mithun miya1

মো. মিঠুন মিয়া

দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির পূর্বাভাস মিললেও মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি জেলা নতুন করে প্লাবিত হওয়ার আশংকা করা হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলে নদ-নদীর পানি কমলেও বন্যার কিছুটা উন্নতি হলেও তা খুব একটা প্রভাব পড়েনি। কমেনি বন্যার্তদের দুর্ভোগ। বিভিন্ন এলাকায় মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছে। সরকারি হিসাবে বন্যায় এ পর্যন্ত মারা গেছেন ১৪ জন। পানিবন্দি হয়েছেন প্রায় ১৫ লাখ মানুষ। ক্ষতিগ্রস্তস্ত হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার ঘরবাড়ি ও হাজারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ অবস্থায় দল-মত নির্বিশেষে দেশের সব রাজনৈতিক দল, বিত্তবান ব্যক্তি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া।
শনিবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে বন্যার সার্বিক চিত্র তুলে ধরে দুর্যোগমন্ত্রী এসব কথা বলেন। এ সময় সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব মো. শাহ কামাল। দেশের ১৬টি জেলায় ৫৯টি উপজেলার প্রায় ১৫ লাখ মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তস্ত হয়েছে। ৯ হাজার ৩১৪টি ঘরবাড়ি পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত এবং ১২ হাজার ৩৭১টি আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৬৯টি আশ্রয় কেন্দ্রে ৭ হাজার ৩৭৫ জনকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। তাদের পর্যাপ্ত ত্রাণ দেয়া হয়েছে। তাদের চিকিৎসায় ৩৪৬টি মেডিকেল টিম কাজ করছে।
দেশের বন্যা দুর্গত প্রায় ১২টি জেলায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ। এসব এলাকার বেশির
এদিকে ইতোমধ্যে দেশব্যাপী বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হওয়ায় দুর্গতরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাই তাদের পাশে দাঁড়াতে সকল ব্যাংকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। একই সঙ্গে বন্যা পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্থদের পুনর্বাসনে তাদের প্রস্তুত থাকতেও বলা হয়েছে।
ভাগ নদ-নদীর পানি বাড়ছে। বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলে আভাস দিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। অন্যদিকে বন্যার পানি কমলেও দুর্ভোগ আরো বাড়ছে বন্যাকবলিতদের। এদিকে আগস্টে দেশে ‘বড়’ বন্যার আশঙ্কাও রয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও ওষুধের সংকট বেড়েই চলেছে। বন্ধ হয়ে গেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তীব্র  স্রোতে  ব্যাহত হচ্ছে ফেরি চলাচল। কোথাও কোথাও বন্ধ হয়ে গেছে রেল ও সড়ক যোগাযোগ।
দুর্গত এলাকায় এখনো ত্রাণ সামগ্রী পুরোপুরি পৌঁছেনি বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। এই মুহূর্তে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব। দেশের সকল নাগরিকের উচিত নিজ নিজ অবস্থান থেকে বন্যাকবলিত মানুষদের সাহায্য সহযোগিতা করা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের নিত্য সঙ্গী। নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমরা যখন সব কিছু হারিয়ে পথে বসার উপক্রম হই, সেই মুহূর্তে একে অপরের একটু সহযোগিতায় আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখি।
সিরাজগঞ্জ, গাইবান্ধা ও জামালপুরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। জামালপুর সদরের সঙ্গে বিভিন্ন উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। রেললাইনে পানি ওঠায় জামালপুর-দেওয়ানগঞ্জ রুটে রেল যোগযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার চন্দ্রনস্বর গুচ্ছগ্রামটি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। পানিবন্দি সাড়ে ১৩ লাখ মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকট। ছড়িয়ে পড়েছে পানিবাহিত রোগবালাই। গবাদিপ্রাণীর খাদ্য সংকটও তীব্র আকার ধারণ করেছে। মধ্য-দক্ষিণাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা করছে সরকার।
যমুনার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। শহররক্ষা বাঁধ হুমকির মুখে রয়েছে। এতে আতঙ্ক বিরাজ করছে শহরবাসীর মধ্যে। নিম্নাঞ্চলের আড়াই লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বহু পরিবার স্থানীয় ওয়াপদা বাঁধ ও ঘরের মাচাসহ বিভিন্ন উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। এলাকাগুলোয় খাবার ও পানির সংকট দেখা দিয়েছে। সরকারিভাবে যে ত্রাণ দেয়া হয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল বলে বানভাসী মানুষ জানিয়েছে।
জেলা সদর, বেলকুচি ও চৌহালীতে শুরু হয়েছে নদী ভাঙন। শতাধিক বাড়িঘর যমুনা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এদিকে যমুনা ও করতোয়া নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। মেঘনার ভাঙনে হাইমচর ইউনিয়নের মোল্লাকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ প্রায় ৩০০ বসতঘর এবং দুইটি মাছের আড়ত বিলীন হয়ে গেছে।
নওগাঁর আত্রাই উপজেলা পোল্ডার সি এলাকায় বাঁধ ভেঙে ফসলের ক্ষেত প্লাবিত হয়েছে। গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার রতনপুর বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ পানির তোড়ে ভেঙে গেছে। এতে গজারিয়া, উদাখালি, উড়িয়া এবং সদর উপজেলার বাদিয়াখালী ও বোয়ালি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে গেছে। এসব এলাকার প্রায় ৬০ হাজার মানুষ নতুন করে বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। পানির তোড়ে ফুলছড়ি উপজেলার চন্দ্রনস্বর গুচ্ছ গ্রামটি নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। পানির তোড়ে রতনপুর-বাদিয়াখালি সড়কের হাজিরহাট সংলগ্ন ব্রিজটি ভেঙে গেছে।
এছাড়া কাতলামারি, সিংড়িয়া, উদাখালী, গুণভরি সড়ক পানিতে ডুবে যাওয়ায় ফুলছড়ি উপজেলার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার ঝিনাই নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। অনেক ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। আড়াই শতাধিক পরিবার ঘরভিটা হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
মাদারীপুরের শিবচরে পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমার ৬০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। চরাঞ্চলের চারটি ইউনিয়নের অধিকাংশ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পদ্মা ও আড়িয়াল খাঁ নদীর ভাঙন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। দুই শতাধিক পরিবার নদী ভাঙনে গৃহহীন হয়ে পড়েছে। আড়িয়াল খাঁ নদীর প্রবল পানির তোড়ে শিবচরের শিরুয়াইল ইউনিয়নের পূর্ব কাকৈরে বাজাররক্ষা বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে।
কুড়িগ্রাম সদরের পাঁচগাছি ইউনিয়নের সাথী ও নাগেশ্বরী উপজেলার হাছনাবাদ ইউনিয়নের খাদিজা এবং চিলমারীর অষ্টমীর চরের আবদুস সামাদের দেড় বছরের মেয়ে শিল্পী শনিবার পানিতে ডুবে মারা গেছে। এ নিয়ে ১৩ দিনে পানিতে ডুবে সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। চিলমারী উপজেলার রানীগঞ্জে একটি সংযোগ সড়কের ৩০ মিটার ভেঙে চারটি বাড়ি ভেসে গেছে। নতুন করে তলিয়ে গেছে পাঁচটি গ্রাম। দুর্ভোগ বেড়েছে বাঁধ ও উঁচু স্থানে আশ্রয় নেয়া দুর্গতদের। তাদের মধ্যে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি সংকট দেখা দিয়েছে।
জামালপুর জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ছয় উপজেলার ৫০টি ইউনিয়নের তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে রয়েছে। পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় জামালপুর-দেওয়ানগঞ্জ রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে ৩৯৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দুর্গত এলাকাগুলোতে বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
বন্যাদুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানি ও গো-খাদ্যের তীব্র সংকটে জনজীবন বিপযস্ত হয়ে পড়েছে। বন্ধ রয়েছে বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অনেকেই ঘরের ভেতর মাচা পেতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেকে অনাহারে-অর্ধাহারে মানবেতর জীবনযাপন করছেন দুর্গতরা।
‘মানুষ মানুষের জন্য।’ বন্যাকবলিতরা আমাদের দেশেরই মানুষ। তাদেরকে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখাতে হবে। সরকারের পাশাপাশি দেশের সামর্থ্যবান প্রত্যেক নাগরিকদের বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে হবে। অনেকের ক্ষেতের ফসল তলিয়ে গেছে। অনেকে সহায় সম্ভল হারিয়ে অসহায়গ্রস্ত হয়ে পড়েছে। বন্যাকবলিতরা ফের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক -এমনটিই কাম্য।
লেখক :  প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়


একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে