মে দিবসের ছুটিতে মেতে উঠি

                            ………………মাহফুজার রহমান মণ্ডল

ছোট বেলায় স্কুল ফাঁকি দেওয়াটা মণ্ডলের একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিলো। ওত পেতে ছিলো কখন স্কুল ছুটি হবে বা কোনদিন বন্ধ থাকবে। বন্ধ পেলেই ছুটে যেত আত্মীয়দের বাড়ি সাথে থাকতো একটা আধুনিক যুগের দিচক্রযান। আত্মীয়স্বজনদের বাড়ি বেশি দূরে ছিলো না তাই এই দিচক্রযানেই যথেষ্ট। আত্মীয়স্বজনরা এতো আপন ছিল যে কাছে গেলে চুম্বকের মত টেনে নিতো।

কিছুদিন পর একটা ছুটির নোটিশ ক্লাস-এ স্যারের হাতে এসে পৌঁছিল। এবার স্যার পড়া শুরু করলেন- শুনে যা মনে হলো এটা সাধারণ ছুটি নয়। তবে ছুটি যাইহোক, স্কুল বন্ধতো তাহলেই চলবে। আগে থেকেই রুটিন সেট করা ছিল এবারের ছুটিতে সে কোথায় যাবে তাই পরের ক্লাসগুলোতে তার মন বসলো না। কখন ছুটি হয় সেই চিন্তায় তার মাথা ঘুরপাক খাচ্ছে। পরের ক্লাসটা শেষ হতে না হতেই ছুটির ঘণ্টা ঢং ঢং করে বেজে উঠলো। বন্ধু-বান্ধবসহ হই-হুল্লা করে সে বাড়ি পৌঁছিল।

এবার নানা বাড়ি যাবে বলে বায়না ধরলো মায়ের কাছে। সহজে কি আর মত পাওয়া যায় তারপরেও বাবাকে ম্যানেজ করে মায়ের সম্মতি পেয়েছে। তবে আত্মীয়স্বজনদের বাড়ি বেশি দূরে না থাকায় মত পেতে বেশি দেড়ি হয়নি। কিন্তু নানার বাড়ি যেতে একটাই সমস্যা যে একটা হাইওয়ে রোড পাড় হতে হয়। তাই বেশ কিছুক্ষণ ধরে রোডটা কিভাবে পাড় হবে তাই বুঝাচ্ছিল মা। এরপর খাওয়া-দাওয়া ও ঘুম। ঘুম কি আর সহজে ধরে তারপরেও নাম মাত্র ঘুমাতে হলো তাকে।

রাত হতে না হতেই সে জেগে উঠলো। যে মানুষ পড়া-লেখার ভয়ে জেগে উঠতেই চেত না সে এবার মনে হচ্ছে ফরজের নামাজ আদায় করবে। সকালের নাস্তা নানা বাড়িতে সেরে নিবে বলে মনস্থ করলো। প্লান দেখে মা-বাবা আগে থেকে টের পেলো কিন্তু তা কী হয় নাস্তা ছাড়া তাকে বাড়ীর গণ্ডি পাড় হতেই দিলো না। আর নাস্তা হতেতো সময়ও লাগবে, এদিকে মনটা ছটপট করতে লাগলো কখন যে যাবে। অবশেষে যাত্রা শুরু হলো সেই দিচক্রযানে করে। মা যাওয়ার সময় কিছু ফলমূল, চিড়া-মুড়ি দিলো নানা-নানির জন্য। সিটের পিছনে সেগুলো সে বেঁধে নিল। দিলচক্রযানে উঠতে না উঠতেই মা বললো বাবা রাস্তায় দেখে শুনে চালাইও।

মণ্ডল গুন গুন করে গান গাচ্ছে আর চলছে। যেই না হাইওয়ে রোডে আসলো। স্ট্যান্ডের  কিছু লোক তাকে ঘিরে ফেললো যদিও সবাই তার চেনা মুখ তারপরেও সবাই চেঁচিয়ে উঠলো ওকে ধরো ধরো। সে অবাক হয়ে তাকালো চেনা মুখগুলোর দিকে সবাই  হাসছে আর বলছে আজ আর তোমার দিচক্রযানে ঘুরে বেরানো হবে না। উত্তরে বললো কেন? একজন বললো দেখছ না আজ কোন গাড়ীর শব্দ নেই। আজ মে দিবস তাই সবকিছু বন্ধ। সঙ্গে সঙ্গে তার স্কুলের নোটিশ-এর কথা মনে পড়লো। শেষ পর্যন্ত পাশে বসে থাকা দাদু বললো –দে রে ওকে ছেড়ে দে এবার তোদের দায়িত্ব পালন কর। যেই ছাড়া পেলো এমনি দ্রুত গতিতে সে নানার বাড়ির দিকে ছুটে চললো।

যেতে যেতে চিন্তা সে করলো নিশ্চয়ই তারা কোন কমিটির লোক তা না হলে দল বেঁধে আক্রমণ করলো। যাইহোক নানা ভাইকে বলতেই হবে কেন তারা আমাকে আক্রমণ করলো আর তারা কেনই বা দল বেঁধে আছে । আর স্কুল ছুটি থাকা ভাল কিন্তু কেনই বা ১লা মে –তে মে দিবস পালিতো হয়। চিন্তা করতে করতে গন্তব্য স্থানে পৌঁছিল। বেল দিতে না দিতেই মামাতো ভাইবোনগুলো পাখির ঝাঁকের মতো বেড়িয়ে এলো। তাদের কি চিৎকার মনে হয় সে এবার প্রথম বার নানা বাড়িতে বেড়াতে এল। নানি তাকে পেয়ে গালে চুমো ভরিয়ে দিলো। নানিকে জিজ্ঞাসা করলো নানা কোথায়? প্রতিউত্তরে বাজারে গেছে দুপুর বেলা আসবে। তাই নানা বাড়িতে না থাকায় সবাইকে নিয়ে সে খেলা শুরু করল।

 ঠিক দুপুর ১২টা, সেই সময় কি আর খেলায় মনোযোগ বসে তারপরেও মামাতো ভাইবোনদের পেয়ে সে আনন্দে মেতে থাকলো। আশেপাশে সবুজ শ্যামলে ভরে গেছে নানা বাড়ি তাই গাছে উঠতে মন চায় কিন্তু কি করবে এই সময়তো ফল মুল পাকেনি। কচি কচি আম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা ইত্যাদি ফলে ভরে গেছে। এদিকে মামানিরা ডাকছে সবাই এসো গোসল কর দুপুরের খাবার খাবে। সবাই ছুটলো দীঘির দিকে লাফিয়ে লাফিয়ে পানিতে ডুব দিচ্ছে সবাই সেও সুযোগটা হাতছাড়া করলো না। গোসল সেরে আসতে না আসতেই নানার ডাক কিরে নানু কখন আসলি । এইতো নানু সকাল ১০টার দিকে । আয় আয় খাওয়া করি কি যে রান্না করেছে তোর নানি।

এবার রানু, ঝানু, রুনু, কলি সবাই একে একে খেতে বসলো। ছোট মাছ ভাজি, ডাল, শাক, আলু ভর্তা আরও কত কি। খেতে খেতে তার প্রশ্ন নানুর কাছে, নানু আজ স্কুলে ছুটির দিন বটে রাস্তায় আমার দিচক্রযানটা চালাতে দিচ্ছে না কেন? রাস্তায় যানবহন বন্ধ কেন? আর আমাদের ১লা মে –তে ছুটি দেয় কেন? এভাবে একটার পর একটা প্রশ্ন শুরু করলো নাতি আর থামতেই চাচ্ছে না। নানা নাতির দিকে তাকিয়ে বললো থাম থাম নাতি সবই বলছি তোমারা আগে খেয়ে নাও।

খাওয়ার শেষে নাতিনাতনিদের নিয়ে বিশ্রামাগারে গেল বৃদ্ধ। বিশ্রামাগারে বসতে না বসতেই শুরু করলো মে দিবসের কাহিনী- ১লা মে দিবস ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ হিসেবে ঘোষিত হয় ১৮৮৯ সালের ১৪ই জুলাই  ফ্রান্সের আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে। তবে ১৮৯০ সাল থেকে ১লা মে বিশ্বব্যাপী পালন হয়ে আসছে ‘মে দিবস’ বা ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’হিসেবে বুঝলি?

যদিও ১৮৯০ সাল থেকে ১লা মে দিবস পালিত হয়ে আচ্ছে, এর পিছনে আছে অনেক ত্যাগ, আন্দোলন, ধর্মঘাট, হত্যা আরও অনেক কিছু। সেই ১৮৮৬ সালের ১লা মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা উপযুক্ত মজুরি আর দৈনিক আট ঘন্টা কাজের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। মূলত তাদেরকে দৈনিক ১৬ ঘণ্টা করে কাজ করতে হতো। সপ্তাহে প্রতিদিন কাজ করে স্বাস্থ্য একেবারেই ভেঙ্গে পরেছিল। শিশু শ্রমিকও ছিল, তাদের স্বাস্থ্য ভেঙ্গে কঙ্কালসার হয়েছিলো। তাই তাদের জীবনগুলো অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো।

সেই সময় আন্দোলনরত শ্রমিকদের মিশিলে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি চালায় ফলে ১১ জন নিহিত হয়। অনেক শ্রমিকে কারাগারে প্রেরণ করা হয় এবং পরবর্তীতে তাদের মধ্যে ৬ জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়। এই আন্দোলন প্রকট আকার ধারণ করে এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পরে। পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাধ্য হয় শ্রমিকদের দাবিগুলো মেনে নিতে।

সেই সুত্র ধরে আমাদের দেশ তথা সারা বিশ্ব এই দিনটা পালন করে আচ্ছে। নাতি এবার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়েছে বলে মনে হয়। এছাড়া আরও অনেক গল্প, কিচ্ছা-কাহিনী শুনতে শুনতে দিন কেটে গেল। গোধূলি লগ্নে হাল্কা নাস্তার সাথে চায়ে মুড়ি ভিজিয়ে খেয়ে নিল মণ্ডল।  আগামিকাল স্কুল যেতে হবে তাই দেড়ি না করে সে নানা নানি তথা সবার কাছ থেকে বিদায় নিলো।     

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে