মো. মিঠুন মিয়া
mithun miya1

নদীর এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে এই তো নদীর খেলা। ঠিক তেমনি ভাঙা গড়ার সংগ্রামের জীবন কাটে বঙ্গোপসাগর উপকূলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন উপকূলবাসীর নিত্যসঙ্গী। প্রায় প্রত্যেক বছরই উপকূলীয় এলাকার মানুষ ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে কাবু হয়ে পড়ে। বছরে অন্তত দু-চারবার দুর্যোগের তা-ব মোকাবেলা করতে হয়। প্রকৃতির বৈরিতায় মানুষগুলো সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়। প্রাকৃতির সাথে টক্কর দিয়ে তাদের বাঁচতে হয়। নানা সময়ে প্রকৃতির এই তা-ব লীলায় ল-ভ- হয়ে যায় তিলে তিলে গড়ে তোলা মানুষের স্বপ্নগুলো। প্রাণহানি ঘটে স্বজনদের। বেঁচে থাকার সহায় সম্বল হারিয়ে জীবন আটকে পড়ে অজানা গর্তে। কিন্তু তারপরও থেমে থাকে না তাদের জীবনের চাকা। সব কিছু হারিয়ে ফের নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন বুনে উপকূলবাসী। প্রাকৃতির সাথে এক রকম যুদ্ধ করেই জীবন যাপন করতে হয় উপকূলবাসীর। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সরকারি-বেসরকারি সংস্থা’র সাহায্য-সহযোগিতা মেলে দেয়। আবারও ঘুরে দাঁড়ায় তারা।
শনিবার ১০০ কিলোমিটার বেগে ঝোড়ো বাতাস ও প্রবল বৃষ্টি ঝরিয়ে বাংলাদেশের ভূখ- অতিক্রম করে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা সময় নিয়ে ঘূর্ণিঝড়টি উপকূল অতিক্রম করার সময় মোট ২১ জনের প্রাণহানি ঘটে। জলোচ্ছ্বাসে ভেঙে যায় উপকূলীয় জেলাগুলোর বেড়িবাঁধ। এর ফলে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাড়িঘর, মাছের ঘের ও রাস্তাঘাট। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকার নিম্নাঞ্চল জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়। ঘূর্ণিঝড়টির আঘাতে চট্টগ্রাামের বাঁশখালীতে সাতজন, চট্টগ্রাম শহরে একজন, সীতাকু-ে দুজন, কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় দুজন, নোয়াখালীর হাতিয়ায় তিনজন, ফেনী ও লক্ষ্মীপুরে একজন করে, ভোলায় তিনজন ও পটুয়াখালীতে একজন মারা গেছেন।
এদিকে উপকূলীয় অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ সাইক্লোন রোয়ানুর ধাক্কা সামলানোর চেষ্টা করছেন। ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে পড়ায় এখনো চট্টগ্রামে বাশখালি ও আনোয়ারার বিশাল এলাকা পানির নিচে। কক্সবাজার, নোয়াখালী ও ভোলা জেলাতেও কিছু এলাকা পানির নিচে। এসব এলাকায় মাছ ও লবণচাষীরা সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাতটি জেলায় আশি হাজারের মতো ঘরবাড়ি পুরোপুরি বা আংশিক ধ্বংস হয়েছে। চট্টগ্রামে ৮০ কিলোমিটার ও কক্সবাজারে ২৮ কিলোমিটারের মতো বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কয়েকটি জেলায় মাছ ও লবণ চাষীরা সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বলা হচ্ছে বাংলাদেশের স্মৃতিতে থাকা অন্য সাইক্লোনগুলোর মতো রোয়ানু ততটা শক্তিশালী না হলেও এর ফলে বাঁধ ভেঙেই ক্ষতির শিকার হয়েছেন বেশিরভাগ মানুষ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর বলছে রোয়ানুর প্রভাবে চট্টগ্রাম ছাড়াও ভোলা, কক্সবাজার, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনি সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এর আগে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডর নামে এক ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ লন্ডভন্ড করে দিয়েছিলো বাংলাদেশের গোটা দক্ষিণাঞ্চল। ৪০ কিলোমিটার বেগে আসা জলোচ্ছাসের তোড়ে ভেসে গিয়েছিলো বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা। সিডর, যেন এক ভয়াবহ দুস্বপ্নের নাম। দক্ষিণাঞ্চলের হাজারো মানুষের ঘুম যেন কেড়ে নেয় সেদিনের ভয়াবহ সেই স্মৃতি। শতাব্দীর ভয়াবহ ঐ ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় ৫ হাজার মানুষ। নিখোঁজ হয়েছিল কয়েক হাজার। খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরিশাল, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জসহ আশপাশের অন্তত ১৬ জেলায় চলে ভয়াবহ তা-বলীলা। এছাড়া দেশের অন্যান্য স্থানেও আঘাত আনে। সিডরের আঘাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ঘরের ভেতর-বাইরে সবখানে লাশের ওপর লাশ পড়ে থাকে। হাজার হাজার বসতবাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়। বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত আর বনাঞ্চল মাটির সঙ্গে মিশে উজাড় হয়ে যায়। অনেক জায়গায় ঘর-বাড়ি পুরোপুরি বিলীন হয়ে পড়ে। সরকারি হিসেবে ২০ লাখ ঘরবাড়ি ভেসে যায় পানির স্রোতে। প্রায় ৪০ লাখ একর জমির ফসল বিনষ্ট হয়। মৃত্যু হয় ৪ লাখ ৬৮ হাজার গবাদিপশুর। এর মধ্যে খুলনা বিভাগের বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরায় মারা যায় ৭০ হাজার গবাদিপশু। বাকি গবাদিপশুর মৃত্যু হয়েছে বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায়। সিডরে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় খুলনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও বরগুনা জেলা। প্রায় ১ মাস পরও ধানক্ষেত, নদীর চর, বেড়িবাঁধ, গাছের গোড়া আর জঙ্গলসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্ধার করা হয় অনেক হতভাগার কঙ্কাল। কেউ কেউ সিডর আঘাত হানার অনেক দিন পর স্বজনদের কাছে ফিরেও আসেন। তবে না ফেরার সংখ্যাই ছিল বেশি। মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের বেশির ভাগেরই সলীল সমাধি হয় সাগরে। যাদের কোনো অস্তিত্ব পরে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সিডর পাল্টে দেয় দক্ষিণাঞ্চলের মানচিত্র। পৃথিবীর বৃহত্তর ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হয় কল্পনাতীত। শতাব্দীর ভয়াবহ এ ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে এখানকার এক তৃতীয়াংশ বনভূমি বিধ্বস্ত হয়। মাইলের পর মাইল উজাড় হয় বন। এ কারণে জীব বৈচিত্র্যের এই উদ্যান থেকে বিলীন হয় অনেক বিরল প্রজাতির বৃক্ষ ও প্রাণী। সিডরের আঘাতে যে পরিমাণ ক্ষতি দেশের হয়েছে, তা আজও পুষিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। যার ক্ষতচিহ্ন এখনও সুন্দরবনে লেগে আছে।
১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর ১৯৯৫, ১৯৯৭, ২০০০ ও ২০০১ সালে ঝড় আঘাত হানে উপকূলে। ২০০৮ সাল থেকে প্রতিবছর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপ ও লঘুচাপ এবং মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে প্রায়ই সতর্কসংকেত জারি হয়ে আসছে। ২০০৮ সালের ২ মে ঘূর্ণিঝড় নার্গিস উপকূলে আঘাত হানে। ২০০৯ সালের ১৭ এপ্রিল ঘূর্ণিঝড় বিজলি, ২০১০ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা উপকূলের বিভিন্ন এলাকাসহ রাঙ্গাবালীতে আঘাত হানে। ২০১৩ সালের ১৬ মে রাঙ্গাবালীসহ উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় মহাসেন। এতে উপকূলীয় এলাকার প্রকৃতি এবং মানুষের ব্যাপক সম্পদহানি হয়েছে।
এদিকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন শহর কক্সবাজারের টেকনাফের সেন্টমার্টিন দ্বীপ, শাহরপরীর দ্বীপ, পেকুয়ার মগনামা, শীলখালী, উজানটিয়া, কুতুবদিয়ার আলী আকবর ডেইল, তাবলেরচর, বড়ঘোপ, উত্তর ধূরং, মহেশখালীর ধলঘাটা ও মাতারবাড়ি, চকরিয়ার কাকারা, কৈয়ারবিল ও সাহারবিল এলাকায় চরম ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ রয়েছে। এসব এলাকার অনেক জায়গায় ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে দীর্ঘদিন লোকালয়ে জোয়ার-ভাটা চলছে। শুকনো মৌসুমে তার প্রভাব তেমন না পড়লেও বর্ষার শুরুতেই বাড়ছে প্রভাব। দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠেছে উপকূল। আতঙ্কিত হয়ে উঠছে এখানকার মানুষগুলো। এছাড়া অতি খরা, বিশুদ্ধ পানির অভাবসহ নানা সমস্যা উপকূলে লেগেই আছে। এতো গেল প্রাকৃতিক বিপর্যয়। এর উপর রয়েছে মনুষ্য সৃষ্টি কারণও। উপকূলে খাল বিল, নদীর জায়গা দখলে মতো বিষয়গুলো রয়েই গেছে। উপকূলে সাগরনির্ভর মৎসজীবীদের উপর জলদস্যুদের আক্রমণ তো লেগেই আছে। এছাড়াও সুন্দরবনে বনদস্যুদের হামলার শিকার হতে হয় বনজীবীদের।
প্রাকৃতিক সম্পদ এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে এই উপকূল অঞ্চলের গুরুত্ব অপরিসী। আমাদের দেশের অর্থনীতির বড় অবদান থাকে এই অঞ্চলের মানুষের। আর বঙ্গোপসাগওে রয়েছে নানা মূল্যবান সম্পদ। এই সম্পদ দেশের উন্নয়নের অপরিহার্য অংশ। সেজন্য দরকার প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে আমাদের উপকূলবাসীদেও রক্ষার জন্য আরো বিস্তৃত এবং প্রসারিত পদক্ষেপ কর্মসূচি এবং প্রচেষ্টা।
উপকূলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্ধ করা সম্ভব না হলেও দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। সে জন্য দরকার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মসূচির চেয়ে প্রস্তুতিমূলক কর্মসূচি। দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার জন্য দুর্যোগ প্রস্তুতিমূলক কর্মসূচির কোনো বিকল্প নেই। এর আগে আমরা দেখেছি সিডরের পর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ২২০ কোটি ডলার সাহায্য চাওয়া হয়েছিলো। সাহায্যের অনেক প্রতিশ্রুতিও মিলেছিলো। উপকূলীয় অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রকৃত সংখ্যা ও সম্পদ নির্ধারণে যথেষ্ট আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে। যেভাবেই হোক প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় দুর্যোগ প্রস্তুতি কার্যক্রম আরো শক্তিশালী করতে হবে। এছাড়াও নদী ভাঙন কবলিতদের পুনর্বাসনে সরকারের স্থায়ী ব্যবস্থা নেয়া দরকার। বর্তমানে রোয়ানুর আঘাতে ক্ষতিগ্রস্তদের পুর্নবাসন করতে হবে। কেবল সরকার নয়, আমাদের সবার উচিত উপকূলের মানুষের জন্য সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। এতো কিছুর পর ভেঙে পড়ে না উপকূলবাসী। তারা মনোবল, সাহসিকতা এবং দৃঢ় আত্মপরিচয় দিয়ে ফের নতুন করে সংসার গড়ে তোলে।

                            লেখকঃ প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে