মো. মিঠুন মিয়া
‘‘ওস্তাদে প্রণাম করো পিতা হস্তে বাড়ে দোসর জনম দিলা তিহ সে আম্বার’’ -এভাবেই মধ্যযুগের অন্যতম কবি শাহ মুহম্মদ সগীরের কবিতায় উঠে এসেছে শিক্ষকের মর্যাদা। শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর। তাদের দেওয়া শিক্ষায় একজন মানুষ প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠে। পিতামাতার পরেই তাদের স্থান। আলোকিত মানুষ, মনুষ্যতের বিকাশ তথা একজন মানুষ হিসেবে জীবন যাপনের জন্য দরকার শিক্ষা। অন্ন বস্ত্রেরই মতোই শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। আর সেই শিক্ষা অর্জন করতে হলে আমাদেরকে শিক্ষকের কাছে উপনীত হতে হয়। শিক্ষক দেখানো পথই আমাদের পাথেয়। তার জ্ঞানেই আমরা ভালো মন্দের পার্থক্য নির্ণয় করি। অর্থাৎ শিক্ষকের চোখেই আমরা জগৎ দেখি। মানব সভ্যতা বির্নিমাণে এই শিক্ষক সমাজের রয়েছে বড় অবদান। আর এজন্যই বুঝি যুগে যুগে শিক্ষকদের সম্মান এবং মর্যাদা সবার উপরে। এই সমাজে আমরা প্রত্যেকে কোনো না কোনো শিক্ষকের শিক্ষার্থী।যে একটি অক্ষর শিক্ষা দিয়েছেন তিনিও আমাদের শিক্ষক। পিতামাতা জন্ম দিলেও আমাদেরকে মানুষ করার দায়িত্ব অর্পন হয় শিক্ষকদের উপরই। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার আব্দুর সাত্তার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে ওঠবস করানোর ঘটনা আমাদেরকে ভাবিয়ে তুলেছে। শিক্ষক সমাজের জন্য রচিত হয়েছে কলঙ্কময় অধ্যায়। যুগে যুগে চলে আসা শিক্ষকের সম্মানের সম্মানে আঘাতে হেনেছে ওই নারায়ণগঞ্জের ঘটনা না। যা একুশ শতাব্দীর সভ্য সমাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
শিক্ষাই জাতির মেরুদ-। আর এই মেরুদ- দ-ায়মান রাখার কাজটি শিক্ষকরাই করে থাকেন। মহান আল্লাহই তাঁদের মর্যাদার মুকুট পরিয়েছেন। আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা জ্ঞান অর্জন করো এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য আদব-শিষ্টাচার শেখো। তাঁকে সম্মান করো, যার থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন করো’ (আল-মু’জামুল আউসাত : ৬১৮৪)। প্রিয় নবী (সা.) ছিলেন সর্বোত্তকৃষ্ট শিক্ষক, যার ঘোষণা তিনি নিজেই দিয়েছেন : ‘নিশ্চয়ই আমাকে শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে।’ (ইবনে মাজাহ : হা. ২২৯)।
ইতিহাস বলে, যুগে যুগে অতি অত্যাচারী শাসকও নত শিরে গুরুর সামনে দাঁড়িয়েছেন। গুরুকে অসম্মানের ধৃষ্টতা কেউ দেখাননি। চাণক্য শ্লোকে আছে, ‘এক অক্ষরদাতা গুরুকেও গুরু বলিয়া মান্য করিবে। এক অক্ষরদাতা গুরুকে যে গুরু বলিয়া মান্য করে না, সে শতবার কুকুরের যোনীতে জন্মগ্রহণ করে চ-ালত্ব লাভ করিবে।’
শিক্ষকের সম্মান রক্ষায় নানা নজির ইতিহাসের পাতায় দেখা যায়। সব সময়ই শিক্ষকরা সম্মানের আসনে আসীন। কবি কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতায় ফুটে উঠেছে শিক্ষকদের সম্মান কত বড়। সে কবিতার মূল কথা বিষয় ছিল এমন- বাদশাহ আলমগীরের ছেলেকে দিল্লীর এক মৌলভী পড়াতেন। একদিন সকালে বাদশাহ দেখেন বাদশাহর ছেলে মৌলভী সাহেবের পায়ে পানি ঢালছে আর মৌলভী নিজ হাতে পায়ের ধুলা পরিষ্কার করছেন। শিক্ষক মৌলভী খুব ভয় পেয়ে গেলেন। বাদশাহের পুত্রকে দিয়ে পানি ঢালার অপরাধে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন। অবশেষে নিজেকে নিজেই শান্তনা দিলেন এই ভেবে- “শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার।” পরদিন সকালে বাদশাহর দূত শিক্ষকে কেল্লাতে ডেকে নিয়ে গেল। বাদশাহ শিক্ষককের উদ্দশ্যে বললেন, আমার পুত্র আপনার কাছে সৌজন্য কি কিছু শিখেছে ? বরং শিখেছে বেয়াদবি আর গুরুজনে অবহেলা। বাদশাহ সেদিন সকালের ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, আমার পুত্র আপনার পায়ে পানি ঢালছে আর আপনি নিজ হাতে আপনার পা পরিষ্কার করছেন। আমার পুত্র কেন নিজ হাত দিয়ে সযতেœ আপনার পা বুলিয়ে পরিষ্কার করে দিল না? সে শিক্ষা কেন আপনি তাকে দিলেন না? নিজ ভুল বুঝতে পেরে শিক্ষক তখন উচ্ছ্বাস ভরে সগৌরবে উচ্চকন্ঠে বললেন-আজ হতে চির উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির । সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর।”
শিক্ষকদের সম্মানের স্বীকৃতিস্বরূপ ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস ঘোষণা করা হয়েছে। কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন দেশের সরকার ও সংস্থার মধ্যে বৈঠক ও মতবিনিময়ের পর জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থা ইউনেস্কো ও আইএলও কর্তৃক ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর গৃহীত ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। পরে ১৯৯৭ সালে সংযোজিত প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা স্তরে পাঠদানকারী শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের অধিকার, করণীয় ও মর্যাদা-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদের স্মারক হিসেবে দিনটি বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে বিভিন্ন দেশে পালিত হয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গেলে তাঁরই বাংলা বিভাগের শিক্ষক ড. নীলিমা ইব্রাহীমকে দূর থেকে দেখতে পেয়ে সকল প্রটোকল ভেঙে ছুটে গেলেন তাঁর কাছে এবং শিক্ষকের পা ছুঁয়ে সালাম করলেন এবং আশীর্বাদ নিলেন। সম্মানিত শিক্ষকদের মর্যাদা দিতে বঙ্গবন্ধু এভাবেই শিখিয়েছেন তাঁর সন্তানদের। বঙ্গবন্ধুও নিজেও শিক্ষকদের সম্মান দেখানো এক উজ্জ্ব দৃষ্টান্ত। সম্প্রতি শিক্ষকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের এক নজির স্থাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি শিক্ষকদের সকল দাবি মেনে নিয়ে সবার উপর তাদের সম্মানের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
কিন্তু জাতির বিবেক সেই শিক্ষক মুখে আজ শুনতে হচ্ছে, তাকে নির্যাতন করার নির্মম কাহিনী। লাঞ্ছিত শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত বলছেন, এমপি সেলিম ওসমান ঘটনার দিন আমার কথা না শুনেই আমার দু’গালে থাপ্পড় মেরেছেন। তার কথায় আমি কান ধরে উঠবোস করি।’’ এর চেয়ে লজ্জ্বার আর কি হতে পারে। নারায়ণগঞ্জের ওই ঘটনা শিক্ষকদের সম্মান এবং মর্যাদাহানীর সর্বোচ্চ সীমা লঙ্ঘন। যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এ ঘটনায় যথাযথ শাস্তি না হলে যুগ যুগ ধরে চলে আসা শিক্ষকদের সম্মান ও মর্যাদা হুমকির মুখে পড়বে। ভবিষ্যতে আর কেউ যেন শিক্ষকদের সম্মানহানি করতে না পারে সে ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে।
তবে আমাদের দেশে শিক্ষকরা প্রতিনিয়ত নির্যাপন, নিপীড়নসহ নানা হয়রানির শিকার। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের হত্যা করা হয়েছিল জাতির সূর্য সন্তান বুদ্ধিজীবী শিক্ষক শ্রেণিকে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হত্যা থেমে নেই। কাজেই আমাদের মানুষ গড়ার কারিগরদেরকে রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার। তবে শিক্ষকরা এ সমাজেই অংশ। তারাও অপরাধ করতে পারেন। তারা যদি কোনো অপরাধ করেন, তার সত্যতা নিশ্চিত করে তদন্তসাপেক্ষে তার শাস্তি হবে। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের ঘটনাটি প্রমাণ করে শিক্ষক সহজ সরল, দুর্বল এবং সম্মানী লোক হওয়ায় সহজে তাদেরকে কান ধরে ওঠবস করানো যায়। শিক্ষকদের দুর্বল ভাবার কারণ নেই। তারা যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তার দায়ভার এই জাতিকেই বহন করতে হবে।
প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়