বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ সংকট তৈরি করেছে মহামারি করোনাভাইরাস। এর থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় ভ্যাকসিন। তাই মানবজাতিকে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস থেকে বাঁচাতে ভ্যাকসিন আবিষ্কারে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানী ও গবেষকদের প্রচেষ্টায় ইতোমধ্যে করোনার বেশকিছু সম্ভাব্য ভ্যাকসিন মানবদেহে প্রয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ সফল হয়েছে। এদিকে করোনার দুটি প্রতিষেধক নিয়ে কাজ করছে ভারত। একটি তাদের নিজেদের তৈরি এবং আরেকটি ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার যৌথ উদ্যোগে তৈরি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার যৌথ উদ্যোগে তৈরি ভ্যাকসিনের পেটেন্ট নিয়ে ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট ভ্যাকসিন উৎপাদন করছে এবং এটি তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে রয়েছে।

গত ১৫ আগস্ট) ঢাকা সফরে আসেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। তিনি বলেছেন, ভারতে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি হলে বাংলাদেশ অগ্রাধিকার পাবে।

তবে ভারতে উৎপাদিত টিকা বাংলাদেশকে দেবে কি-না সেটা দেশটির নিজস্ব সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে। কিন্তু ভারতে উৎপাদিত অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন বাংলাদেশ কোন উপায় পাবে সেটা ভারতের সাথে ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের চুক্তির ওপর নির্ভর করবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি আ ফ ম রুহুল হক।

তিনি বলেন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশকে অক্সফোর্ড এই টিকা উৎপাদনের অনুমোদন দিয়েছে। অক্সফোর্ড যদি ভারতকে বিক্রির অনুমোদন দেয় তাহলে তারা বাংলাদেশের কাছে বিক্রি করবে। এটা নির্ভর করছে অক্সফোর্ডের ওই কোম্পানি এবং ভারতের মধ্যে কী দেন-দরবার হয়েছে, সেটার ওপর। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তাই ওই টিকা বাংলাদেশকে দেয়ার মতো অনুমোদন দেশটির আছে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

রুহুল হক বলেন, পররাষ্ট্র সচিবের মতো শীর্ষ পর্যায়ের নেতার কিছু বলা মানে সেটা ভারত সরকারের বক্তব্য। এতে ধারণা করা যায়, ওই টিকা সফল হলে সেটা বাংলাদেশকে দেয়ার অথরিটি তাদের আছে।

এদিকে ভারতের পাশাপাশি যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনসহ সাতটি দেশে ভ্যাকসিনের ট্রায়াল শুরু করেছে। এগুলোর পরীক্ষামূলক প্রয়োগ বাংলাদেশে শুরু করা উচিৎ বলে মত দিয়েছে করোনা প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি। সেই লক্ষ্যে টিকা উৎপাদনকারী দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য সচিব।

বাংলাদেশে কোনো টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু করা হলে কী লাভ হবে, এ বিষয়ে সরকারের ভ্যাকসিন বিষয়ক কমিটির সদস্য ডা. শামসুল হক বলেন, কোনো দেশে ভ্যাকসিন পরীক্ষার পর যদি এটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) অনুমোদন পায় তাহলে যে দেশে পরীক্ষা চালানো হয়েছে সেখানে ভ্যাকসিনের প্রয়োগ সহজ হয়ে যায়। আবার যারা এই ভ্যাকসিন উৎপাদক তারা যেসব দেশে পরীক্ষা চালায় তাদেরকে সাধারণত অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে।

চীন এর আগে মোট ৬টি দেশে তাদের তৈরি ভ্যাকসিনের তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল শুরু করে। দেশগুলো হলো- ব্রাজিল, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া, চিলি, ফিলিপাইন ও তুরস্ক। বাংলাদেশেও এই টিকার ট্রায়াল হওয়ার কথা থাকলেও স্বাস্থ্যমন্ত্রী শেষ মুহূর্তে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জানানোয় সেই প্রচেষ্টা বন্ধ হয়ে যায়। তবে জাতীয় পরামর্শক কমিটি এবং বাংলাদেশ মেডিকেল গবেষণা পরিষদ এই ট্রায়ালের অনুমোদন দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) এই ভ্যাকসিনের পরীক্ষা চালানোর প্রস্তুতিও নিয়েছিল। এরপরও সেটা বাংলাদেশে কেন পরীক্ষা করা হয়নি তা নিয়ে সমালোচনা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এর পেছনে বৈশ্বিক রাজনীতি এবং ব্যবসায়িক স্বার্থ জড়িত থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বেনজির আহমেদ।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চীন পদ্মাসেতু বা তিস্তা সেতুর অর্থায়নের শর্ত তুলে চাপ দেবে। এই ঘোষণা দেয়ার দুই দিনের মাথায় ঢাকায় হাজির হন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। তাই চীনের টিকা পরীক্ষা না করার পেছনে যে রাজনীতি নেই, ব্যবসায়িক স্বার্থ নেই এটা উড়িয়ে দেয়া যাবে না।

বেনজির আহমেদ বলেন, যখন বিশেষজ্ঞদের মতামতকে উপেক্ষা করে একজন মন্ত্রী টিকার মতো বিষয় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে সেটা কোনো বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত থাকে না, বরং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হয়ে যায়।

বাজারে আসা প্রথম ভ্যাকসিন সাধারণত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিতরণ করে থাকে। যেসব দেশের মাথাপিছু আয় কম তাদেরকে বিনামূল্যে নির্দিষ্ট সংখ্যক ভ্যাকসিন সরবরাহ করা হয়। তবে এই প্রক্রিয়া সময় সাপেক্ষ হওয়ায় বিভিন্ন দেশের সরকার ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী দেশ বা প্রতিষ্ঠানের সাথে আগে থেকেই চুক্তি করে বা অগ্রিম অর্থ দিয়ে রাখে। কিন্তু বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত কারও সঙ্গে ট্রায়ালের অংশীদার হওয়ার কোনো চুক্তি করেনি। ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পেতে অগ্রিম অর্থও দেয়নি।

এ অবস্থায় সরকারের করণীয় সম্পর্কে বেনজির আহমেদ বলেন, যখন ভ্যাকসিন বাজারে আসবে, তখন রাজনীতির খেলাগুলো বোঝা যাবে। বাংলাদেশকে সেটা হ্যান্ডেল করতে গেলে প্রচুর হোমওয়ার্ক করতে হবে। বাংলাদেশ এখনও ‘হেলথ ডিপ্লোম্যাসি’ শুরু করেনি।

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে করোনার প্রতিষেধক নিয়ে যত বক্তব্য আসছে তার সবই রাজনৈতিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাজনৈতিক কথা দিয়ে টিকার মতো বৈজ্ঞানিক বিষয়ে সফল সিদ্ধান্তে আসা যাবে না। সুতরাং এখানে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে প্রস্তুতি নিতে হবে। বাংলাদেশ যদি সংশ্লিষ্ট দেশের সাথে ভালো দেন-দরবার করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ লাভবান হবে।

কোন দেশ ভ্যাকসিন আবিষ্কারে এগিয়ে আছে, কাদের ভ্যাকসিনের মান ভালো, কার্যকরী ও দামে সাশ্রয়ী– এমন নানা বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ সরকার করোনাভাইরাসের পরীক্ষামূলক প্রয়োগের বিষয়ে চুক্তি করবে বলে জানিয়েছেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী রুহুল হক। এছাড়া অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা পাওয়ার জন্য অর্থ বরাদ্দ আছে বলেও জানান তিনি।

এদিকে বাংলাদেশের মতো বিপুল জনগোষ্ঠীর দেশে ভ্যাকসিন সরবরাহ নিশ্চিত করতে যে পরিমাণ অর্থ অগ্রিম দেয়া প্রয়োজন, সেটা দেয়ার সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বেনজির আহমেদ। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে স্বাস্থ্য অনুদানের ওপর নির্ভর করতে হতে পারে বলে জানান তিনি।

সূত্র : বিবিসি বাংলা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে