kocuripana

বিডি নীয়ালা নিউজ(৫জানুয়ারি১৬)- অনলাইন প্রতিবেদনঃ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ মহীউদ্দীন চৌধুরী দীর্ঘদিন যাবত কচুরিপানা নিয়ে গবেষণা করেন এবং কৃষকের জমিতে প্রয়োগ করে ব্যাপক ফলপ্রসূ হয়েছেন। তাঁর গবেষণার কিছু বর্ণনা এখানে উল্লেখ করা হলো।

কচুরিপানা হলো ভাসমান এমন একটি প্রাকৃতিক জলজ  উদ্ভিদ যার উৎপত্তিস্থল ব্রাজিল (আমাজান), এর ৭টি প্রজাতি রয়েছে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় এলাকার এটি খুব দ্রুত বংশবিস্তার করে, এমনকি ৬ দিনেরও কম সময়ে সংখ্যা দ্বিগুন হয়ে যায়। দ্রুত বংশবিস্তারের জন্য কচুরিপানার বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। শাখা ও লতানো কান্ড এবং বীজের মাধ্যমে এর বংশবৃদ্ধি ঘটে যা পাখির মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে। অক্টোবরের প্রথমেই গাছে ফুল আসা শুরু হয় এবং সম্পূর্ণ গ্রীষ্মকাল চলতে থাকে। ফুল ফোটার  ১-২ দিন পর শুকিয়ে যায়। সকল ফুল শুকিয়ে যাওয়ার ১৮ দিন পর বীজগুলো বিমুক্ত হয়। গ্রীষ্মকালে অঙ্গজ বিস্তার খুব দ্রুত ঘটে। ৫০ দিনের মধ্যে প্রতিটি ফুল হতে প্রায় ১০০০ নতুন কচুরিপানার জন্ম হয়। একটি গাছ থেকে ৫০০০ এর অধিক বীজ উৎপন্ন হয়, এই বীজ ৩০ বছর পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে।

কচুরিপানা যে কোন পরিবেশেই জন্মাতে পারে, এমনকি বিষাক্ত পানিতেও এরা জন্মায়। কচুরিপানা অতিমাত্রার দূষণ ও বিষাক্ততা সহ্য করতে পারে। মার্কারী ও লেডের মত বিষাক্ত পদার্থ এরা শিকড়ের মাধ্যমে পানি থেকে শুষে নেয়। তাই পানির বিষাক্ততা ও দূষণ কমাতে কচুরিপানার চাষ অত্যন্ত উপকারী। পূর্ব এশিয়ার কিছু অংশে কচুরিপানা মানুষের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ভেষজ চিকিৎসার ক্ষেত্রেও এর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। গবাদি পশুর খাদ্য ও বায়োগ্যাস উৎপাদনের জন্য এটি চমৎকার একটি উৎস। ক্ষেত্র বিশেষে কচুরিপানা থেকে গোবরের চাইতেও বেশি বায়োগ্যাস উৎপাদন করা যায়। পূর্ব এশিয়াতে শুকনো কচুরিপানা জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত হয় এবং এর ছাই কৃষকরা সার হিসাবে জমিতে ব্যবহার করে। সবুজ কচুরিপানা জৈব সার হিসাবেও জমিতে ব্যবহার করা যায় (সরাসরি অথবা মালচ্ হিসাবে)। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কচুরিপানা থেকে কাগজ ও আসবাবপত্রও তৈরি করা যায়। কচুরিপানা কেঁচো উৎপাদন বৃদ্ধিতেও সহায়ক। কচুরিপানার বৃদ্ধি এতটাই তাৎক্ষিনক যে, কোন জলাশয়ের উপরে কার্পেটের মত স্তর তৈরি করাটা মাত্র একদিনের ব্যাপার। হেক্টর প্রতি  প্রতিদিন এদের বৃদ্ধি প্রায় ১৭ টনের উপরে এবং এক সপ্তাহের মধ্যেই এদের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। কচুরিপানায় খুব দ্রুত ও প্রচুর পরিমাণে ফুল ফোটে। তাই কচুরিপানা এখন কৃষির জন্য এক মহাসম্পদ। সম্প্রতি ভার্মি কম্পোস্ট (কেচোঁসার) তৈরির মাধ্যম হিসেবে কচুরিপানা একটি উত্তম উপকরণ হিসেবে নানা দেশে প্রমাণিত হয়েছে। কচুরিপানা থেকে তৈরি করা জৈব সার ব্যবহার করে জমির উর্বরতা এবং ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির সাফল্য পাওয়া গেছে । ১৮০ টন কাচাঁ কচুরিপানা থেকে প্রায় ৬০ টন জৈব সার উৎপাদিত হতে পারে। আমাদের দেশে দিন দিন গোবরের প্রাপ্যতা এতই কমে আসছে, কারণ এখন আর কৃষকের গোয়ালে গরু নেই, আছে পাওয়ার টিলার।

কচুরিপানা প্রাকৃতিকভাবে পানি থেকে বেশ ভালোভাবেই নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাসিয়াম পুষ্টি উপাদান পরিশোষণ করতে পারে। ফলে কচুরিপানা পচিয়ে জৈবসার তৈরি করে  জমিতে ব্যবহার করলে এ সব উপাদান মাটিকে সমৃদ্ধ করে তোলে। ভারতের তামিলনাড়–র গবেষক সেলভারাজ এক পরীক্ষায় প্রমাণ পেয়েছেন, ভার্মিকম্পোস্টের জন্য যেখানে অন্যান্য কৃষিবর্জ্য থেকে জৈব সার তৈরি করতে ৭০ দিন সময় লাগে সেক্ষেত্রে কচুরিপানা থেকে জৈব সার তৈরি করতে সময় লাগে মাত্র ৫৫ দিন। উক্ত বিজ্ঞানীর মতে, বিভিন্ন উদ্যান ফসল চাষের জন্য যেখানে হেক্টর প্রতি ১০-১৫ টন জৈব সার লাগে সেখানে কচুরিপানা থেকে তৈরি করা জৈব সার লাগে মাত্র ২.৫-৩.০ টন, এ পরিমাণ জৈব সার ব্যবহার করেই ফলন ২০-২৫ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব। অথচ এ বিষয়ে কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো একেবারে নিরব। বিভিন্ন পত্রিকায় বিশেষ করে দৈনিক যুগান্তরে কচুরিপানাকে নিয়ে যে সমস্ত খবর পরিবেশিত হয়েছিল তা এরূপঃ বদ্ধ নদীতে কচুরিপানা জট, কাপ্তাই হ্রদে আবারও কচুরিপানার জটঃ, নৌযান চলাচল ব্যাহত, গতিহীন সতী নদীতে কচুরিপানার জট, সাথিঁয়ায় ইছামতি নদী কচুরিপানায় পরিপূর্ণ এবং আমতলীর সুগন্ধিখালে কচুরিপানা জট নৌচলাচল বন্ধ ইত্যাদি। অর্থাৎ সারা বাংলদেশে কচুরিপানা ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত এলাকায় এ কচুরিপানাকে শুকিয়ে মালচ হিসাবে ব্যবহার করে লবণাক্ততা কমিয়ে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। কচুরিপানার এত কৃষিতাত্ত্বিক গুরুত্ব থাকার পরও বাংলার কৃষক ভাইয়েরা কচুরিপানার ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। তাই পরিশেষে বলবো, কৃষক ভাইয়েরা সংগঠিত হয়ে দলবদ্ধভাবে কচুরিপানা সংগ্রহ করে জৈব সার তৈরি, মাল্্চ হিসাবে ব্যবহার, ফল গাছের গোড়ায় মাল্্চ হিসেবে ব্যবহার করে মাটির ক্ষয়রোধ করে মাটিতে জৈব সার সংযুক্ত করে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করে দেশকে সমৃদ্ধ করতে পারেন। দেশে কচুরিপানার ব্যবহার না হওয়ায় বিজ্ঞানী ড. মহীউদ্দিনের আক্ষেপ “হায়রে কচুরিপানা বাংলার কৃষক তোরে চিনল না”।

-কৃষি প্রাবন্ধিক, সহকারী অধ্যাপক, শহীদ জিয়া মহিলা কলেজ, ভূঞাপুর, টাঙ্গাইল।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে