোন ক্ষেত্রে এখন ঘাটতি আছে। যদিও আমরা জীবিকা নির্বাহের তাগিদে চাকরি করতাম তবুও যতদিন বিটিভিতে ছিলাম কখনো চাকরি হিসেবে কাজ করিনি। কাজের প্রতি আমরা অনেক বেশি আন্তরিক ছিলাম আরও বেশি ডেভোশন এবং কমিটমেন্ট ছিল যা এখনকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে কিছুটা কম। কমিটমেন্ট এবং ডেভোশন এর দিকে আরও বেশি জোর দেয়া উচিত বলে আমি মনে করি। সর্বোপরি বিটিভিকে এমন আনন্দের দিনে আবারও অভিনন্দন জানাচ্ছি।

আমার পরনে ছিল সবুজ শাড়ি এবং লাল চাদর 

—ফেরদৌসি রহমান

কণ্ঠশিল্পী

বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম সংগীত শিল্পী হিসেবে অনুভূতি নিঃসন্দেহে চমৎকার। তখন বুঝিনি এটা একটা ঐতিহাসিক ঘটনা হতে যাচ্ছে। বিটিভির সঙ্গে সঙ্গে আমার প্রোগ্রাম ‘এসো গান শিখি’র একইসঙ্গে ৫৩ বছরে পা দিল। একমাত্র বিটিভিই এত বছর ধরে বাচ্চাদের জন্য এরকম একটি অনুষ্ঠান প্রচার করে আসছে।

আমাদের দেশে এখন এত এত চ্যানেল অথচ এই অনুষ্ঠানটির বিকল্প এখনও কোথাও তৈরি হয়নি। একই ধরনের অনুষ্ঠানের পুনরাবৃত্তি দেখা যায় সব চ্যানেলে। নতুন কিছু নেই। একটি বেসরকারি চ্যানেলে ‘ভালবেসো মোর গান’ শিরোনামে একটি অনুষ্ঠান শুরু করি। কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল এই অনুষ্ঠানের আদলে বিভিন্ন চ্যানেলে এই রকমের অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়েছে। এটা হতাশাজনক। যা হোক মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। অত্যন্ত আনন্দ এবং গর্বের একটা ব্যাপার হলো আমি যখন প্রথম বিটিভিতে গান গাইতে দাঁড়াই তখন আমার পরনে ছিল সবুজ শাড়ি এবং লাল চাদর যা পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার রং। এটি কাকতালীয় হলেও আমার জন্য এটা অনেক বেশি গর্বের। বিটিভির ৫২ বছর বর্ষপূর্তিতে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি সবাইকে।

সে সময় কাজকে প্রাণের চাহিদা মনে করা হতো।

—সরকার ফিরোজ

সিইও, এটিএন নিউজ

ডিআইটি-তে ছোট্ট একটি স্টুডিও নিয়ে আজকের বিটিভির যাত্রা। সব শাখা মিলিয়ে মাত্র ৪০-৪৫ কর্মকর্তা ছিলাম। সবার মধ্যে একাত্মতা ছিল। তখনকার সময় নাটকের মান অনেক ভালো ছিল। যার মধ্যে মানচিত্র, মুখরা রমণী বশীকরণ, অন্যতম।   ভালো মানের গানের অনুষ্ঠান, বিভিন্ন অনুষ্ঠান, খবর ইত্যাদি প্রচার হতো যা দর্শক নন্দিত ছিল। সত্যিকার অর্থে আমরা এখনো গর্ববোধ করি সে সময়ের কথা চিন্তা করে।

সেকালের বিটিভি আর একালের বিটিভির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। পরিবর্তন হয়েছে কেবল মনমানসিকতায়। আসল কথা হলো সে সময়কার কাজগুলো প্রাণের চাহিদা বলে মনে করা হতো। বর্তমান বিটিভিকে দর্শক নন্দিত করতে হলে পুরো বিটিভিকে ঢেলে সাজাতে হবে। সেটা না, কিছুটা ব্যতিক্রমী আনা প্রয়োজন। যারা প্রোগ্রাম করবে তারা কন্ট্রাক্ট ব্যাসিসে কাজ করতে হবে। তাদের যে সন্মানী দেয়া হবে সেটাই তাদের জন্য অনেক হবে। এভাবে করতে পারলে মান আরও বাড়বে এবং ৫২ বছরের ঐতিহ্যের এই বিটিভি থেকে পরবর্তীকালে অনেক কিছু আশা করা যায়। ’ কেননা, বর্তমানে সবাই টাকার পেছনে ছুটছেন, সংস্কৃতির পেছনে নয়। টাকা পয়সার জন্য দৌড়ালে তো আর সংস্কৃতির উন্নয়ন করা যায় না। সংস্কৃতিকে মনে ধারণ করতে হয়।

বি/পি/এন

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে