বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কার মতো হবে না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ ঋণ পরিশোধে কখনো ডিফল্টার (খেলাপি) হয়নি, হবেও না। বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তি অনেক মজবুত।

বুধবার (৬ এপ্রিল) একাদশ জাতীয় সংসদের ১৭তম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণ দেন সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সভাপতিত্ব করেন।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের আগে বিরোধী দলের উপনেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের তার সমাপনী বক্তব্যে শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক পরিস্থিতি কথা উল্লেখ করে আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

জি এম কাদের বলেন, কৃষি, পোশাকখাত ও রেমিটেন্স—এই তিনটির যে কোনো একটিতে কোনো সমস্যা হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কার মতো হতে পারে। শ্রীলঙ্কা ঋণ শোধ করতে পারছে না এবং ঋণ নিতে পারছে না।

এরপর প্রধানমন্ত্রী তার সমাপনী বক্তব্যে বলেন, যত ঋণ নেওয়া হয়, সময়মতো পরিশোধ করা হয়। বাংলাদেশ কখনও ডিফল্টার হয়নি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি অনেক মজবুত।

সংবিধানের ৭০ ধারা নিয়ে জি এম কাদেরের বক্তব্যের সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য হলো এমন একটি দলের কাছ থেকে সংবিধানের বিষয় শুনতে হচ্ছে, যে দলটি ক্ষমতায় এসেছিলো সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দলের মধ্য দিয়ে, মার্শল ল’ জারি করে। মার্শাল ল’র মাধ্যমে যাদের জন্ম, যার নেতা ক্ষমতাই দখল করেছিলেন তখনকার রাষ্ট্রপতিকে বিদায় দিয়ে। সেনাপ্রধান হয়ে গেলেন রাষ্ট্রপ্রধান। তার কাছ থেকে আজকে আমাদের সংবিধান শিখতে হচ্ছে। অসাংবিধানিকভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করে, সেনা আইন লঙ্ঘন করে, আর্মি রুলস লঙ্ঘন করে তার কাছ থেকে সংবিধানের কথা শুনতে হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা বিষয় আমি বলতে চাই, হ্যাঁ একে তো করোনা তার ওপর ইউক্রেনের যুদ্ধ। টেলিভিশনের মাধ্যমে আমি ইউরোপের নিউজ দেখছিলাম। সমস্ত ইউরোপে সাড়ে সাত ভাগের ওপরে ইনফ্লেশন। সেখানে বাংলাদেশে ৬ ভাগের নিচে আছে ইনফ্লেশন। আমাদের মাথাপিছু আয়ও যেমন বেড়েছে, সাথে দ্রব্যমূল্যও বেড়েছে, এটা হলো বাস্তব। একটা হচ্ছে করোনার ধাক্কা, আরেকটা হচ্ছে যুদ্ধের ধাক্কা। কিন্তু করোনার ধাক্কার মধ্যেও কিন্তু আমরা আমাদের প্রবৃদ্ধি ৬.৯৪ ভাগ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি, গড়ে ৬.৩ ভাগ। মাথাপিছু আয় সেটাও কিন্তু ঠিকই আমাদের বৃদ্ধি পেয়ে ২ হাজার ৫৯১ মার্কিন ডলার। জিনিসের দাম বাড়লেও মানুষের আয় কিন্তু বেড়েছেক। দারিদ্র্যসীমাও হ্রাস পেয়েছে। এখন দেখা যায় দারিদ্র্যসীমা বাড়েনি, সেটা বরং কমেছে। হ্যাঁ, মধ্যবৃত্ত বা করোনার সময় অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়েছে। আমরা কিন্তু বিশেষ প্রণোদনার মাধ্যমে কৃষক, শ্রমিক বা মেহনতি মানুষ বা মধ্যবিত্ত, সাধারণ মানুষ সবাইকে দুই হাতে পয়সা দিয়েছি, প্রণোদনা দিয়েছি এবং এগুলো যাতে সচল থাকে তার ব্যবস্থাও নিয়েছি। সেদিকে আমরা যথেষ্ট সতর্ক আছি যেন মানুষ কষ্ট না পায়।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিরোধী দলের উপনেতা যেটা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন শ্রীলঙ্কার বিষয়টা, এটা বাস্তব। তবে একটা বিষয় আমরা বলতে চাই যে, আমরা সরকার গঠন করার পর থেকে এ পর্যন্ত আমাদের উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমরা যত ঋণ নিয়েছি, ঋণটা আমরা সময় মতো পরিশোধ করে থাকি। বাংলাদেশ একটি দেশ, যে দেশটি কোনদিন ঋণ পরিশোধে ডিফল্টার হয়নি, হবেও না। সেদিক থেকে আমাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি অনেক মজবুত। সেটা আমি বলে রাখতে চাই। আমরা অত্যন্ত সচেতন।

তিনি বলেন, আমি আরও একটি কথা বলতে চাই—বিরোধী দলের নেতা, বিএনপি, জাতীয় পার্টি এরা যখন ক্ষমতায ছিল, বিদেশ থেকে যখন জিনিস কিনত তখন ১০ টাকার জিনিস ২০ টাকা দিয়ে কিনে বাকি ১০ টাকা পকেটে ঢোকাতো, কমিশন খেতো। কোনোটার দাম যদি ১৩০ মিলিয়ন হতো, সেটাকে ১৫০ করে বিশ মিলিয়ন পকেটে নিতো। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সেটা হয় না, বরং আমরা দাম কমিয়ে আনি। দাম কমিয়ে আমরা ক্রয় করি। দ্বিতীয় হচ্ছে সময়মতো প্রজেক্ট শেষ করা হয়। এই কয়েক দিন আগে পায়রাতে আমরা এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্লান্ট উদ্বোধন করলাম। আট মাস আগে এটার কাজ শেষ হয়েছে এবং আমাদের প্রায় ৮০০ কোটি টাকার মতো সেখান থেকে বেঁচে গেছে। আমরা প্রত্যেকটা কাজ আগে করি, কিছু টাকা বাঁচাই। গ্যাসের ৬টা কূপ, সেখানে বালু দেখা গেছে, গ্যাস তোলা বন্ধ। তারপরও আমরা কোনো মতে চালু করে রেখেছি, একেবারে বন্ধ হতে দেইনি। অন্য সময় হলে এর সবগুলো বন্ধ হয়ে যেতো। চারটা মোটামুটি সংস্কার করা হয়ে গেছে, দুটো বাকি আছে, সেটাও হয়ে যাবে। এই সমস্যা থাকবে না। তবে এলএনজি আমরা আমদানি করছি।

সরকারপ্রধান বলেন, করোনার কারণে সারা বিশ্বব্যাপী জিনিসের দাম যেমন বেড়েছে তাতে রড, সিমেন্ট প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়েছে। শুধু আমাদের দেশে না সব দেশেই। এখন আবার নতুন করে প্রত্যেকটি জিনিসের দাম বেড়েছে। শুধু এখানেই নয়, শুনলাম আমেরিকায় অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। একটু আন্তর্জাতিক নিউজগুলো দেখলে এটা দেখতে পাবেন। সেখানে কী ভোগান্তি, এক ডলারের তেল সেখানে চার ডলার হয়ে যাচ্ছে, আমেরিকার মতো জায়গায়। আমাদের এখানে তো জিনিসের দামে তার ধাক্কা আসবেই। এখানে যে জিনিস আমদানি করতে হয়, জাহাজের ভাড়া অতিরিক্ত বেড়ে গেছে। এগুলির তো একটা অবস্থা আছেই, তারপরও আমরা চেষ্টা করছি। মোটা চালের দাম এখন ৪৬ টাকার মতো আছে। চিকন চাল বা মাঝারি চাল কিছুটা বেড়েছে। আলু পাইকারি বাজারে এখন ২৫ টাকায় প্রতি কেজি পাওয়া যাচ্ছে, খুচরা বাজারে ২০ টাকা। বরং এখন আলু আর পেঁয়াজের দামের জন্য কৃষক হাহাকার করে। আমি আজকের কথা বলছি, কারওয়ানবাজারে যান কারওয়ানবাজারের কথা এখানে বলা হচ্ছে। মফস্বলে পেঁয়াজ ২০ টাকা কেজি। বেগুনের দাম হঠাৎ ১১০ টাকার উপরে হয়ে গেলো, সেটা এখন কমে ৮০ টাকায় এসেছে। বেগুনি না খেয়ে আরও যে সবজি সহজলভ্য আছে, সেটা দিয়ে খেলেই হয়। আমরা তাই খাই, মিষ্টি কুমড়া দিয়েও ভালো বেগুনি বানানো, যায় সেভাবে আমরা করি, করা যায়।

যানজট প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষের আর্থিক সক্ষমতা বেড়েছে, গাড়ি ব্যবহার করা হচ্ছে। অতিরিক্ত গাড়ি এখন রাস্তায় চলে। সবাই যদি ট্রাফিক রুল মেনে চলে আর গাড়ি যদি কম বের করে তাহলে আর যানজট হয় না। গাড়িতে চলবেন, এক-একটা পরিবারে দুই খানা তিন খানা গাড়ি চালাবেন আবার ট্রাফিক জ্যাম হলে বলবেন। গাড়িতে চড়বেন না, ট্রাফিক জ্যাম হবে না, এটা হলো বাস্তবতা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, এত কিছুর মধ্যেও আমরা অর্থনীতিকে যথেষ্ঠ শক্তিশালী করে রেখেছি। বাংলাদেশ এখনও বিশ্বের ৩১তম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ হিসেবে টিকে আছে। নির্বাচন কমিশনের জন্য আইনও করে দিয়েছি। নির্বাচন যাতে সুষ্ঠুভাবে হয়, সে ব্যবস্থাও করেছি। সংবিধানে মানুষের অধিকারের কথা স্পষ্টভাবে বলা আছে, এটা নিয়ে খুব বেশি আলোচনা না। আর ৭০ অনুচ্ছেদ আছে বলেই রাজনীতিতে একটা স্থিতিশীলতা আছে, ভারসাম্য আছে। এখন অন্য পন্থায় যারা ক্ষমতা দখল করতে চায়, তাদের অনেক সময়ই ওই ৭০ অনুচ্ছেদ, সেটা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সংবিধানে এটা দেওয়া আছে, অবৈধভাবে কেউ যদি ক্ষমতা দখল করে তাদের ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট হবে। জয় বাংলা স্লোগান নিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বাংলাদেশের যে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে, সেই অগ্রযাত্রা ইনশাল্লাহ অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।

ban/N

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে