ডেস্ক রিপোর্ট- বাংলাদেশে বাংলা ছাড়াও আরো ৪০টি মাতৃভাষার সন্ধান পাওয়া গেছে। এতদিন ধরে প্রচলিত ধারণা ছিল এ ভূখণ্ডে মোট মাতৃভাষা আছে ১৫ থেকে ২৫টি। গবেষকরা এতোদিন ধরে এমন ধারণাই দিয়ে এসেছেন।

কিন্তু বিভিন্ন গবেষকদের ব্যক্তিগত গবেষণা ও অনুসন্ধানের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ধারাবাহিক গবেষণা ও অনুসন্ধানে এই তথ্য উঠে এসেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশে মাতৃভাষার মোট সংখ্যা আগের ধারণার চেয়ে ১৫টি বেশি।

বাংলানিউজকে গত রোববার (৮ জানুয়ারি) এ তথ্যটি জানান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. জীনাত ইমতিয়াজ ‌আলী।

এ প্রসঙ্গে তিনি এ-ও বলেন, বাড়তি আরো যে ১৫টি মাতৃভাষার সন্ধান পাওয়া গেছে সেগুলোরও হারিয়ে যাওয়ার বা বিলুপ্ত হবার আশঙ্কা রয়ে গেছে। এগুলোকে সংরক্ষণ করার বা টিকিয়ে রাখার উদ্যোগ না নেওয়া হলে একদিন এগুলোর অস্তিত্বই যাবে হারিয়ে।

এর আগে তিনি জানিয়েছিলেন, পাবর্ত্য চট্টগ্রামে অঞ্চলে এমন এক মাতৃভাষার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে যে ভাষায় মাত্র ২৫ জন মানুষ কথা বলেন। এ ভাষার নাম হল রেংমিট্‌চা ( RENGMITCHA)। রোববার (৮ জানুয়ারি) ‘‘রেংমিট্‌চা: বাংলাদেশে যে ভাষায় কথা বলে মাত্র ২৫ জন’’ শিরোনামে বাংলানিউজে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট গত তিন বছর ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠির ভাষার ওপর বৈজ্ঞানিক ও গবেষণা চালিয়ে মোট ৪০টি মাতৃভাষার সন্ধান পায়।

এ ভাষাগুলো হল
সাঁওতালি (Santali), মাহলে (Mahle), কোল (kol), কোরা বা কোদা (koda), মুন্দারি (Mundari), খারিয়া (Kharia), সাউরা (Saura), খাসি (khasi), কুরুখ(Kurukh), মাল্টো (Malto), তেলেগু, (Teluge), গারো/ মান্দি (Garo/Mandi), হাজং (Hajang), কোচ (Koch), লালেং/ পাত্রা (Laleng/Patra), মারমা (Marma), কোকবরক (Kokborok), খুমি (Khumi), খিয়াং (Khiyang), লুসাই (Lusai), তংচঙ্গা (Tanchangya), ম্রো (Mro), রাখাইন (Rakhain), পাংখুয়া (Pankhuya), বাউম (Bawm), রেংমিট্‌চা (Rengmitcha), চক (Chak), মণিপুরী মেইথেই (Manipuri Meithei), লিঙ্গম (Lingam), সাদরি (Sadri), মাদ্রাজি (Madraji), থর (Thar), উর্দু (Urdu), ওড়িয়া (Odia), অহমিয়া (Ahomia), মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া (Manipuri Bishnupriya), কানপুরী (Kanprui), চাকমা (Chakma), নেপালি (Nepali) এবং কন্দো (Kondo) ।

ড. জীনাত ইমতিয়াজ ‌জানান, মাতৃভাষা সম্পর্কে এ পর্যন্ত যে ধারণা ছিল তার একটি ভিন্ন চিত্র পাওয়া গেছে বাংলাদেশে। আগে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গবেষকরা বেশ কয়েকটি মাতৃভাষার সন্ধান পেয়েছিলেন। কিন্তু এতদিন পর্যন্ত কাজটিতে কোনো সমন্বয় বা ধারাবাহিকতা ছিল না। সবই করা হয়েছে বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে ব্যক্তিগত চেষ্টায়। ফলে সংখ্যা নির্ণয়ের কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। ফলে বাংলাদেশে যে ২৫টির চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক মাতৃভাষার অস্তিত্ব রয়েছে সেটা কারো গোচরে আসেনি।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এই সংখ্যা নির্ণয়ের কাজটি করেছে। এ সংখ্যার সঙ্গে দ্বিমত করার খুব একটা অবকাশ নেই।

অধ্যাপক জীনাত বলেন, বাংলাদেশে বিদ্যমান সবক’টি মাতৃভাষাকে টিকিয়ে রাখতে এবং এগুলোর বিকশিত হবার জন্য অধিকতর অনুকূল বাতাবরণ সৃষ্টির জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট সরকারের সহযোগিতায় কাজ করে যাচ্ছে। আসলে নতুনভাবে খুঁজে পাওয়া (১৫টি) ভাষাগুলোর বেশিরভাগেরই কোনো লিপি নেই। লিপি রয়েছে হাতেগোনা দু’একটির। লিপিহীন ভাষাগুলোকে আমরা ‘অক্ষরহীন ভাষা’ বলে থাকি।

মাতৃভাষার সংরক্ষণ ও মাতৃভাষাশ্রয়ী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার মধ্য দিয়ে এই ভাষাগুলোকে জীবন্ত করা যেতে পারে। দেশে যে ভাষাগুলো কেবল মৌখিক রূপের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে, যেগুলোর কোনো লিপি নেই বা লেখ্যরূপ নেই, কাঠামো বা ব্যাকরণ নেই, যেগুলোতে কোনো বই লেখা হচ্ছে না সেগুলোকে আমরা বলছি অক্ষরহীন ভাষা। এই ভাষাগুলোকে যে করেই হোক টিকিয়ে রাখতে হবে। তবে কাজটা সহজ নয়। এ কাজটা করতে হলে প্রথমেই এ ভাষাগুলোকে জীবন্ত ও সচল করতে হবে। ব্যবহারিক কাজে এগুলোর প্রয়োগ করার মধ্য দিয়ে। এর জন্য কতগুলো বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়া আছে।

প্রথম প্রক্রিয়াটি হল ঐ ভাষাগুলোকে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেওয়া। একেকটি ভাষার ভাষার ডকুমেন্টশন প্রস্তুত করা। তারপর এই ভাষাগুলোর প্রত্যেকটির ‍অভিধান তৈরি করা। সংশ্লিষ্ট ভাষায় প্রাথমিক বই লেখার জন্য লিপি লাগবে, ব্যাকরণ লাগবে। ঐ ভাষার শিক্ষকদের শিক্ষাদানের জন্য উপযুক্ত করে তুলতে হবে। এভাবেই নানান সৃজনশীল পন্থা ও বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় মধ্য দিয়ে এসব ভাষায় আবারও নতুন প্রাণসঞ্চার হবে। এরপর দেখা যাবে ধীরে ধীরে ভাষাটি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার উপযোগী হয়ে উঠতে শুরু করেছে। কম্পিউটারে ব্যবহারের উপযোগী হয়ে উঠতে শুরু করেছে।

ঐ ভাষাগুলো এখন হয়ত সমৃদ্ধ ও উন্নত নয় বা মনে হচ্ছে না, তবে উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও স্বীকৃতি পেলে এবং বিকাশের অনুকূল পরিচর্যা পেলে দিনে দিনে এগুলো উন্নত ও সমৃদ্ধ হতে থাকবে। ভবিষ্যতে এমনও হতে পারে ঐ ভাষাগুলোর কোনো একটি বিকশিত ও সমৃদ্ধ হতে হতে এমন পর্যায়ে উন্নীত হলো যে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বড় কোনো পুরস্কার বা স্বীকৃতিও পেয়ে যেতে পারে। এসব ভাষা বিকাশের চূড়ান্ত পর্যায়ে আসার পর এমন সাহিত্যেও রচিত হতে পারে, এমন জ্ঞান, মেধা, দর্শনের পরিচয় ফুটে উঠতে পারে যা অনূদিত হয়ে নোবেল পুরস্কারও জয় করে ফেলতে পারে। কেননা সম্ভাবনার তো শেষ কথা বলে কিছু নেই।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে