সিরাজগঞ্জ থেকে,মারুফ সরকারঃ বর্ষায় চরের মানুষের জীবনযাত্রা কেমন? এ প্রশ্ন হতে পারে সমতল ভুমিতে বসবাসকারী মানুষজনের। চারিদিকে যখন থৈ থৈ পানি, তখন চরের মানুষ কোথায় থাকে, কীভাবে বেঁচে থাকে ? এতাসব প্রশ্নের জবাব সহজ নয়।

প্রকৃতপক্ষে বর্ষায় চরের মানুষের জীবনে নেমে আসে মহাদুর্যোগ। ইতিহাসের দীর্ঘস্থায়ী ও ভয়াবহতম বন্যা ১৯৮৮ সাল। এর পর বড় বন্যা হিসেবে পরিচিত ১৯৯৪ এবং ২০০৪ সালের বন্যায় চর এবং সমতল ভুমিতে বসবাসকারী মানুষ বানের পানিতে একাকার হলেও চরের জীবনযাপন ছিল ভিন্নতর। নৌকা এবং ঘরের চালার উপর তারা বসবাস করেছে।

ঘুমিয়েছে খোলা আকাশের নীচে। ঘরের তৈজসপত্র বেশীর ভাগ মানুষের ডুবে গেছে। হাঁসমুরগী গবাদীপশু বানের পানিতে ভেসে গেছে, মরে গেছে। তারা শুধু মাঝে মধ্যে দু’চারদিন শুকনো খাবার খেয়ে জীবন বাঁচিয়েছে। ইজ্ঞিনচালিত নৌকার শব্দ শুনলেই তারা বুভুক্ষ মানুষের মতো তাকিয়ে ডাকাডাকি করেছে সাহায্যের জন্য। স্বাভাবিক বন্যা হলেও চরের অধিকাংশ বাড়িঘর ডুবে যায়। মানুষের কষ্ট বাড়ে। সীমাহীন কষ্টের মধ্যেও চরের মানুষ চরেই থাকে।প্রমত্তা যমুনাপারের সিরাজগঞ্জের পাঁচ উপজেলায় প্রায় ২৫ ইউনিয়নবাসী বসবাস করে দুর্গম চরে।

মধ্যে চৌহালী উপজেলার সাত ইউনিয়ন, কাজীপুর উপজেলার ছয় ইউনিয়ন , বেলকুচি উপজেলার তিন ইউনিয়ন শাহজাদপুরের তিন ইউনিয়ন পুরোটাই যমুনার দূর্গম চরে অবস্থিত। নানা দুর্যোগে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে চরের মানুষ । অতি বন্যা, ভাঙ্গন আর রোদের খরতাপে চরের মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। তবে চরের মানুষ কখনও পিছু পা হয়না। চর ছেড়ে সমতলভুমিতে আসতে চায় না। পরিস্থিতি মানিয়ে তারা চরেই জীবিকা নির্বাহ করে। ষড়ঋতুর এই দেশে ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চরের মানুষের পেশাও বদল হয়। বর্ষায় তারা নৌকার মাঝি, শুকনো মৌসুমে কৃষক।

কখনও জেলে আবার কখনও ঘাটের কুলি। অভাব অনটন আর শত সহস্র সমস্যা বুকে আগলে ধরে চরের মানুষ পড়ে থাকে চরে। সারাদিনের পরিশ্রান্ত শরীর এলিয়ে যমুনার বালিয়াড়িতে তৈরী ছনের ঘরেই পরম সুখে ঘুমায়। স্থায়ী সমতল ভূমি চরের মানুষকে আকর্ষণ করে না। চর যেন তাদের আসল ঠিকানা। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যমুনাসহ নদ-নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়। তবে গত ৫ বছরে চরের জীবন যাত্রায় আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। তারা অনেকেই টিনের ঘরে বসবাস করে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও পাকা হয়েছে। সোলার বিদ্যুত ব্যবহার করে। ঘরে রয়েছে টেলিভিশন ও মোবাইল ফোন।প্রমত্তা যমুনা আর আগের মত নেই। নদী দেখে মনে হয় না, এইখানে একদিন প্রবল স্রোতস্বিনী উত্তাল নদী ছিল। হারিয়ে গেছে যমুনার যৌবন। এই নদীর পাড় আর চরে বাস করে প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষ। এই মানুষ প্রতিনিয়ত বৈরী প্রকৃতির সাথে লড়াই করছে। লড়াই করছে নদীর নিষ্ঠুর ভাঙ্গনের সঙ্গে। বিশাল যমুনাচরসহ নদী পাড়ে বসত করা এসব মানুষ নদীর গতি প্রকৃতির সাথে পাল¬া দিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। অভাব অনটন ক্ষুধার যন্ত্রনা থাকলেও চরের মানুষ চর ছাড়তে চায় না।

নদীর টানেই চরের মানুষ আশায় বুক বেঁধে পড়ে থাকে ভাঙ্গা জীর্র্ণ কাশের ঘরে। বুক ভরা আশা, যে নদী দিনের পর দিন তাদের সর্বস্ব গ্রাস করেছে সে নদীই একদিন ফিরিয়ে দেবে বাপ-দাদার জমি জিরাত। বুক ভরা আশা, যদি হারিয়ে যাওয়া জোত জমি আবার জেগে ওঠে। এই আশা নিয়ে মৌসুমে মৌসুমে নদী আর প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করেছে চরের মানুষ। শত দুঃখ যন্ত্রনা নিয়ে অভাব অনটন নিয়ে চরের মাটিকেই আঁকড়ে ধরে আছে। তাদের মনে বদ্ধমূল ধারণা, ভাঙ্গা গড়াই নদীর খেলা। নদী পারের মানুষ আর চরবাসী মনে করে, জোত জমি গেছে, গেছে ঘরবাড়ি ভিটেমাটি তাতে দুঃখ নেই।

রাক্ষুসী যমুনা সব কেড়ে নিয়েছে। নদীর সঙ্গেই তারা যুদ্ধ করছে। নদীতেই তারা মরণ চায়। তাদের প্রত্যাশা তবুও নদী বেঁচে থাকুক। আগের মত উওাল হয়ে উঠুক। বর্ষাকালে উত্তাল নদীর স্রোতধারার সঙ্গে নদীবক্ষে বয়ে আনবে উর্বর পলি। শুকনো মৌসুমে জেগে ওঠা সেই নরম পলিতে ফসল ফলাবে।বর্ষাকালে উত্তাল নদীতে নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। অনেকে শুধুই মাছ ধরে। আবার একদিন ছিল, যেদিন তারা ঘাটের কুলি মজুরের কাজ করে জীবন কাটিয়েছে।

বিশাল যমুনা নদীর এক সময় স্রোতধারা হারিয়ে যায়। জেগে ওঠে বিশাল বিস্তীর্ণ চর। এই চরে এসে মানুষ বসতি গড়ে তোলে। জেগে ওঠা এসব চরের বিভিন্ন নামকরণ করা হয়। এসব দুর্গম চরের মানুষ ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে পেশা পরিবর্তন করে জীবিকা নির্বাহ করে। চরের মানুষ বর্ষাকালে নৌকা চালিয়ে আর নদীতে মাছ ধরে জীবন চালায়। শুকনো মৌসুমে জেগে ওঠা নদীর চরে ধান, পাট, চিনা, কাউন , বাদাম, তিল, তিষি চাষ করে। চরের মানুষ জেগে ওঠা চরের জমির আধিকার পায় না। চরগ্রাসী দস্যুরা তাদের লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে জেগে ওঠা চর দখলে নেয়।

জমিহারা চরের মানুষ আবার সেই জমি বর্গা চাষ করে। লাঠিয়াল বাহিনী তাদের চাষ করা জমির ফসল কেটে নিয়ে যায়। শুকনো মৌসুমে চর থেকে চরে যাতায়াতের মাধ্যম হেটে চলা, বাইসাইকেল এবং কোন কোন ক্ষেত্রে চরের বালিতে চলছে ঘোড়ার গাড়ি ও ভ্যান। চরের মানুষ মরিচ, সবজি, পাট, ধান,কাউন কলাই চাষ করে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে