আসন্ন শিল্পী সমিতির নির্বাচন এরই মধ্যে জমে উঠেছে। প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত শিল্পীদের আসা-যাওয়ায় জমজমাট বিএফডিসি। চলছে নানা মিটিং, মিছিল ও বাদ্য বাজনার আয়োজন। এবার ইলিয়াস কাঞ্চন-নিপুণ ও মিশা-জায়েদ প্যানেল থেকে শিল্পীরা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।

সবাই সবার মতো করে প্রচারণা চালাচ্ছেন। দিচ্ছেন নানা রকম প্রতিশ্রুতি। তারমধ্যে সভাপতি প্রার্থী ইলিয়াস কাঞ্চন বলেছেন, অনুদান বা সাময়িক অর্থ সাহায্য নয়; শিল্পীরা যেন নিয়মিত কাজ করে খেতে পারে সেই ব্যবস্থা করবেন তিনি ও তার প্যানেল জয়ী হলে। সিনেমার মান ও সংখ্যা দুটোই বাড়ানোর চেষ্টা করবেন বলেও দাবি করেছেন তিনি।

একই প্রতিশ্রুতি তিনি ব্যক্ত করেছেন দেশের হল মালিকদের কাছেও। গতকাল ১৮ জানুয়ারি মঙ্গলবার বাংলাদেশ প্রদর্শক সমিতি এক প্রীতি ভোজের আয়োজন করে। সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয় ইলিয়াস কাঞ্চন-নিপুণ প্যানেলকে।

কাঞ্চনের নেতৃত্বে সেই আয়োজনে উপস্থিত হন তার প্যানেলে সহ সভাপতি প্রার্থী চিত্রনায়ক রিয়াজ, ডিএ তায়েব। ছিলেন সাংগঠনিক সম্পাদক প্রার্থী চিত্রনায়িকা শাহনুর ও কার্যকরী সদস্য প্রার্থী গাঙ্গুয়া।

অনুষ্ঠানে হল মালিক নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কাজী শোয়েব রশিদ, আওলাদ হোসেন উজ্জলসহ আরও অনেকে। উপস্থিত ছিলেন পরিচালক নেতা বদিউল আলম খোকন।

আয়োজনে ইলিয়াস কাঞ্চন নির্বাচনে আসায় তাকে অভিনন্দন জানান হল মালিক নেতারা। তারা আশা ব্যক্ত করেন, বহু কালজয়ী ও সুপারহিট সিনেমার নায়ক কাঞ্চনের শক্ত নেতৃত্বে দিশা ফিরে পাবে শিল্পী সমিতি। সামগ্রিকভাবে চলচ্চিত্র শিল্পও উপকৃত হবে।

অভিনন্দনের জবাবে ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘আমি কৃতজ্ঞ আপনারা আমাকে, আমার টিমকে ডেকেছেন। এটা ইতিবাচক। আমি বুঝতে পারছি সিনেমার ভালো হোক সেটা আমরা সবাই চাই। সেজন্যই এক হয়েছি। আমাদের ভালো কিছু পরিকল্পনা করতে হবে। একসঙ্গে কাজ করতে হবে। দিনদিন প্রযোজকরা হারিয়ে যাচ্ছে।

যাদের সঙ্গে আমি অনেক হিট সিনেমা করেছি তারা কিন্তু কেউই আর নেই। কন্টিনিউ করতে পারনেনি। আমি নিজেও প্রযোজনা করেছি। হিট সিনেমাও দিয়েছি। আমিও কিন্তু প্রযোজক হিসেবে আর কাজ করার সাহস পাচ্ছি না। কারণ সিনেমার অবস্থা। পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছি। এখন আর সেই সাহসও পাই না। ভাবি যে কার টাকাটা এনে নষ্ট করবো! হয়তো আমি অনুরোধ করলে অনেকে টাকা লগ্নি করবেন। কিন্তু তাতে লাভ কি। দর্শক তো দেখবে না বা দেখতে পারবে না।

সিনেমা অনেক কারণেই নষ্ট হয়েছে। এর প্রথম কারণ ছিল পাইরেসি। এরপর আসে অশ্লীলতা, কাটপিসের যুগ। এরপর শুরু হয় অভিভাবকহীন, নেতৃত্বহীন ইন্ডাস্ট্রির পথচলা। কষ্ট হয় এসব দেখে। ভেবেছিলাম এদিকে আর ফিরবো না। কিন্তু সিনিয়র, জুনিয়র সবাই মিলে ধরলেন যে আপনি আসুন। আপনাকে দরকার। আমি এলাম। চেষ্টা করে দেখি। এবারের চেষ্টা হবে মরণ কামড় দেয়ার মতো।’

কাঞ্চন আরও বলেন, ‘দেখুন আমরা শিল্পীরা রাজপথের মানুষ। চলচ্চিত্রের জন্য সেই পাকিস্তান আমলে আমাদের সিনিয়ররা আন্দোলন করেছেন উর্দু ভাষার সিনেমার প্রতিবাদে। সেই আনোয়ার হোসেন, রোজি সামাদ, সুমিতা দেবীরা এখন আর নেই। কিন্তু তাদের সেই আন্দোলনের ফসল কিন্তু এই চলচ্চিত্র শিল্প।

আমি নিজেও আন্দোলন করেছি। রাস্তায় মার খেয়েছি, রক্ত ঝরেছে। রাজ্জাক ভাই, আলমগীর ভাই, জসীম ভাই, শাবানা; অনেকে, প্রায় সবাই ক্যাপাসিটি ট্যাক্স নিয়ে প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নেমে রক্ত দিয়েছেন রাজপথে। সেই ফল কিন্তু পেয়েছি। আবারও যখন প্রতিকূলতা তখন মাঠে নেমেছি। আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন। আমার সহযাত্রীদের জন্য দোয়া করবেন।

দেখুন, আমার সিনিয়র অনেকেই চলে গেছেন। রাজ্জাক ভাই নেই। দুইজন অসুস্থ হয়ে আছেন। কখন কোনদিন আমিও চলে যাবো তার ঠিক নেই। আমার কিছু পাওয়ার নেই এখান থেকে। অনেক অনেক পেয়েছি। এই আমি যে মানুষটা দাঁড়িয়ে কথা বলছি সেটা এই সিনেমার জন্যই। এবার দিতে এসেছি।’

প্রতিশ্রুতি রক্ষা প্রসঙ্গে ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘আপনারা জানেন আমি একটা কথা দিলে ভেবেচিন্তে দেই। সেই কথাটা রাখার চেষ্টা করি। যেটা আমি বলি সেটা করে ছাড়ি। আপনাদেরও কথা দিলাম সিনেমার জন্য কিছু ভালো কাজ করার চেষ্টা করবো। সিনেমা যেন বাড়ে সেই চেষ্টা করবো। সিনেমা না থাকলে হল মালিকরাও থাকবেন না। তারা না থাকলে প্রযোজক, পরিচালক, শিল্পী; কিছুই থাকবে না। তাই সিনেমা যেন হয় সেটাই আমাদের মূল লক্ষ্য। সিনেমা মানে সব শ্রেণির মানুষের সিনেমা। কমার্শিয়াল সিনেমা দিয়েই হল বাঁচে। এ ধারাতেই গুরুত্ব দিতে হবে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। শৈল্পিক সিনেমাও লাগবে।

অনেকে বলছেন আমরা শিল্পী, সিনেমা বাড়ানো আমাদের কাজ নয়। এটা ভুল। নানা আন্দোলন সাক্ষী দেয় সিনেমা বাড়ানোতে এবং ইন্ডাস্ট্রি সচল রাখাতে শিল্পীদের ভূমিকা কত গুরুত্বপূর্ণ। দুজন শিল্পী দাঁড়িয়ে কথা বললে যে কজন মানুষ শুনবে সেটা অন্যদের দিয়ে হবে না। আমরা চেষ্টা করবো সকল সমিতির সঙ্গে দ্বন্দ্ব-কোন্দল দূর করে মিলেমিশে কাজ করতে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিনেমা শিল্পের প্রতি দারুণ আন্তরিক। উনার বাবার হাত ধরে এফডিসি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এজন্য হয়তো তার আবেগটা বেশি সিনেমা নিয়ে। তিনি ১ হাজার কোটি টাকা দিয়েছেন হল মালিকদের জন্য। সেই টাকা ফিরিয়ে দিয়েছেন আপনারা সিনেমা নেই বলে। সিনেমা যদি না থাকে তাহলে সুদের উপর টাকা নিয়ে কি হবে। এটা যথার্থ। আমরা দরকার হয় আবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাবো। প্রয়োজন হলে আরও টাকা বরাদ্দ দেবো। কিন্তু তার আগে একটা নিখুঁত এবং কার্যকরী পরিকল্পনা নিয়ে যাবো যেন সিনেমা উৎপাদন ও হল ব্যবসা দুটোই একসঙ্গে সচল থাকে। দোয়া চাই, নির্দেশনা চাই। যে কথা দিয়ে গেলাম সেই কথা রাখার সুযোগ চাই।’

অনুষ্ঠানে রিয়াজ তার বক্তব্যে বলেন, ‘সিনেমা মানে সিনেমা। এটা হলে চলতে হবে। সিনেমা ঘরে বসে দেখার জিনিস নয়। ফোনে দেখার জিনিস নয়। কন্টেন্ট অনেক রকম। যে কোনো প্লাটফর্মে আসতে পারে। এটা সময়ের দাবি। কিন্তু সিনেমা বলতে যে ফিলটা আসে সেটা হলেই পাওয়া যায়। আর সেই হল মালিক আপনারা আজ আমাদের ডেকেছেন আন্তরিকতা নিয়ে। আমরা আনন্দিত।

দেশের নন্দিত অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা এক হয়েছি। আমরা কোনো ভেদাভেদ চাই না। আমরা সিনেমা যেভাবে হলে ফিরে সেভাবে কাজ করতে চাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। আমাদের অনেক পরিকল্পনা রয়েছে সিনেমা নিয়ে। আগেও ছিলো। পারা যায়নি। এবার কাঞ্চন ভাইয়ের মতো মজবুত নেতা আমাদের সঙ্গে আছেন। আশা করছি পারবো। আপনারা হল মালিকরা আমাদের সঙ্গে আছেন জেনে আনন্দিত হলাম। যে কোনো বিষয়ে দিক নির্দেশনা দেবেন।’

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন বদিউল আলম খোকন, ডি এ তায়েব, গাঙ্গুয়া, শাহনূর ও হল মালিকরা। সবাই সিনেমার উন্নয়নের স্বার্থে নানা বিষয়ে আলোকপাত করেন। বিদেশি সিনেমা ও তারকাদের এড়িয়ে দেশীয় সিনেমা বৃদ্ধি এবং দেশের তারকাদের সক্রিয় রাখার ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হবে বলেও জানান তারা।

Jag/N

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে