01

বিডি নীয়ালা নিউজ(৪ই মে১৬) মারুফ সরকার (বিভাগীয় প্রতিনিধিরাজশাহী): যখন নৌকায় উঠিলেন এবং নৌকা ছাড়িয়া দিল, তখন হৃদয়ের মধ্যে অত্যন্ত একটা বেদনা অনুভব করিতে লাগিলেন- সামান্য গ্রাম্য বালিকা রতনের মূখোচ্ছবি যেন বিশ্বব্যাপী বৃহৎ অব্যক্ত মর্মব্যথা প্রকাশ করিতে লাগিল। মনের ব্যকুলতা পোষ্টমাষ্টার বাবুকে আকুল করিয়া তুলিল, তিনি ভাবিলেন ফিরিয়া যাই। কিন্তু তখন পালে বাতাস লাগিয়াছে। আর ফিরিবার উপায় নাই। কিন্তু রতনের মনে কোন তত্ত্বের উদায় হইল না। সে পোষ্ট অপিস গৃহের চারিদিকে কেবল অশ্রুজলে ভাসিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। তাঁর মনে ক্ষীণ আশা দাদাবাবু যদি কখনও ফিরিয়ে আসে’।

হ্যাঁ! ঊনবিংশ শতাব্দির বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে ও বিশ্বের জ্ঞান পরিমন্ডলে ‘ভারস্যাটাইল জিনিয়াস’ খ্যাত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালজয়ী ছোট গল্প ‘পোষ্টমাষ্টার’-এর রতন চরিত্রটি শাহজাদপুরের আদিবাসী ‘বাগদী’ পরিবারে কোন এক তরুণীকে ঘিরেই আবর্তিত বলে শাহজাদপুরের আদিবাসী বাগদী পরিবারগুলো জানিয়েছেন।

কবিগুরু’র সেই পালকি বাহক এবং রতনের উত্তরসূরী শাহজাদপুরের আদিবাসী বাগদী পরিবারের সদস্যদের বর্তমানে চির অবহেলিত, চির পতিত, চির অপাঙক্তেয় যাদের বুক ফোটেতো মুখ ফোটেনা, যাদের বিচারের রায় নীরবে নিভৃতে কাঁদে-এমন চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। বর্তমানে পালকি বাহনের পেশা প্রায় বিলুপ্ত হওয়ায় ওই আদিবাসী বাগদী পরিবারগুলোর প্রতিটি দিন কাটছে অতিকষ্টে।

ওই আদিবাসী বাগদী পরিবারগুলোর অনেকেই পালকি বাহনের পেশা পরিত্যাগ করে স্বল্প আয়ের বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হওয়ায় তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে জীবনজীবিকার প্রশ্নে চরম অনিশ্চয়তা ও কালো মেঘের ঘনঘটা নেমে আসায় তাদের মানবেতর দিনাতিপাত করতে হচ্ছে।

ওদের মতো অসহায় হতভাগা আদিবাসী বাগদী পরিবারের প্রতি সমাজ পতিদের যেন অবহেলার শেষ নেই। অবর্ননীয় দুঃখ কষ্ট বুকে লালন ও ধারণ করে ওদের দু’একজন এখনো ঐহিত্যবাহী পালকি বাহনের পেশা ধরে রেখেছে।

গতকাল মঙ্গলবার সন্ধায় সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলা পৌরসদরের মণিরামপুর বাজার সংলগ্ন কবিগুরুর  শাহজাদপুরের কাছারিবাড়ি প্রাঙ্গনের কয়েক’শ গজ পূর্বদিকে অবস্থিত আদিবাসী বাগদী পল্লী পরিদর্শনকালে স্বর্গীয় রতন বাগদীর পুত্র শ্রীপদ বাগদী (৬৫),স্বর্গীয় জোতিন বাগদীর ছেলে মনো বাগদী (৬৫) ও স্বর্গীয় জলধর বাগদীর ছেলে সুনীল বাগদী জানান শাহজাদপুর জমিদারী একদা নাটোরের রানী ভবানীর জমিদারীর অংশ ছিল।

১৮৪০ সালে শাহজাদপুরের জমিদারী নিলামে উঠলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর মাত্র তের টাকা দশ আনায় এই জমিদারী কিনে নেন। জমিদারীর সাথে সাথে শাহজাদপুরের কাছারিবাড়িটিও ঠাকুর পরিবারের হস্তগত হয়েছিল বলে ধারনা করা হয়। ১৮৯০ সালের দিকে শাহজাদপুরের জমিদারী দেখাশুনার কাজে তিনি শাহজাদপুরে এসেছিলেন। এখানে জমিদারী তদারকীর কাজে তিনি বিভিন্ন স্থানে পালকিতে চড়ে ভ্রমন করতেন।এজন্য কবিগুরু ভারতের বর্ধমান জেলা থেকে জমিদারী দেখাশুনার কাজে শাহজাদপুরের আসার সময় ৯টি আদিবাসী বাগদি পরিবারকে সাথে নিয়ে আসেন। শাহজাদপুরে এসে কবিগুরু ১৪ শতক জায়গা আদিবাসী ৯টি পরিবারগুলোর বসবাসের জন্য দান করেন।

এসময় শাহজাদপুরের বর্তমান আদিবাসী বাগদীদের উত্তরসূরী স্বর্গীয় শশীনাথ বাগদী,অটোল বাগদী,কেদারনাথ বাগদী ও মুরালী বাগদীসহ ওই ৯টি পরিবারের আদিবাসী বাগদীরা করিগুরুকে পালকিতে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেতেন। স্থানীয় আদিবাসী বাগদী পরিবারগুলো আরও জানায়,কবিগুরুর দানকৃত মাত্র ১৪ শতক জমিতে গন্ধময়,স্যাঁতসেঁতে এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ৪৫টি বাগদি পরিবারে প্রায় ২২৫ জন সদস্য মানবেতর অবস্থায় বসবাস করছে। এই বাগদি পরিবারগুলোর ঘনবসতির ঘনত্ব এতটাই বেশী যে একটি ঘরের পাশ দিয়ে একজন হেটে চলাই কষ্টকর। চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যে চাপাচাপি করে বসবাস করলেও ওই আদিবাসী বাগদীদের মূল পেশা পালকি বাহনের তেমন একটা কাজ না থাকায় অধিকাংশ সময় তাদের বসেই থাকতে হয়। ফলশ্রুতিতে ৪৫টি পরিবারের প্রায় ২২৫ জন সদস্যের মাত্র হাতেগোনা দু’একজন ছাড়া আবশিষ্ট সবাই শহর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন,রিক্সা চালনা বা স্বল্প আয়ের বিভিন্ন কাজে শ্রম দিয়ে কোনমতে খেয়ে না খেয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর দিনযাপন করছে। ওইসব ভাগ্যবিড়ম্বিত আদিবাসী বাগদী পরিবারগুলোর কোন খোঁজ খবর নেয়না কেউ। কেবল ভোটের সময়ই ওদের মতো অভাগাদের কাছে ভোট প্রাপ্তির আশায় ধর্ণা দেন সমাজপতিরা বলে তারা জানিয়েছেন। এলাকাবাসী জানায়, হরিজন সম্প্রদায়ের আধা যাযাবর এই বাগদী পরিবারগুলোর আদি নিবাস ছিল ভারতের বর্ধমান জেলায়। ঝিনুক থেকে মুক্তা সংগ্রহ, চুন তৈরি এবং কুলির কাজ করাই ছিল এদের প্রধান পেশা।

১৮৯০ সালের ২০ জানুয়ারী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারি দেখাশোনার কাজে শাহজাদপুরে আসেন। এ সময় তাঁর সাথে পরিচিত ঘটে হরিজন সম্প্রদায়ের ওই আদিবাসী বাগদীদের। আদিবাসী বাগদীদের সরলতা আর স্বকীয়তা বোধ কবিকে প্রভাবিত করে। এক সময় এদের ৯টি পরিবারকে কবি তাঁর পালকি বাহকের কাজ দেন। এসময় কবিগুরু ৪/৫টি বাগদী পরিবারকে ৩ বিঘা ১৩ শতক জমি বন্দোবস্ত দেন। স্থানীয় আদিবাসী বাগদী পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য অভিযোগ করে বলেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাদেরকে ৩ বিঘা ১৩ শতক জমি বন্দোবস্ত দিলেও বর্তমানে তারা শুধু মাত্র ১৪ শতক জমি ভোগ দখল করছে। অতি স্বল্প পরিসরের ওই জায়গায় অপেক্ষাকৃত অনেক বেশী আদিবাসী বাগদীদের বসবাসই অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছে। বিভিন্ন সময়ে সরকারি প্রয়োজনে তাদের ৩ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।ফলে দিন দিন তাদের পরিবারের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও মাত্র ১৪ শতক জায়গার ওপর ঠাসাঠাসি করে বর্তমানে তারা বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখায় নানাভাবে উঠে এসেছে শ্রমজীবী এই আদিবাসী বাগদী পরিবারের কথা।

কবিগুরু’র বিখ্যাত ছোট গল্প পোষ্টমাষ্টারের রতন চরিত্রটি শাহজাদপুরের বাগদি পরিবারে কোন এক তরুণীকে ঘিরেই আবর্তিত বলে আদিবাসী বাগদি পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে দাবী করা হয়। তবে রতন নামটি হয়তো বা ছিল কাল্পনিক।

সাবেক অধ্যক্ষ নূরুল ইসলাম জানান, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আদিবাসী বাগদী পরিবারগুলোর অত্যন্ত নিবিড় সম্পর্ক ছিল এরাও ইতিহাসের সাক্ষী। যে কারনে শুধু রাষ্ট্র কিংবা সরকারের নয়,আপামর জনতার  উচিৎ এই পরিবারগুলোর অমানবিক অবস্থা হতে রক্ষা করা,ওদের পাশে সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেওয়া।

শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীম আহমেদ বলেন, আদিবাসী বাগদী পরিবারগুলোকে বিশ্বকবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর শাহজাদপুরে ঠাই দিয়েছিলেন। এই পরিবারগুলো এখন ইতিহাসের অংশ । এখন তারা দুঃখ দূর্দশার মধ্যে দিনাতিপাত করছে, তাদের পূনর্বাসন করা প্রয়োজন । এ বিষয়ে তিনি উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানাবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে