korola

বিডি নীয়ালা নিউজ(৭ই মার্চ১৬)-কৃষি প্রতিবেদনঃ করলা একটি রুচিকর ও পুষ্টিকর গ্রীষ্মকালীন সবজি। করলায় রয়েছে  প্রচুর পরিমাণে আয়রণ, যা হিমোগ্লোবিন তৈরীতে সাহায্য করে। এতে আছে যথেষ্ঠ পরিমাণে বিটা ক্যারোটিন। এই বিটা ক্যারোটিন  চোখের দৃষ্টি ভাল রাখে এবং চোখের নানা সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে। এ ছাড়া করলায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম, যা দাঁত ও হাড় ভাল রাখে। এতে রয়েছে যথেষ্ঠ পরিমাণ ভিটামিন সি, যা ত্বক ও চুল ভাল রাখে। এগুলি ছাড়াও করলায় আছে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স এবং ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, ফলিক এসিড, জিংক ও ফসফরাস। করলা পেটের পীড়া ও অন্যান্য অসুখ-বিসুখের জন্য উপকারী। করলা রক্তের শর্করার পরিমাণ হ্রাস করে, ক্যান্সার প্রতিরোধ করে, রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে এবং রক্ত পরিস্কার করার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। করলা পাতার রস দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলে এবং  নানা ধরনের আক্রমণ থেকে  সুরক্ষা প্রদান করে। করলা পাতার রস মধুর সাথে খেলে অ্যাজমা ও ব্রঙ্কাইটিসের মতো সমস্যা কমাতে সাহায্য করে।

মাটিঃ জল জমেনা এ ধরণের প্রায় সব রকমের মাটিতেই করলার চাষ করা যায়। তবে জৈব পদার্থযুক্ত দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি করলা চাষের জন্য বেশি উপযোগী।

জলবায়ুঃ বাংলাদেশের আবহাওয়া করলা চাষের জন্য উপযোগী। উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়াতে করলা ভাল জন্মে। তবে ফুল আসার সময় অত্যধিক বৃষ্টিপাতে ফল ধরা ব্যাহত হয়।

জাতঃ বাংলাদেশে করলার বেশ কয়েকটি উচ্চ ফলনশীল  জাত রয়েছে এসব জাতের মধ্যে বারি করলা-১ এবং বিএডিসির গজ করলা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া রয়েছে আরো  কয়েক  রকমের হাইব্রিড জাত। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কৃর্তক উদ্ভাবিত বারি করলা-১ একটি উচ্চ ফলনশীল জাত। এ জাতের একটি গাছে  ২০-৩০টি করলা ধরে। হেক্টর প্রতি ফলন প্রায় ৩০ টন।  বিএডিসির গজ করলা নামের রয়েছে একটি উচ্চ ফলনশীল করলার জাত।  এ জাতের একটি গাছে ১৫-২০টি ফল ধরে।  হেক্ট্ররপ্রতি ফলন প্রায় ২৫ টন।  এসব ছাড়াও  করলার আছে বেশ কয়েকটি হাইব্রিড জাত। যেমন: বুলবুলি,  টিয়া, প্যারট,  কাকলি , তাজ-৮৮, গ্রিনস্টার, গৌরব, প্রাইড-১,  প্রাইড-২,  গ্রীন রকেট, হীরক, মানিক , জয় , রাজা, প্রাচী ইত্যাদি।

 জমি তৈরীঃ ৪ থেকে ৫টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে করলার জন্য জমি তৈরী করতে হবে।

বেড ও মাদা তৈরীঃ মই দিয়ে জমি সমান করার পর ১ মিটার চওড়া করে বেড তৈরী করে তার মাঝে ৩০ সেমি চওড়া করে নালা কাটতে হবে।  জমি যতটুকু লম্বা তত টুকু লম্বা  বেড তৈরী করতে হবে।  খুব বেশি লম্বা হলে  জমি খন্ড করা যেতে পারে। করলার জন্য ১.৫ মিটার দূরে দূরে মাদা তৈরী করতে হবে। প্রতিটি মাদার সাইজ হবে দৈর্ঘ্য,ে প্রস্থে ও গভীরতায় ৩০ সেমি। বীজ বপনের ৭ থেকে ১০ দিন আগে মাদায় পচা গোবর ও  মাদার মাটির সাথে সার মিশিয়ে দিতে  হবে।

বীজের পরিমাণঃ সাধারণত প্রতি শতকে করলা চাষের জন্য ১৫ থেকে ২০ গ্রাম এবং প্রতি হেক্টরে ৩-৪ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়।

বীজ বপনের সময়ঃ করলার বীজ বপনের উপযুক্ত সময় হলো ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস। তবে আগাম ফসলের জন্য ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে  করলার বীজ বপন করা যায়।

বীজ বপনঃ করলার বীজের ত্বক শক্ত ও পুরু। তাই দ্রুত অঙ্কুরোদগমের জন্য বপনের পূর্বে ৪৮ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। প্রতিটি মাদায় ৩-৪টি করে বীজ ২ থেকে ৩ সেমি গভীরতায় বপন করে ঝুরঝুরে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। তবে মাদায় সরাসরি বীজ বপন না করে পলি ব্যাগে চারা তৈরী করে সেসব চারা মাদায় রোপণ করা যেতে পারে। এতে বীজের পরিমাণ কম লাগে এবং মাদায় গাছের প্রয়োজনীয় সংখ্যা নিশ্চিত করা যায়।

সারের পরিমাণঃ করলা চাষের জন্য জমির উর্বরতা অনুসারে হেক্টর প্রতি ৫ টন পচাগোবর / কম্পোষ্ট, ১২৫-১৫০ কেজি ইউরিয়া, ১০০-১২৫ কেজি টিএসপি, ৭৫-১০ কেজি এমওপি, ৫ কেজি জিংক সালফেট এবং অম্লীয় মাটির জন্য ৫০-১০০ কেজি ডলোচুনের প্রয়োজন হয়।

সারের প্রয়োগ পদ্ধতিঃ গোবর/ কম্পোষ্ট সার জমি তৈরীর সময় ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। টিএসপি, এমওপি ও জিংক সালফেট সার মাদার মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া সার সমান তিন ভাগ করে  চারা গজানো যথাক্রমে  ১৫, ৩০ ও ৬০ দিন পর তিন কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করতে হবে।

সেচ ও নিকাশঃ করলার জমিতে রসের অভাব হলে দুই বেডে মাঝখানের নালা দিয়ে সেচ দিতে  হবে। বৃষ্টিপাতের কারণে জমিতে পানি জমার সাথে সাথে তা দ্রুত নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।

অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যাঃ করলা গাছ বড় না হওয়া পর্যন্ত আগাছা দমন করতে হবে। প্রতি মাদায় ২টি করে চারা রেখে  বাকি চারাগুলো তুলে ফেলতে হবে। করলার চারা ১০-১৫ সেমি লম্বা হলে গাছের গোড়ার কাছাকাছি মাটিতে বাঁশের কঞ্চি বা কাঠি পুঁতে একদিকে কাত করে বেঁধে দিতে  হবে । এরপর গাছ ৫০ সেন্টিমিটারের মতো লম্বা হলে  ১.৫ মিটিার উঁচু করে মাচা তৈরী করে দিতে হবে। এ ছাড়া মাঝে মধ্যে মাটি কুপিয়ে আলগা করে গাছের গোড়ায় মাটি দিয়ে উঁচু করে দিতে হবে এবং জমিতে আর্দ্রতা রক্ষায় করলা গাছের গোড়ায় জাবড়া দিতে হবে।

পোকা দমনঃ করলা গাছে তেমন বেশি পোকা-মাকড়ের আক্রমণ দেখা যায় না। তবে  ফলের মাছি পোকা,  লাল কুমড়া বিটল ও কাঁটালে পোকার আক্রমণ  হতে পারে।

ফলের মাছি পোকাঃ স্ত্রী মাছি পোকা কচি ফলের গায়ে ২-৫টি ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে পোকার কীড়াগুলো আক্রান্ত ফলে ভিতর ঢুকে এবং ফলের শাঁস খায়। আক্রান্ত ফল অকালে ঝরে পড়ে।

দমন: আক্রান্ত ফল কীড়াসহ সংগ্রহ করে মাটির গভীরে পুতে ফেলতে হবে। বিষটোপ ও ফেরোমোন ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে। একটি মাটির পাত্রে ১০০ গ্রাম থেতলানো  মিষ্টি কুমড়ার সাথে ০.২৫ গ্রাম সেভিন ৮৫ ডব্লিউ পি মিশিয়ে বিষ টোপ তৈরী করতে হবে। বিষটোপ ৩-৪দিন পরপর পরিবর্তন করতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে রিপকর্ড বা সিমবুশ ২০ ইসি  প্রতিলিটার পানির সাথে ১ মিলি হারে মিশিযে ১৫ দিন অন্তর ২-৩ বার ¯েপ্র করতে হবে।

লাল কুমড়া বিটলঃ পূর্ণ বয়স্ক পোকা  পাতা ও ফল খেয়ে ফেলে।

দমনঃ এপোকা দমনের জন্য জমি সর্বদা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। হাত দিয়ে পোকা সংগ্রহ করে মেরে ফেলতে হবে। এ ছাড়া জমিতে সুমিথিয়ন বা ফলিথিয়ন জাতীয় কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি হারে মিশিয়ে ¯েপ্র করতে হবে।

কাঁটালে পোকাঃ এ পোকা করলার পাতার সবুজ অংশ খেয়ে নষ্ট করে ফেলে। আক্রান্ত পাতা বিবর্ণ জালের মতো দেখায়। গাছের আক্রান্ত পাতাগুলো ঝরে পড়ে এবং গাছ পাতা শূণ্য হয়ে পড়ে।

দমনঃ আক্রান্ত পাতা থেকে পোকার ডিম, কীড়া এবং পূর্ণ বয়স্ক বিটলসমূহ হাত ও হাতজাল দিয়ে সংগ্রহ করে ধ্বংস করতে হবে। প্রতি লিটারপানির সাথে ৩০-৪০ গ্রাম শুকনা নিম বীজের পাউডার এক রাত ভিজিয়ে রেখে পানি ছেকে নিয়ে ওই পানি আক্রান্ত গাছ ও পাতায় ¯েপ্র করতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে প্রতি লিটার পানির সাথে ১ মিলি হারে  ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি  মিশিয়ে গাছের পাতা ভালভাবে ভিজিয়ে ও ¯েপ্র করতে হবে।

রোগবালাইঃ করলা গাছে পাতার গুচ্ছ রোগ, পাউডারি মিলডিউ ও ডাউনি মিলডিউ রোগ হতে পারে।এসব রোগ দমনের জন্য সমন্বিত  দমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

করলারপাতার গুচ্ছ রোগ: এ রোগের আক্রমণে গাছের পাতাগুলো গুচ্ছ আকারে দেখা যায়। গাছ বাড়ে না, ফুল ও ফল কমে যায়।

প্রতিকারঃ আক্রান্ত গাছ দেখা মাত্র তুলে পুড়িয়ে ফেরতে হবে। রোগমুক্ত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।  ক্ষেতের আশেপাশের আগাছা পরিস্কার রাখতে হবে।  বাহক পোকা দমনের জন্য টিডো বা এডমায়ার নামক কীটনাশক মাত্রা মোতাবেক ¯েপ্র করতে হবে।

পাউডারি মিলডিউ: পাতায় ধূসর বর্ণের পাউডার পড়ে। পাতা নষ্ট হয়ে যায় , ফুল ও ফল কম হয়।

প্রতিকারঃ রোগমুক্ত বীজ বপন করতে হবে। রোগ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম থিয়োভিট মিশিয়ে ১০-১৫ দিন অন্তর ¯েপ্র করতে হবে।

ডাউনি মিলডিউঃ পাতার ওপর ছোট ছোট হলুদ দাগ পড়ে। পাতা ঝলসে ও কুচকে যায়। পাতার নিচে গোলাপী দাগ দেখা যায়।

প্রতিকারঃ রোগ দেখা দিলে  প্রতি লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম ডাইথেন এম-৪৫ মিশিয়ে গাছ ভালভাবে ভিজিয়ে ¯েপ্র করতেহবে।

ফসল সংগ্রহঃ বীজ বপনের ৫০-৬০ দিন পর গাছে ফল ধরে। ফল ধরার ১২-১৫ দিন পর করলা সংগ্রহ করতে হয়।

ফলনঃ ভালভাবে যতœ নিলে হেক্টর প্রতি ১২-১৫ টন পর্যন্ত করলার ফলন পাওয়া যায়।

নিতাই চন্দ্র রায়

ডিজিএম (সম্প্রঃ)
সেতাবগঞ্জ সুগারমিলস্ লিঃ
সেতাবগঞ্জ দিনাজপুর

সূত্রঃ কৃষিবার্তা

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে