মারুফ সরকার , বিশেষ প্রতিনিধি  : আনিস আলমগীর: চলতি সপ্তাহে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় একজন তরুণীকে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে ‘আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেয়ার’ অভিযোগ আনা হয়েছে। গত ২৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় গুলশানের এক ফ্ল্যাটে গলায় ফাঁস লাগানো অবস্থায় ওই কলেজ পড়ুয়া তরুণীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এই ঘটনায় নিহতের বড় বোন বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছেন।

এ ধরণের কথিত আত্মহত্যা বা হত্যার ঘটনা বাংলাদেশে নতুন নয়। বসুন্ধরা গ্রুপএই মামলা করা এবং পুরো ঘটনাকে বসুন্ধরা গ্রুপের বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে বর্ণনা করেছে বিবিসির কাছে। মামলার বাদী নুসরাত জাহান সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, তাকে বিভিন্ন ভাবে ফোন দিয়ে অনেক আজে বাজে কথা বলা হচ্ছে। তারা নিরাপত্তা হীনতায় ভুগছেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, ‘অপরাধী যেই হোক, তাকে আইনের মুখোমুখি হতে হবে।’ বিষয়টি বিচারাধীন বলে আমি এই মুহুর্তে মামলার বিষয় নিয়ে পর্যালোচনায় যাচ্ছি না। আমি বরং মিডিয়ায় এই ঘটনার প্রতিফলন বা কভারেজ নিয়ে কথা বলি। ঘটনাটি বাংলাদেশের সংবাদপত্রের জন্য একটি দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। প্রমাণ করেছে সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে মিডিয়ার উপর সরকার বা অন্য কোনো শক্তির চাপ নয়, বরং

সেল্ফসেন্সরশিপ এখানে বড় সমস্যা। গণমাধ্যমে উপযুক্ত ট্রিটমেন্টে সংবাদ হয়ে আসার মত উপাদান এই ঘটনায় যথেষ্ট ছিল কিন্তু টেলিভিশনগুলোতে সে রাতে কোনো স্ক্রল চলেনি, কেউ নিউজ করেনি সেই রাতে। অথচ রাতেই অনেক টিভির রিপোর্টার উপস্থিত হয়েছিলেন থানায়, মামলার কপিও তাদের হাতে ছিল। থানা কর্তৃপক্ষের বক্তব্য তারা ধারণ করেছেন। যেহেতু তথ্য পেতে একুট দেরি হয়েছে পরদিন ছাপার অক্ষরে পত্রিকার পাতায় খবরটি না থাকলেও দোষ দেওয়া যাবে না। তবে সময়ের অভাবে নিউজটি প্রিন্টে না দিতে পারলেও অনলাইনের জন্য এই অজুহাত খাটে না কারণ তাদের প্রায় সবার ২৪ ঘণ্টার অনলাইন টিম রয়েছে।

অনেক পাঠক অবাক হয়েছেন দেশের বহুর প্রচারিত একটি বাংলা দৈনিকে সংবাদটি অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম পরিচয় ছাড়া আর মৃত তরুণীর বিস্তারিত পরিচয়ে প্রকাশ পেয়েছে বলে। পরে অবশ্য পত্রিকাটির অনলাইনে আসামীর নাম পরিচয় ভালোভাবে প্রকাশ করে। সেদিন রাতে টিভি গুলোর নিউজশোতে এটা নিয়ে আলোচনা হয়নি, যখন এর চেয়ে ছোটখাট ঘটনা নিয়ে তারা সময় নষ্ট করে। ঘটনার পরদিন গণমাধ্যমে যেভাবে এই ঘটনার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তাতে অনেক নেটিজেন ক্ষুব্ধ হয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় তা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।

পরদিন ২৮ এপ্রিল বুধবারের পত্রিকায় আরও নগ্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে সংবাদপত্রে চরিত্র। ঢাকার বাংলা পত্রিকাগুলো ৫ টাকা এবং ১০ টাকার দুটি শ্রেণিতে বের হচ্ছে। রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী গ্রুপের ৫ টাকা দামের একটি দৈনিক এটাকে লিড নিউজ করেছে। তাদের সঙ্গে বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবসায়িক সম্পর্ক খারাপ চলছে অনেক বছর থেকে। অন্যদিকে বসুন্ধরার সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে এমন রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীদের মালিকানায় ৫ টাকা দামের আর দুটি পত্রিকায় খবরটি গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। এখানে সংবাদের চেয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার মানসিকতার পাশাপাশি নিজস্ব গোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ানোকে গরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

সংবাদটি অনেক দৈনিকের প্রথম বা ভেতরের পাতায় স্থান পেলেও সিংহভাগ পত্রিকায় গুরুত্ব পায়নি। অনেকে আবার পুরো সংবাদটিই গায়েব করে দিয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখেনা বসুন্ধরার মালিকানাধীন মিডিয়াগুলোর একটিতেও সংবাদটি আসেনি। বসুন্ধরার মালিকানাধীন মিডিয়ার মধ্যে আছে বাংলাদেশ প্রতিদিন, কালের কণ্ঠ এবং দ্য সান-নামের তিনটি দৈনিক পত্রিকা। এই গ্রুপের রয়েছে নিউজ টোয়েন্টিফোর নামের একটি টিভি চ্যানেল, ক্যাপিটাল এফএম নামের রেডিও স্টেশন এবং বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর নামের একটি অনলাইন পোর্টাল।

দেশের শীর্ষ শিল্প প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ডিরেক্টরের বিরুদ্ধে এক তরুণীর সঙ্গে কথিত সম্পর্কের বিষয়টি বিদেশে হলে সারাদিন সেটাই হেডলাইন থাকতো গণমাধ্যমে। বাংলাদেশে তার প্রতিফলন না দেখা যাওয়ায় প্রতিক্রিয়া হওয়াটাই স্বাভাবিক কারণ এখানে স্পষ্টই সরকারের কোনো হাত নেই, যেটা গণমাধ্যম যথাযথভাবে সংবাদ প্রকাশের ব্যর্থতা ঢাকতে অযুহাত হিসেবে প্রায়শ দাঁড় করায়।

গণমাধ্যম মালিকরা আসলে কার সেবা করছেন, পাঠকের না তাদের নিজেদের? যে সব পত্রিকায় ২৮ এপ্রিল, এবং যেসব অনলাইনে বা টেলিভিশনে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত বসুন্ধরার এমডিকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত-প্রচারিত হয়নি, তারা প্রমাণ দিয়েছে যে ওইসব মিডিয়ার মালিকরা জনগণকে সংবাদ সরবরাহ করার জন্য নয়-নিজের অবৈধ ব্যবসা, নিজের এবং পরিবারের অপরাধ, অবৈধ কর্মকান্ড ঢাকার জন্য এই সব মিডিয়া চালাচ্ছেন। অন্যের মিডিয়া তাদেরকে আক্রমন করলে পাল্টা আক্রমন করার জন্য তারা মিডিয়া চালু রেখেছেন। এই ঘটনায় কাভারেজ এটাও প্রমাণ দিচ্ছে যে বেশ কিছু মিডিয়া বসুন্ধরার প্রতি সহমর্মী ছিল বা বসুন্ধরার মিডিয়া দ্বারা পাল্টা আক্রমনের শিকার হওয়ার ভয় ছিল তাদের।

এটাতে আরও প্রমাণিত হয়েছে যেসব দৈনিকে ২৮ এপ্রিল এই সংবাদটি গায়েব করে দেওয়া হয়েছে তার সম্পাদক বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি (যেখানে মালিক নিজেই সম্পাদক) এখন থেকে সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার নৈতিক অধিকার রাখেন না। জাতির সামনে বা সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে তার দেশ ও সমাজ নিয়ে নীতিবাক্য বলা সাজে না। যেইসব অনলাইনে এবং টেলিভিশনে মামলা হওয়ার পরদিনও এই নিউজ ছিল না তার সম্পাদক বা বার্তা প্রধান প্রকৃত সাংবাদিক দাবী করতে পারেন না। দৃশ্যত তারা আর দশটি চাকরির মতো এখানেও চাকরি করছেন। এডিটোরিয়াল জাজমেন্ট এখানে অকার্যকর ছিল।

পাঠক দর্শকদের উচিত আলোচিত আত্মহত্যা বা হত্যার নিউজটি গায়েব করে দেওয়া এইসব মিডিয়াকে চিহ্নিত করা, যাতে ভবিষ্যতে তারা ধোকার শিকার না হন, প্রকৃত সংবাদ থেকে বঞ্চিত না হন। সেই সঙ্গে তার বিপরীতে যারা যথাযথভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছে সেই সব গণমাধ্যমের বিকাশে সহায়তা করা। আস্থা রাখা। আরেকটি বিষয় নিজের অভিজ্ঞতা থেকে পাঠক-দর্শকদের সঙ্গে শেয়ার করা উচিত মনে করছি যে, মিডিয়া যতনা সেল্ফ সেন্সরশিপের চর্চা করেসরকারি চাপ তার তুলনায় নগণ্য। সরকার বিশেষ কোনো ঘটনায় জাতি যাতে বিভ্রান্ত না হয়, সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে সতর্ক হতে বলে। পৃথিবীর বুহু দেশে এমন নির্দেশ চলমান রয়েছে। নির্দেশনার যে প্রয়োজনও হয় আমরা তাও দেখেছি বিডিআর বিদ্রোহ বা হলি আর্টিজানের মতো ঘটনার কভার করার ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অদক্ষতায়। অবশ্য এটাও ঠিক দুটি ঘটনাই ছিল সরকার এবং মিডিয়ার জন্য নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা।

অন্যদিকে, আমি বিশ্বাস করি যে সরকারের নির্দেশনা পালন করেও পাঠক-দর্শক-স্রোতার কাছে সংবাদটি তুলে ধরা যায়। সেটার জন্য দরকার সম্পাদকের দক্ষতা। জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত সংবাদ ছাড়া কোনো চাঞ্চল্যকর সংবাদ গায়েব করলে জনগণ যেমন তা জানা থেকে বঞ্চিত হয় তেমনি সরকারের জন্যও তা হিতে বিপরীত হয়। বর্তমান সময়ে বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়া যখন অনেকক্ষেত্রে মূলধারার মিডিয়ারও আগে সংবাদ প্রচার করে দিচ্ছে তখন এ ধরনের সরকারি নিষেধাজ্ঞা অথবা প্রতিষ্ঠানের সেল্ফসেন্সরশিপ কোনো কাজেই আসে না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে