ডেস্ক রিপোর্টঃ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আপত্তির মুখে ‘বিনা ওয়ারেন্টে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না’- এমন নির্দেশনা থেকে সরে এসেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

তবে রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনী এলাকায় সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ ক্ষেত্রে কাউকে হয়রানি বা বৈষম্যমূলক আচরণ না করতে তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছে ইসি। এমনকি আটকের পর পুরনো মামলার অজ্ঞাত আসামি হিসেবে গ্রেফতার না দেখাতেও বলা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার আসন্ন তিন সিটি নির্বাচনের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকে এসব নির্দেশনা দেয়া হয়। ইসি সচিবালয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদার সভাপতিত্বে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠেয় তিন সিটিতে নির্বাচন যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নির্বাচন কর্মকর্তাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, এ বৈঠকের কার্যপত্রে নিরপরাধী বা ওয়ারেন্ট ছাড়া কাউকে গ্রেফতার না করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। সম্প্রতি বিষয়টি নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন।

এ প্রসঙ্গে ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ যুগান্তরকে বলেন, আমলযোগ্য অপরাধে পুলিশ যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারবে। সন্দেহভাজন মনে হলে বা ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ীও গ্রেফতার করা যাবে। তবে নির্বাচন সামনে রেখে অহেতুক গ্রেফতার করে প্যানিক (আতঙ্ক) সৃষ্টি না করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

আরও জানা গেছে, বৈঠকে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা তিন সিটি কর্পোরেশন এলাকায় স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে বলে ইসিকে জানিয়েছেন। তবে তাদের আশঙ্কা- বরিশাল সিটিতে সহিংসতা ও রাজশাহী সিটির মতিহার থানা এলাকায় জঙ্গি তৎপরতা দেখা দিতে পারে। এ থানার পাশে রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এসব এলাকায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিশেষ নজর রাখতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচনী এলাকায় টাকার খেলা চলছে উল্লেখ করে তা নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সহিংসতা এড়াতে তিন সিটির কাউন্সিলর প্রার্থীদের কর্মকাণ্ডের ওপর দৃষ্টি রাখতে বলা হয়েছে।

নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে বিভিন্ন মহল তৎপরতা চালাতে পারে এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। বৈঠকের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা তিন সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু হবে- এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে সাংবাদিকদের বলেন, বৈঠকে জাতীয় নির্বাচনের আগে এ তিন সিটি নির্বাচন গুরুত্ব পেয়েছে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এ নির্বাচন যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য যা যা করণীয়, তা করবেন বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সবাই আমাদের জানিয়েছেন।

আমাদের পক্ষ থেকে যেসব সহযোগিতা করার তা আমরা করব। তিনি বলেন, সিটিগুলোয় নির্বাচনের পরিবেশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন। কোনো ঝুঁকি বা আশঙ্কার বিষয় নেই। সিইসি আরও বলেন, তিন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন যাতে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যায়, সেই নির্দেশনা দিয়েছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কথাও ইসি শুনেছে। সবার আশা, সুষ্ঠুভাবে এ তিন সিটির নির্বাচন করা সম্ভব হবে। বাড়তি কোনো ব্যবস্থা নেয়ার দরকার হবে না।

কারণ, নতুন কোনো আইন তৈরি হয়নি যে, বাড়তি ব্যবস্থার দরকার হবে। এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ যাতে না আসে সেটা বলেছি। আর নির্বাচন পরিচালনা করতে গেলে অভিযোগ আসতেই পারে। তবে অভিযোগ সঠিক কিনা তা দেখতে হবে। তদন্তসাপেক্ষে প্রমাণ করতে হবে।

আগামী ৩০ জুলাই তিন সিটিতে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। ওই নির্বাচন সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলাসহ বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সিইসির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় চার কমিশনার, পুলিশের আইজি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ, র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদসহ বিজিবি, আনসার, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, তিন সিটি সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় কমিশনার, সংশ্লিষ্ট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, রিটার্নিং কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট ডিসি ও এসপিরা অংশ নেন।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকের কার্যপত্রে প্রথমেই বলা হয়, তিন সিটিতে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও নির্বাচনী এলাকায় সন্দেহভাজন অনুপ্রবেশকারী রোধ এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা বিশেষভাবে প্রয়োজন। তবে কারও বিরুদ্ধে যেন হয়রানিমূলক বা বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা না নেয়া হয় অথবা নিরপরাধী বা বিনা পরোয়ানায় কাউকে গ্রেফতার করা না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা অত্যাবশ্যক।

এ বিষয়টি তুলে ধরে বৈঠকে পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বিনা ওয়ারেন্টে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না, এ বিষয়ে কোনো চিঠি পাইনি। পত্র-পত্রিকার খবরে দেখেছি। বিষয়টি পরিষ্কার করার অনুরোধ জানান তিনি। তার ওই বক্তব্যের রেশ ধরে পুলিশ ও র‌্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তা এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। পুলিশের একজন কর্মকর্তা বৈঠকে বলেন, আশপাশের অনেক সন্ত্রাসী নির্বাচনী এলাকায় চলে আসবে, তাদেরকে কী গ্রেফতার করা যাবে না?

আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, নির্বাচনী এলাকায় চুরি-ছিনতাই হতে পারে, নানান অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হতে পারে। পরোয়ানা না থাকায় তাদেরকে কী গ্রেফতার করা যাবে কিনা- সে বিষয়ে জানতে চান তিনি। বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম বলেন, সিআরপিসি (ফৌজদারি কার্যবিধি) অনুুযায়ী গ্রেফতার করা যাবে। গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হবে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকলে পুরনো মামলার অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না।

বৈঠকে পুলিশের একজন ডিআইজি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, নির্বাচনে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার হতে পারে। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে, কোনো শঙ্কা নেই। তবে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে অস্ত্রধারী পুলিশ ও আনসারের সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাব দেন তিনি। ওই কর্মকর্তা বলেন, শুধুু মেয়র নয়, কাউন্সিলর প্রার্থীদের নজরদারি করা দরকার। তারাই সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েন।

আরেকটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা বলেন, নির্বাচনী এলাকায় টাকার খেলা চলছে। আবাসিক হোটেলে বহিরাগতরা অবস্থান করে টাকা ছড়াচ্ছে। বিষয়টি ক্লোজ মনিটরিং করা দরকার। তিনি বলেন, নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করতে জাল ভোট ও কেন্দ্র দখলের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হতে পারে। সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। নির্বাচনের দেশি ও বিদেশি পর্যবেক্ষকদের তালিকা সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় কমিশনার ও ডিসির কাছে দেয়ার প্রস্তাব করেন তিনি।

আরেকজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে কোনো সমস্যা নেই। তবে বরিশালে সহিংসতার আশঙ্কা রয়েছে। রাজশাহীর মতিহার থানা এলাকায় আগে জঙ্গি তৎপরতা ছিল। নির্বাচনে তা যেন মাথাচাড়া দিতে না পারে সেদিকে নজর রাখা দরকার। এ ছাড়া এ থানা এলাকায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। তিনি এজেন্টদের বের করে দেয়ার অভিযোগ বন্ধে তাদের হাজিরা রাখার প্রস্তাব দেন।

বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন অন্যতম শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, পাকিস্তানের পেশোয়ারের নির্বাচনে বোমা হামলায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। ওই ঘটনায় এ দেশের জঙ্গিরা যাতে অনুপ্রাণিত না হয়, সে বিষয়ে নজর রাখা হচ্ছে। তিনি বলেন, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা অনুমোদন ছাড়া নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন, আইনগতভাবে তারা তা পারেন না। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গাইডলাইন অনুসরণের পরমার্শ দেন তিনি।

বৈঠকে নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, মাঝে মধ্যে বিভিন্ন ঘটনায় আমরা প্রশ্নবিদ্ধ হই। ওই ঘটনার কিছু সত্য, কিছু বানোয়াট। কোনো কোনো ভোট কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেকে উৎসাহী আবার কেউ কেউ নির্লিপ্ত থেকে অপরাধের সুযোগ দেন। এসব বন্ধ করতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনে সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে।

বৈঠকের শুরুতেই সিইসি উপস্থিত সবার উদ্দেশে বলেন, এখন থেকে দুই মাসের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রক্রিয়ার দিকে যাব। সুতরাং সেই প্রস্তুতির পূর্বকালে এ তিন সিটি নির্বাচন আমাদের নির্বাচন কমিশন, মাঠপর্যায়ে যারা এ নির্বাচন পরিচালনা করবেন এবং এ নির্বাচনে সহায়তাকারী সব কর্মকর্তাসহ সবার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

খালেদা জিয়ার বিষয়ে ইসির করণীয় নেই : আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে- এমনটি প্রত্যাশা করেন সিইসি। তিনি বলেন, নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি আছে এবং তা থাকবে। তিনি এখনও আশা করেন আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবে। আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত বৈঠকের পর সিইসি আরও বলেন, আশা করি আগামী জাতীয় নির্বাচনেও বিএনপি অংশ নেবে। সবাইকে নিয়েই নির্বাচন হবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপির চেয়ারপারসন কারাবন্দি থাকার বিষয়টি আইন-আদালতের বিষয়। এ ব্যাপারে ইসির কিছু জানা নেই, করণীয়ও নেই।

নিরাপত্তা পরিকল্পনা : বৈঠকের কার্যপত্র থেকে আরও জানা গেছে, গাজীপুর ও খুলনার আদলে তিন সিটি নির্বাচনের নিরাপত্তা পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ওই দুই সিটির মতোই রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটিতে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২৪ জন ও সাধারণ কেন্দ্রে ২২ জন সদস্য নিয়োগ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

ভোটের আগের দু’দিন থেকে ভোটের পরদিন পর্যন্ত মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি মোতায়েন থাকবে। প্রতিটি সাধারণ ওয়ার্ডে পুলিশ, এপিবিএন ও ব্যাটালিয়ন আনসারের সমন্বয়ে একটি করে মোবাইল ফোর্স এবং প্রতি তিন ওয়ার্ডের জন্য একটি স্ট্রাইকিং ফোর্স থাকবে।

প্রতিটি ওয়ার্ডে র‌্যাবের একটি টিম এবং প্রতি দুটি ওয়ার্ডে এক প্লাটুন বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হবে। এ হিসাবে রাজশাহীতে ১৫ প্লাটুন , বরিশালে ১৫ প্লাটুন ও সিলেটে ১৪ প্লাটুন বিজিবি নিয়োগ করার পরিকল্পনা করছে ইসি।

J/N.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে