ডেস্ক রিপোর্ট- দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজ এলাকায় পানির জন্য হাহাকার পড়ে গেছে। তিস্তা নদীসহ ক্যানেলে দিন দিন কমছে পানি প্রবাহ। গত এক সপ্তাহ তিস্তার ডালিয়া পয়েন্টে পানি প্রবাহ ছিল ৪ হাজার কিউসেক। বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার কিউসেকে। নদীতে কোনো প্রবাহ না থাকায় পানি পরিমাপক যন্ত্রটিও প্রায় অকেজো হয়ে পড়েছে। ভারত গজলডোবা ব্যারেজ দিয়ে পানি সরিয়ে নেওয়ায় প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়ছে দেশের সবচেয়ে বড় এই সেচ প্রকল্প। পানির অভাবে খরস্রোতা তিস্তা এখন অনেকটাই মরা খাল। পায়ে হেঁটে নদী পারাপার হচ্ছে মানুষজন। এই পরিস্থিতিতে বোরো চাষাবাদ নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় পড়েছেন লাখো কৃষক।

১ লাখ ৫৪ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে তিস্তা সেচ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ শুরু হয়েছিল। শুরুতে ৮৯ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হলেও ২০১৪ সালে ভারত তিস্তার পানি একতরফা সরিয়ে নেওয়ার কারণে ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতেও সেচ দেওয়া সম্ভব হয়নি। ২০১৫ সালে প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে রেশনিং পদ্ধতিতে চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও তিস্তায় কোনো পানি না থাকার কারণে তাও সম্ভব হয়নি। তিস্তা ব্যারেজ এলাকায় দিন দিন পানি কমতে শুরু করায় কাটছাট করা হচ্ছে সেচ প্রদান কার্যক্রম। চলতি মৌসুমে নদীতে প্রয়োজনীয় পানির অভাবে তিস্তা সেচ প্রকল্পের আওতায় পানি উন্নয়ন বোর্ড আসন্ন বোরো মৌসুমে মাত্র ৮ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। ভারত পানি প্রত্যাহার না করলে তিস্তা ব্যারেজ এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে ফেব্রুয়ারি-মার্চেও প্রায় ৭ হাজার কিউসেক পানি থাকার কথা। কিন্তু গত ৩ বছরে ১শ থেকে দেড়শ কিউসেক পানি থাকছে। ফলে পানি প্রবাহের অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে শাখা নদীগুলো। উত্তরাঞ্চলের ঘাঘট, ধরলা, করতোয়া, দুধকুমার, স্বতী ঘাঘট, নীলকুমার, বাঙালি, বরাই, মানাস, ইছামতি, আলাই, কুমারীসহ প্রায় ১শটি নদ-নদী আজ মৃত প্রায়। মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে এসব নদ-নদী। নদ-নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় চারদিকে ধু-ধু বালুচরে পরিণত হয়েছে হাজার হাজার হেক্টর জমি। ফলে কমে গেছে আবাদি জমির পরিমাণও।

রিভারাইন পিপলের পরিচালক ও রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, জাতিসংঘ পানি প্রবাহ কনভেনশন অনুযায়ী নদীর পানি ভাটির দেশ পাওয়ার আইনি অধিকার তৈরি হয়েছে। সেই আইনের প্রয়োগ ঘটিয়ে হলেও তিস্তার পানি নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে এখানকার কৃষি, অর্থনীতি ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখে পতিত হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড ও তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প সূত্র জানায়, সেচ প্রকল্প এলাকায় সেচ দেওয়া ও নদীর প্রবাহ ঠিক রাখতে তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে প্রয়োজন ২০ হাজার কিউসেক পানি। শুধু সেচ প্রকল্প চালাতেই প্রবাহমাত্রা থাকা প্রয়োজন ১৪ হাজার কিউসেক ও নদীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজন চার হাজার কিউসেক পানি। কিন্তু ডিসেম্বর থেকে তিস্তায় পানি প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যায়। ভারত কর্তৃক একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্প এখন অর্থহীন হয়ে পড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে সেখানে সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার কিউসেক পানি থাকার কথা থাকলেও তা নেমে এসেছে ১ হাজার কিউসেকে। ২০০১ হতে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিস্তা সেচ প্রকল্প এলাকায় ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান করা হয়েছিল। ওই সময় এই সেচের ক্যানেলের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হত নীলফামারী, ডিমলা, জলঢাকা, কিশোরগঞ্জ, সৈয়দপুর ও রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া, তারাগঞ্জ ও দিনাজপুরের পার্বতীপুর, খানসামা, চিরিরবন্দর পর্যন্ত। কিন্তু ২০১১ সালের পর থেকে শুষ্ক মৌসুমে উজানের পানি প্রবাহ এতোটাই নেমে আসে যে ৮ থেকে ১০ হাজার হেক্টর জমির সেচ প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ভারত গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ায় বাংলাদেশের প্রকল্পটি এখন অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়েছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে