ডেস্ক রিপোর্টঃ “আপনি যদি তাকে পান , তাকে গুলি করে হত্যা করুন – সে যে-ই হোক না কেন। তারপর তার পাশে একটা অস্ত্র রেখে দিন।” সুইডিশ এক রেডিও গতকাল (মঙ্গলবার) তাদের এক গোপন রেকর্ডিং প্রকাশ করে বলেছে, বাংলাদেশের বিশেষ পুলিশ র্যাবের একজন কর্মকর্তা বলছেন তাদের কাছ থেকে এ ধরণের নির্দেশ যায়। তিনি অবশ্য জানতেন না যে তার কথা রেকর্ড করা হচ্ছে।
র্যাবের কর্মকান্ড নিয়ে এক বিশেষ -এ গোপনে ধারণ করা এই রেকর্ডিং ব্যবহার করা হয়।
এতে কথিত ঐ র্যাব কর্মকর্তা ব্যাখ্যা করেছেন, কিভাবে তারা ‘হত্যা এবং অপহরণের’ অপারেশন চালান। রিপোর্টটিতে এই কর্মকর্তার কণ্ঠস্বর ইলেকট্রনিক উপায়ে পরিবর্তিত করে দেয়া হয়েছে বলে মনে হয়। রিপোর্টে বলা হয়, তিনি এরকম বেশ কিছু হত্যাকান্ডে অংশ নিয়েছেন – যার শিকার ব্যক্তিরা গুরুতর অপরাধী বলে সন্দেহ করা হয়, কিন্তু বিচারে তাদের অভিযুক্ত করা বা সৎপথে ফিরিয়ে আনা খুবই কঠিন বলে মনে করা হয়।
রিপোর্টটি নিয়ে ঢাকার কয়েকটি মিডিয়ায় লেখালেখি হয়েছে এবং সামাজিক গণমাধ্যমে কথাবার্তা হচ্ছে। ব্যাখ্যা এবং প্রতিক্রিয়া চাইলে, র্যাবের একজন মুখপাত্র বিবিসির কাদির কল্লোলকে বলেন, সুইডিশ রেডিও’র এই রেকর্ডিং ভুয়া। কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন,”তথাকথিত ঐ র্যাব কর্মকর্তার কোনো পরিচয় দেয়া হয়নি, তার কণ্ঠ বিকৃত করা হয়েছে…আর তাছাড়া র্যাবের কোনো কর্মকর্তা এ ধরণের নির্দেশ দিতে পারেন না।”
বাহিনীর ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সুইডিশ রেডিওর প্রচারিত গোপন রেকর্ডিংটি যাচাই করে দেখা হচ্ছে। তবে সুইডিশ রেডিও’র সংশ্লিষ্ট রিপোর্টার বিয়াট্রিস জ্যানযন এক ই-মেলে বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, রেকর্ডিংয়ের যথার্থতা যাচাই করা হয়েছে, এবং তারা পুরোপুরি নিশ্চিত যে রেকর্ডিংএ যে কর্মকর্তার কণ্ঠ তা র্যাবের একজন সিনিয়র কর্মকর্তার।
কি আছে সুইডিশ রেডিও’র গোপন রেকর্ডিংয়ে?
যে কথাবার্তা রেকর্ড করা হয়েছে তা বাংলায়। এর অনুবাদ করেছেন এমন লোকেরা যাদের সাথে এ ঘটনাবলীর কোন সংশ্রব নেই।
উচ্চপদস্থ র্যাব কর্মকর্তাটি ব্যাখ্যা করেছেন, কিভাবে পুলিশ অপরাধীদের কাছ থেকে টাকা নেয়, এবং তা দিয়েই অস্ত্র কিনে তা নিহত লোকের দেহের পাশে রেখে দেয়। রিপোর্টে বলা হয়, এর ফলে হত্যার একটি মোটিভ বা উদ্দেশ্য দেখানো যায়, বলা যায় যে র্যাব আত্মরক্ষার্থে গুলি করেছে।
অত্যন্ত ম্পর্শকাতর এই রেকর্ডিংটি প্রায় দুই ঘন্টা দীর্ঘ। বাংলাদেশ সম্পর্কে একজন বিশেষজ্ঞ এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ওলোফ ব্লমকভিস্টকে এটা শোনানো হয়েছে।
তিনি বলছেন, রেকডিং শুনলে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায় এটা ভেবে যে এরকম মানবাধিকার লংঘন বিষয়ে কেউ এত স্বাভাবিকভাবে কি করে কথা বলতে পারে। তিনি বলেন – “আমরা এ বিষয়ে কিছুই নিশ্চিত করতে পারি নি, কিন্তু এর তদন্ত হওয়া উচিত।”
সু্ইডিশ রেডিও এই কথোপকথনটি যাচাই করাতে একাধিক মাধ্যম ব্যবহার করেছে। তা ছাড়া অফিসারটির কথাও তাদের কাছে অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে।
এই রেকর্ডিংএ যা শোনা যায় – তার সাথে একই ধরণের অন্য ঘটনার বিবরণ মিলে যায় । র্যাবের ব্যাপারে এ ধরণের ঘটনার তথ্য মানবাধিকার সংগঠনগুলো বেশ কয়েক বছর ধরে সংগ্রহ করেছে।
র্যাবের হাতে একজন লোক নিহত হবার প্রতিটি ঘটনার পর একাধিক তদন্ত হয়েছে। কর্মকর্তাটির কথায় বোঝা যায়, কিভাবে ঘটনাটি জনগণ এবং সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরা হবে – কর্তৃপক্ষ সমন্বিতভাবে তা ঠিক করে থাকে।
তারা ‘ক্রসফায়ার’ বলে একটি শব্দ ব্যবহার করে। বলা হয়, র্যাবের ওপর গুলি করা হয়েছিল এবং তারা আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি করে।মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলে ‘ক্রসফায়ার’ আসলে একটি খুনকে আড়াল করার জন্যে ব্যবহৃত শব্দ।
উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাটি বর্ণনা করেছেন কিভাবে ‘টার্গেট’ লোকটিকে ধরতে হবে, কিভাবে তাকে হত্যা করতে হবে এবং মৃতদেহটি নিয়ে কি করা হবে। তাদের কথাবার্তায় আছে মৃতদেহের সাথে কংক্রিট ব্লক বেঁধে নদীতে ফেলে দেবার কথা।
কিভাবে হয়তো দোকানে চা খাবার সময় তাদের ধরা হয়, নিরাপদে রাখার কথা বলে গাড়িতে কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়, তার পর হত্যা করা হয় – এসব কথাও আছে।
র্যাব কর্মকর্তাটি বলছেন, “গুমের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ সবাই হতে পারে না। আমাদের নিশ্চিত করতে হয় যাতে কোন ক্লু পেছনে ফেলে না যাওয়া হয়। আমাদের দস্তানা পরতে হয়। পায়ের ছাপ যাতে না থাকে সে জন্য জুতোতেও ঢাকনা লাগাতে হয়।”
কর্মকর্তাটি বলছেন, প্রতিদিনই এরকম হচ্ছে। এক পর্যায়ে তিনি বলছেন, এটা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণেরও একটা উপায় হতে পারে। রিপোর্টে বলা হয়, রেকর্ডিংএ কোন কোন খুঁটিনাটি এতই ভয়াবহ যে অনুবাদককে একটু দম নেবার জন্য ঘরের বাইরে বেরুতে হয়েছে।
আটক লোকটির ভাগ্যে কি ঘটবে তার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ‘উচ্চ পর্যায়ে’। র্যাব কর্মকর্তাটি আটকদের ওপর অত্যাচারেরও বর্ণনা দিয়েছেন।
তিনি একটি অন্ধকার ঘরের বর্ণনা দেন – যার মাঝখানে একটি বাতি জ্বলে। “আটক ব্যক্তিকে উলঙ্গ করা হয়, তাকে হাতকড়া বেঁধে ঝোলানো হয়, অন্ডকোষের সাথে বাঁধা হয় ইঁট – যাতে সেগুলো প্রায় ছিঁড়ে যাবার মতো অবস্থা হয়। লোকটি অজ্ঞান হয়ে যায়। বোঝা যায় না সে বেঁচে আছে কিনা।”
র্যাবের এসব কর্মকান্ড নিয়ে বাংলাদেশে ব্যাপক উদ্বেগ রয়েছে, বলেন মি ব্লমকভিস্ট। এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর পূর্ণ তদন্ত করার আহ্বান জানাচ্ছে। মানবাধিকার আইনজীবী সুলতানা কামাল বিবিসিকে বলেন, ২০০৪ সাল থেকে র্যাবের বিরুদ্ধে বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগগুলো সঠিক তদন্ত না হওয়ায় এই বাহিনীকে নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে।
বি/বি/সি/এন