জয়নাল আবেদীন হিরো, নীলফামারী জেলা প্রতিনিধিঃ বর্তমান সময়ে দেশে অপার সম্ভাবনাময় শিল্পের নাম হেয়ার ক্যাপ শিল্প। গ্রামে গঞ্জে পাড়া মহল্লায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গড়ে উঠেছে ক্ষুদ্র কুটির শিল্পগুলো। পুরুষ মানুষের চুল বড় হলে সেলুন বা নাপিতের দোকানে গিয়ে সেই চুল কেটে ছোট করি। সেই ছেঁটে ফেলা চুলের যে এখন এত চাহিদা বলে বুঝানো যাবে না।

নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলা শহরের প্লাজায়, কাজীপাড়া, নিয়ামতপুর, কামারপুকুর, কাশিরাম, খাতামধুপুর, বাঙ্গালীপুর ও বোতলাগাড়ী ইউনিয়নসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি জেলা ও থানার গ্রাম গঞ্জে বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন গ্রামে গড়ে উঠেছে পরচুল বা ‘হেয়ার ক্যাপ’ তৈরি কারখানা। সেখানে কয়েক শত নারীরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে প্রতি মাসে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা আয় করছে। আর তাদের হাতের কারিশমায় তৈরি হওয়ায় ‘হেয়ার ক্যাপ’ চীনসহ মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে।তবে হতাশার বিষয় হচ্ছে অধিকাংশ কারাখানাতেই মানা হচ্ছে না শিশু শ্রমের বিধিনিষেধ। কেউ কেউ আবার ভুয়া জন্মসনদ তৈরী করে বয়স বেশী দেখিয়ে কাজ করছেন। প্রতিষ্ঠানগুলোতে নেই যাচাই বাছাইয়ের বালা। ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সীদের মূলত প্রধান্য দেয়া হয় এসব প্রতিষ্ঠানে। কর্তৃপক্ষের দাবী ১৮-২৫ বছর বয়সীদের দ্বারা কাজ নির্ভুল ও দ্রুত হয়।

সরেজমিনে বিভিন্ন কারখানায় ঘুরে দেখা যায় এক বিচিত্র দৃশ্য। ছোট ছোট শিশুদের মাথা নিচ করে কাজ করার মর্মান্তিক দৃশ্য। নিজের ভালোমন্দ বোঝার সক্ষমতা এখনো হয়নি অথচ কাজ করছে স্কুল ছেড়ে। কথা বলতেই অনেকে অজান্তে কেঁদেও ফেলেছে। উপজেলার হাজারীহাটের ডাঙ্গাপাড়ার ব্রাইট হেয়ার নটিং সেন্টার, জুয়েল হেয়ার ফ্যাশন, চৌমুহনীর শাহজালাল হেয়ার ফ্যাশনসহ বিভিন্ন কারখানায় ঘুরে দেখা যায় ছোট ছোট শিশুরা কাজ করছে। প্রতিটি কারখানাতে প্রায় ৭০ ভাগ শিশু শ্রমিক। যারা এখনো প্রাইমারী স্কুলের গন্ডি পেরুতে পারেনি। বাকীরা কেউ কেউ কেবল ১৮/২০ এ। আবার অনেকে ভুয়া জন্মসনদ তৈরি করে নিজেদের ১৮/২০ বছর বয়সী বলছে। তবে দেখেই বুঝা যায় তাদের বয়স কত হতে পারে। কর্তৃপক্ষের সাথে কথা হলে তারা দেখায় বিভিন্ন অজুহাত। কখনো এলাকার গরীব মানুষের চাপে আবার কখনো ভুয়া কাগজের দোহাই।

তবে বিভিন্ন কারখানা পরিদর্শনে জানা যায়, এই হেয়ার ক্যাপগুলো দেশে ব্যাপক চাহিদা না থাকলেও চীন ও ইউরোপে বেশ কদর রয়েছে। প্রতিটি ক্যাপ বেশ চড়া দামে বিক্রি হয়। অথচ ৩/৪ দিন পরিশ্রম করে একটি ক্যাপ তৈরির পর শ্রমিকরা পায় ৯০০/১১০০ টাকা। সোনাখুলি নলছাপাড়ার সাথী আক্তার ও ডাঙ্গাপাড়ার লতা আক্তারের সাথে কথা হলে জানান, তারা ৭ম ও ৮ম শ্রেনীতে পড়েন। করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় এখানে কাজ করছে।এই দাবীটিও ছিল কর্তৃপক্ষের। কিন্তু সম্প্রতি স্কুল কলেজ খুলে গেলেও এসব শিক্ষার্থীর অনেকেই আর ফিরে যাননি প্রতিষ্ঠানে। একদিকে যেমন শ্রম আইন ভঙ্গ হচ্ছে আরেকদিকে স্বাস্থ্য ঝুকিতে পড়ছে অনেকে। মহামারীর সময়ে স্কুল বন্ধ থাকায় শিশু শ্রম বৃদ্ধি পাওয়ার প্রমাণ ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে আসছে। বিশ্বের ১৩০টির বেশি দেশে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় ক্লাস শুরু হলেও অনেক বাবা-মায়ের সন্তানকে স্কুলে দেওয়ার সক্ষমতা নাই। ফলশ্রুতিতে আরও অনেক শিশু বঞ্চনামূলক ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যোগ দিতে বাধ্য হচ্ছে। লিঙ্গ বৈষম্য আরও তীব্র হতে পারে। বিশেষ করে মেয়ে শিশুদের কৃষি ও গৃহকর্মে বঞ্চনার শিকার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।

শিশু শ্রম বৃদ্ধির ঝুঁকি মোকাবেলায় ভ্রাম্যমান অভিযান পরিচালনা, অধিকতর সমন্বিত সামাজিক সুরক্ষা, দরিদ্র পরিবারের জন্য সহজে ঋণ পাওয়ার সুযোগ, বড়দের মানসম্মত কাজের সুযোগ বৃদ্ধি, স্কুলের বেতন বাতিলসহ শিশুদের স্কুলে ফেরা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ, শ্রম পরিদর্শন ও আইন প্রয়োগে সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়গুলোতে কর্তৃপক্ষের জোর দেওয়া এখন সময়ের দাবী।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে