ডেস্ক রিপোর্ট- দেখতে দেখতে শেষ হয়ে এল ২০১৬ সাল। একবিংশ শতাব্দীর এই বছরটি অনেক ঘটনাবহুল ছিল। আলোচিত ঘটনাবলীর মধ্যে চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর, প্রধানমন্ত্রীর বিমান দুর্ঘনা, রূপপুরের পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয়েছে এবছরই। এবছরের আলোচিত ঘটনার মধ্যে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রও রয়েছে। রামপালের কাজও শুরু হয়েছে এ বছরে, এ নিয়ে পরিবেশবাদীরা অনেক আন্দোলন করেছে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এবছরেই নৌবহরে যুক্ত হয়েছে চীনের তৈরি দুটি সাবমেরিন। আলোচিত ঘটনার মধ্যে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যু। মিয়ানমার সরকার কর্তৃক রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের ফলে তারা স্রোতের মত বাংলাদেশের দিকে ধাবিত হয়েছিল। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বাধা দেওয়া হলেও অনেক রোহিঙ্গা এ দেশে প্রবেশ করে।

আলোচিত ঘটনার মধ্যে রয়েছে সীমান্ত হত্যার মত ঘটনাও। তবে গত বছরের তুলনায় এবছর সীমান্ত হত্যা বেড়েছে। এবছর সীমান্ত হত্যা হয়েছে ৪৫ টি, আগের বছর যা ছিল ৩৩।

হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা

গত ১ জুলাই গুলশানের অভিজাত রেস্টুরেন্ট হলি আর্টিজান বেকারিতে সশস্ত্র জঙ্গিদের হামলা নিঃসন্দেহে চলতি বছরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঘটনাগুলোর একটি। জঙ্গিরা ১৭ বিদেশি, দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ মোট ২২ জনকে হত্যা করে।

এই ঘটনাটি বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতার এক নতুন দিক সামনে নিয়ে আসে। আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী এই দেশে সক্রিয় কি না-সে কথা উঠে এর পর পরই। সরকার অবশ্য একে আন্তর্জাতিক জঙ্গিদের কাজ হিসেবে দেখাতে নারাজ।

এই হামলার পরদিন সকালে সেনাবাহিনী কমান্ডো অভিযান চালিয়ে হামলাকারী পাঁচজনসহ মোট ছয় জনকে হত্যা করে। এই ঘটনার পর জানা যায় দেশের উচ্চশিক্ষিত এমনকি ইংলিশ মিডিয়াম পড়ুয়া এক শ্রেণির তরুণও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে গেছে।

এরপর ২৬ জুলাই মিরপুরের কল্যাণপুর, ২৮ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়া, ২ সেপ্টেম্বর মিরপুরের রূপনগর, ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুরে, ৮ অক্টোবর গাজীপুরের পাতারটেক, টাঙ্গাইলের কাগমারী এবং আশুলিয়ার বসুন্ধরারটেক এবং সবশেষ গত ২৪ ডিসেম্বর পূর্ব আশকোনায় সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হয় মোট ২৯ জন। এদের মধ্যে সাম্প্রতিক জঙ্গি তৎপরতায় নাটের গুরু হিসেবে চিহ্নিত তামিম চৌধুরী, প্রশিক্ষক সাবেক সেনা কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম রয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার চুরি যাওয়ার ঘটনায় এখন বিশ্বজুড়ে তোলপাড় চলছে। ওই অর্থের মধ্যে শ্রীলঙ্কা থেকে দুই কোটি ডলার উদ্ধার করা হয়েছে। আর ফিলিপাইনে চলে যাওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের একটি অংশ ফেরত পেয়েছে বাংলাদেশ। তবে বড় অংশেরই হসিদ মিলছে না।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির শুরুতেই মাসেই যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভে রক্ষিত বাংলাদেশের রিজার্ভের ওই টাকা সরিয়ে নেয়া হয় সুইফট অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে। ঘটনাটি যখন ঘটে তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন আতিউর রহমান। তিনি রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি গোপন করে টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করেছিলেন। পরে সংবাদমাধ্যমে এই ঘটনাটি ফাঁস হলে আতিউর রহমান সমালোচনার মুখে পড়েন।

এই ঘটনায় সমালোচনার মুখে আতিউর রহমান গত ১৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদ থেকে পদত্যাগ করেন আতিউর রহমান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তিনি পদত্যাগপত্র জমা দেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদ ছাড়ার পর আতিউর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তার শিক্ষকতার পেশায় ফিরে যান।

ফেডারেল রিজার্ভ থেকে চুরি হওয়া টাকার মধ্যে শ্রীলঙ্কায় পাচার হওয়া দুই কোটি ডলার একটি বাণিজ্যির ব্যাংক থেকে ছাড় করার আগেই ধরা পড়ে যায়। পরে পুরো টাকা উদ্ধার হয়। আর বাকি আট কোটি ১০ লাখ ডলার পাচার করা হয় ফিলিপাইনের বাণিজ্যিক ব্যাংক রিজাল-এ। এই টাকা ব্যাংক থেকে ছাড় করিয়ে জুয়া আড্ডায় নিয়ে যাওয়া হয়। এই ঘটনায় একজন ক্যাসিনো ব্যবসায়ী ফিলিপাইন সরকারকে বাংলাদেশি মুদ্রায় ১২০ কোটি টাকা ফেরত দেন। গত নভেম্বরের শুরুতে এই টাকা ফেরত পায় বাংলাদেশ। বাকি ৫৩০ কোটি টাকা উদ্ধার এখনও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

রিজার্ভ চুরির ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তার অবহেলার জন্য এই চুরি হয়েছে।

পাশাপাশি সিআইডিও ঘটনাটির তদন্ত করছে। তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের পাঁচটি বিভাগের প্রধানসহ প্রায় ৩০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।

প্রধানমন্ত্রীর বিমান দুর্ঘটনা

এ বছরের আলোচিত ঘটনার মধ্যে ছিল প্রধানমন্ত্রীর বিমানের জরুরি অবতরণ। প্রধানমন্ত্রী হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে একটি সম্মেলনে যোগদানের জন্য যাচ্ছিলেন। ২৭ নভেম্বর সকাল ৯টা ১৪ মিনিটে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রী বহনকারী এয়ারক্রাফট (বিজি ১০১০) বোয়িং সেভেন সেভেন সেভেন- থ্রি হানড্রেড ইআর। আকাশপথে চলা অবস্থায় বিমানের ইঞ্জিনে ফুয়েল প্রেসার কমে যাওয়ায় তুর্কেমিনিস্তানের আশখাবাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে উড়োজাহাজটি। মেরামত শেষে বিমানটি কিছুক্ষণ পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন করে। চার ঘণ্টার অনির্ধারিত যাত্রাবিরতি শেষে বিমানটি হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে পৌঁছায়।

হাঙ্গেরিগামী প্রধানমন্ত্রীর বিমানের তুর্কমেনিস্তানে জরুরি অবতরণের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে যান্ত্রিক ত্রুটিকে কারণ দেখানো হলেও প্রাথমিক তদন্তে দেখা যাচ্ছে, রক্ষণাবেক্ষণে সংশ্লিষ্টদের গাফিলতিই দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। সরকার প্রধানের বিমানে এই দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে তিনটি কমিটি গঠন করা হয়, যার একটি করে বিমান।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, সেদিন উড়োজাহাজটিতে জ্বালানি বা ফুয়েলের কোনো সমস্যা ছিল না, ইঞ্জিন অয়েল বা লুব্রিকেন্টের ট্যাংকের একটি নাট ঢিলা হয়ে গিয়েছিল। সেটা ‘টাইট দেওয়ার পর সমস্যা কেটে যায়।

প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটি নয় জনের দায়িত্বে অবহেলার কারণে হয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে বিমান কর্তৃপক্ষ। তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে এবং তাদের রিমান্ডে মামলাও হয়েছে। এদের মধ্যে সাত জনকে দুই দফায় এবং দুই জনকে একবার রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের নৌবহরে সাবমেরিন

এবছরের আলোচিত ঘটনার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের নৌবহরে সাবমেরিন। চীনের তৈরি দুটি কনভেনশনাল সাবমেরিন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বহরে যুক্ত হলো। সাবমেরিনটি বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করেছে ওই দেশের সরকার, দেশে এলে যেগুলো বানৌজা ‘নবযাত্রা’ ও বানৌজা ‘জয়যাত্রা’ নামে নৌবহরে যুক্ত হয়েছে। দালিয়ান প্রদেশের লিয়াওনান শিপইয়ার্ডে সোমবার এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদের কাছে চীনের রিয়ার অ্যাডমিরাল লিউ জি ঝু সাবমেরিন দুইটি হস্তান্তর করেন।

আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ৭৬ মিটার এগুলো দৈর্ঘ্য ও ৭.৬ মিটার প্রস্থের ডিজেল ইলেকট্রিক সাবমেরিন দুটি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য তৈরি করা। সাবমেরিনগুলো টর্পেডো ও মাইন দ্বারা সুসজ্জিত, যা শত্রুপক্ষের যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিনে আক্রমণ করতে সক্ষম। সাবমেরিন দুটি বাংলাদেশে আনতে দুই দেশের নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ও নাবিকদের যৌথ তত্ত্বাবধানে বাস্তব প্রশিক্ষণ ও ‘সি ট্রায়াল’ সফলভাবে শেষ করে নিয়ে আসা হয়।

নির্যাতিত রোহিঙ্গার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ

এ বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনার মধ্যে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে মুসলিম রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনা অন্যতম। মিয়ানমার সেনাবাহীনী রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলোতে ১২শরও বেশি ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। এতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করার চেষ্টা করে। দুই মাসের মধ্যে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় ২১ হাজার ৯০০ জন।

শরণার্থীরা যাতে বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে, সেজন্যে সীমান্ত বরাবার বাংলাদেশ তাদের নিরাপত্তা জোরদার করে। অনেক শরণার্থীকে বাংলাদেশ আবার মিয়ানমারে ফেরত পাঠায়। কিন্তু এসব সত্ত্বেও কয়েক হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী যে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে, সেকথা স্বীকার করেছে বাংলাদেশ সরকারও।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এ বিষয়ে বিশ্বনেতাদের আরও সোচ্চার হওয়া উচিত ছিল। মিয়ানমারে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে এসে বাংলাদেশে কেউ ঠাঁই পাবে না বলেও সতর্ক করে দেন প্রধানমন্ত্রী।

রূপপুরের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন

দেশের আলোচিত ঘটনাগুলির মধ্যে রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চুক্তি সই হয়েছে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে। এটি এ বছর জুড়েই বিভিন্ন কারণে আলোচিত হয়ে ওঠে। গত ৬ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় এই প্রকল্পটি চূড়ান্ত অনুমোদন পায়।

পাবনার রূপপুরে দেশের আলোচিত এ বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য রাশিয়ান ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয় এক্সপোর্টের সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশের পরমাণু শক্তি কমিশন।

বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ১২০০ মেগাওয়াটের দুইটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে মোট ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করবে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ব্যয় ধারা হয়েছে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার যা বাংলদেশি টাকায় এক লাখ এক হাজার দুইশত কোটি টাকা।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের তেজস্ক্রিয় জ্বালানি বর্জ্য রাশিয়া ফেরত নেবে না এবং তা পরিবেশের ক্ষতি করবে এই দাবি তুলে দেশের পরিবেশবিদরা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাতিলের দাবি করে আসছে। তাদের সাথে সংহতি জানিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকেরা। একই সঙ্গে বিদ্যুৎকেন্দ্র-সংক্রান্ত চুক্তি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন তারা।

অন্যদিকে অ্যাটমস্ট্রয়ের নকশায় পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্বলিত ‘সর্বাধুনিক তৃতীয় প্রজন্মের প্রযুক্তি’ দিয়ে রূপপুরে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে জানিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এর নিরাপত্তা নিয়ে ‘দুশ্চিন্তার কিছু’ থাকবে না। চুক্তি অনুযায়ী, এই কেন্দ্রের তেজস্ক্রিয় বর্জ্য রাশিয়াই ফেরত নিয়ে যাবে।

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে চুক্তি সই

বছরের আরেকটি আলোচিত ঘটনা পরিবেশবাদীদের বাধার মুখে ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বাগেরহাটের রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করছে সরকার। রামপালে তাপ বিদ্যুতকেন্দ্রটি যে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি করবে না, তার ‘প্রমাণ’ দিয়ে এই প্রকল্প সরানোর দাবি প্রত্যাখান করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

গত ১২ ডিসেম্বর রাজধানীতে এই বিদ্যুৎপ্রকল্প নির্মাণে চুক্তি সই হয় বাংলাদেশ ও ভারতের দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে। ১ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলারে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করবে ভারত হেভি ইলেকট্রিক্যালস লিমিটেড (বিএইচইএল)।

অন্যদিকে এই বিদ্যুতকেন্দ্রের বিরোধিতা করে একদল পরিবেশবাদী এবং বাম দলের পর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলন করে এই প্রকল্পের বিরোধিতা করেন। তাদের দাবি রামপালে যে বিদ্যুতকেন্দ্র হচ্ছে, তা বিশ্ব ঐতিহ‌্য সুন্দরবনের পরিবেশ ও প্রতিবেশ হুমকিতে ঠেলে দেবে দাবি করে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে বাম দলগুলো। তেল-গ‌্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির পর সুন্দরবন রক্ষা কমিটির ব্যানারে আরেকটি নাগরিক কমিটি আন্দোলন করছে। তারা বলছে, কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রভাবে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রতিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে।

নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা বছরের আলোচিত ঘটনা। সাম্প্রদায়িক উসকানি চালিয়ে হিন্দুদের ঘরবাড়িতে হামলা চালানো হয়েছে। গত ২৮ অক্টোবর নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামের এক যুবকের ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একটি ছবি পোস্ট করা হয় যা মুসলমানদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত করে বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনার পর স্থানীয়রা ওই যুবককে ধরে পুলিশে সোপর্দ করে।

খবর ছড়িয়ে পড়লে ৩০ অক্টোবর সকাল থেকে নাসিরনগর উপজেলা সদরের কলেজ মোড় এবং খেলার মাঠে একাধিক ধর্মীয় সংগঠনের নেতারা জড়ো হয়ে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। সমাবেশ চলাকালে হঠাৎ তিন থেকে চারশ লোক সংঘবদ্ধ হয়ে হিন্দু পরিবারগুলোর ওপর চড়াও হয়। এসময় পুরো উপজেলা সদরের হিন্দু সম্প্রদায়ের শতাধিক পরিবার এবং তাদের ১৫টি মন্দিরে ভাংচুর এবং অন্তত দেড়শ বাড়িঘরে হামলা লুটপাট চালানো হয়।

ওই ঘটনায় হামলাকারীদের থামাতে পুলিশ, প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। পরে রাতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পক্ষ থেকে কাজল দত্ত এবং নির্মল চৌধুরী বাদী হয়ে দুটি মামলা করেন। এসব মামলায় অজ্ঞাত ১২শ জনকে আসামি করা হয়েছে।

গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের ওপর হামলা

গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারে জমি নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা ছিল বছরের আলোচিত ঘটনা। পাকিস্তান আমলে গোবিন্দগঞ্জের চিনিকলের ইক্ষু চাষের জন্য সাঁওতাল এবং স্থানীয় কিছু বাঙালিদের এক হাজার ৮৪২ একর জমি অধিগ্রহণ করে সরকার। অধিগ্রহণের চুক্তিতে বলা হয়েছিল, এই জমিতে ইক্ষু চাষ না হয় তবে প্রকৃত মালিকদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে।

২০০৪ সালে চিনি কল বন্ধ হয়ে গেলে সাঁওতালরা তাদের বাপদাদার জমি ফেরত চেয়ে আন্দোলনে নামে। আন্দোলনের একপর্যায়ে তাঁরা গত ১ জুলাই প্রায় ১০০ একর জমি দখলে নিয়ে একচালা ঘর নির্মাণ করেন। মিল কর্তৃপক্ষ এবং প্রশাসনের যোগশাজসে ৬ নভেম্বর পুলিশ ও ইক্ষু শ্রমিকদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষ। এতে তিন সাঁওতালের নিহত এবং পুলিশসহ ৩০ জন আহত হন। এ ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে একটি ও সাঁওতালদের পক্ষ থেকে দুটি মামলা করা হয়। এ পর্যন্ত পুলিশ ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে রংপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষ ১৯৬২ সালে আখ চাষের জন্য সাহেবগঞ্জ এলাকায় সাঁওতাল সম্প্রদায়ের কাছ থেকে এক হাজার ৮৪২ একর জমি অধিগ্রহণ করে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে আখ চাষ না করে মিল কর্তৃপক্ষ স্থানীয় কিছু প্রভাবশালীর কাছে জমি ইজারা প্রদান করে। তারা লিজ নেয়ার পর ওইসব জমিতে তামাক, ধান, শাক-সবজিসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ করতে থাকে। এ ছাড়া প্রভাবশালীরা এসব জমিতে ১২টি পুকুর খনন করে মাছ চাষ করছে। এদিকে মিলের জমিতে আখ চাষ না হওয়ায় দুই বছর আগে বাপ-দাদার জমি ফেরত দেয়ার কথা বলে প্রভাবশালী নেতারা সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকজনকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করে।

চিনিকলের জমি নিয়ে এ বছর কয়েক দফা স্থানীয় সাঁওতালদের সঙ্গে ছোটখাটো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। গত দুই বছর আগে এসব জমি তাঁদের বাপ-দাদার দাবি করে আন্দোলনে নামেন সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকজন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে