mithun miya

মো. মিঠুন মিয়া

সুন্দরবন বাংলাদেশের আরেক পরিচয়। প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক এবং জীববৈচিত্র্যগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ব ঐতিহ্য এই সুন্দরবনের অস্তিত্ব আজ প্রশ্নের মুখে পড়েছে। প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্টসহ একের পর এক নানা কারণে প্রতিনিয়ত সৌন্দর্য হারাতে বসেছে সুন্দরবন। দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে এর আয়তন এবং কমছে পশুপাখির সংখ্যা। যা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং কোনোক্রমেই কাম্য নয়। বাংলাদেশের গর্বের এই সুন্দরবনকে রক্ষার জন্য আমরা কতটা সচেতন এবং উদ্যোগ গ্রহণ করেছি তা আজ বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় পশুর অবাধ বিচরণ ভূমি এই সুন্দরবন। সুন্দরবনের অনাকাঙ্খিত ঘটনার জন্য হ্রাস পাচ্ছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। ইতোমধ্যে কয়েকজাতির পশু বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ২০০৮ সালে সিডরে চরমভাবে বিপর্যস্ত হয় সুন্দরবন। এছাড়াও বিভিন্ন সময় আরো ছোট-বড় কিছু দুর্ঘটনায় নষ্ট হচ্ছে এখানকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য। কাজেই একদিকে যেমন চলছে দখলদারদের আগ্রাসন, অন্যদিকে দুর্ঘটনা। সবমিলিয়ে মোটেই সুন্দরবন সুন্দরের অবস্থানে নেই।

sudorbon01

বর্তমানে সুন্দরবনে আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে অগ্নিকা-। গত এক মাসে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের বিভিন্ন এলাকায় আগুন লেগে প্রায় পনেরো একর বনভূমি পুড়ে যায়। এতে বনের সুন্দরী, বলাসহ বিভিন্ন লতাগুল্ম ও গাছপালা পুড়ে যায়। ২৭ এপ্রিল সুন্দরবনে আগুন লাগার পর বনবিভাগ পুরো পূর্ব সুন্দরবন জুড়ে সতর্কতা জারি করে এবং বনজীবীদের বনে প্রবেশের পাশ-পারমিট সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করে। গত ১৪ বছরে বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলায় সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জে শুধু ধানসাগর স্টেশনের আওতাধীন এলাকাতেই ২১ বার আগুনের ঘটনা ঘটেছে। গত ২৭ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিলের মধ্যে চারবার আগুন লেগেছে বনে। ২৭ এপ্রিল ধানসাগর স্টেশনের ২৫ নম্বর কম্পার্টমেন্টের তুলাতলা এলাকায় আগুন লাগার পর বনবিভাগ সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের দুটি রেঞ্জে বনের সব ধরনের সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ করে।

বারবার অগ্নিকা-ের ফলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। এতে বন্য পশু-পাখি ও বাস্তুসংস্থানও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়াও আগুনের কারণে মাটির উবর্রতাশক্তি কমে যায়। আগুনে পুড়ে যাওয়া বনে জোয়ার-ভাটা না থাকলে নতুন করে ম্যানগ্রোভ জন্মাতেও অনেক সময় লাগে। এদিকে কয়েক দফা আগুন লাগার পর বনজীবীদের পূর্ব সুন্দরবনে প্রবেশ নিষিদ্ধ করায় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে তাদের জীবিকা। সুন্দরবন সংলগ্ন বাগেরহাটের শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ, মংলা ও রামপাল উপজেলার হাজারো মানুষ যুগ যুগ ধরে বনের মাছ, জ্বালানি কাঠ, গোলপাতা সংগ্রহ ও মধু সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করে। অগ্নিকা-ের ঘটনায় বনবিভাগের নিষেধাজ্ঞার কারণে তাদের জীবিকা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তবে জানা গেছে, সুন্দরবনে আগুন দেওয়ায় গুটিকতক লোক জড়িত। এদিকে বন ও পরিবেশ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সুন্দরবনে যারা আগুন দিয়েছে তাদের ধরিয়ে দিতে বন সংলগ্ন স্থানীয়দের আহ্বান জানিয়েছেন। সুন্দরবন রক্ষার জন্য ওই অপরাধীদের ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দিতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সাধারণ মানুষের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে জ্বালানি তেলবাহী একটি জাহাজ ডুবে যায়। এতে জাহাজটি থেকে সাড়ে তিন লাখ লিটারের বেশি ফার্নেস তেল সুন্দরবনে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে। নদীটির তীরের কাছাকাছি নোঙর করা ওই জাহাজটিকে অন্য একটি পণ্যবাহী জাহাজ ধাক্কা দিলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। ১৫ মাস আগে সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে তেলবাহী জাহাজ ডুবির ঘটনায় ভয়াবহ দূষণের শিকার হয় বিশ্বের বৃহত্তম বাদাবন সুন্দরবন। জাতিসংঘ বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে মর্যাদা দিয়েছে যে অনন্য সুন্দর বাঁদাবনকে তার অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে ওঠার আশঙ্কা সৃষ্টি করে এ দূষণ প্রক্রিয়া। সুন্দরবন এবং সংলগ্ন নদীনালার জীববৈচিত্র্যের জন্যও তা দুঃসংবাদ সৃষ্টি করে। ১৫ মাস পরে সে দূষণ অনেকখানি সামাল দেওয়া গেলেও ক্ষয়ক্ষতির রেশ এখনো রয়ে গেছে। শ্যালা নদীর দুর্ঘটনার পর সুন্দরবন সংশ্লিষ্ট নদ-নদীতে যান্ত্রিক নৌযান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি ওঠে। জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ইউনেস্কোর পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে তাগিদ দেওয়া হয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, নৌ চলাচলের বিকল্প চ্যানেল চালু করে শ্যালা নদীতে যান্ত্রিক নৌ চলাচল বন্ধ করা হবে। শ্যালা নদীতে ইতিমধ্যে সার বোঝাই জাহাজ ডুবি ঘটেছে। ডলফিনের অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষিত সুন্দরবনের এ অংশে নতুনভাবে জাহাজ ডুবিতে নদী দূষণের আশঙ্কা করা হচ্ছে। ডলফিন, কুমির, শামুকসহ বিভিন্ন ধরনের জলজ প্রাণীর জন্য তা বিপদ ডেকে আনে।

এদিকে দখলদারদের করাল গ্রাসে ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের মানচিত্র। ভূমিহীনদের নামে স্থানীয় প্রভাবশালীরা একদিকে দখল করে নিচ্ছে বনের জমি অন্যদিকে বনের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা নদীও গিলে খাচ্ছে। নদীগুলোতে জেগে ওঠা চড়ে বন ঘেঁষে জনবসতি গড়ে তোলা এবং বনের ভেতর দিয়ে অবিরাম জাহাজ চলাচলের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যও।

একসময়ের উত্তাল পশুর ও ভোলা নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে স্থানীয় প্রভাবশালীরা ডিসিআরের নামে চর দখলের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। ভূমিহীনরাও গড়ে তুলছে জনবসতি। বনসংলগ্ন এলাকায় ব্যাপক জনবসতি গড়ে ওঠায় সুন্দরবনকে সুরক্ষা দেয়া দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় প্রভাবশালীরা বনের মধ্যেই বসবাসসহ ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তোলায় বন্যপ্রাণীর স্বাভাবিক চলাফেরা বাধাগ্রন্ত হচ্ছে। এছাড়াও সুন্দরবনে মানুষের অবাধ যাতায়াত, চোরা শিকারিদের দৌরাত্ম্য, বনের নদী ও খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকার ও অপরিকল্পিতভাবে সুন্দরবনের সম্পদ আহরণ এবং দিনকে দিন বনের ওপর মানুষের নির্ভরশীলতার প্রভাবে সুন্দরবনের অস্তিত্ব নিয়ে সংকট দেখা দিয়েছে।

এভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সুন্দরবন তার জীববৈচিত্র্য হারিয়ে শূন্য জলাভূমিতে পরিণত হবে বলেই আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। তাই সুন্দরবনের সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ করে ইকো ট্যুরিজম (প্রতিবেশ পর্যটন) খাতের বিকাশ ঘটানোর দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে তাদের মাঝে। ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের সুরক্ষায় আশপাশের বসতিগুলো সরিয়ে নেয়া অতি জরুরি। বনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচল বন্ধ করতে হবে। বনে মধু সংগ্রহ করা, গোলপাতা কাটা, বনের ভেতর মাছ ধরাসহ সব ধরনের সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ করতে হবে। অন্যথায় এ বনকে রক্ষা করা যাবে না।

এই সব বিষয় বিবেচনায় সুন্দরবন রক্ষা আজ আমাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে পুরোপুরিভাবে নৌ চলাচল বন্ধ করা এখন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। কেবল পশুর নদ দিয়ে নৌ চলাচল করার বিধান করতে হবে। এছাড়াও দুর্ঘটনা ঘটলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার মতো অবস্থা থাকতে হবে। সুন্দরবনকে তার আপন গতিতে থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার। প্রকৃতি তার নিজের মতো থাকলে তা সমৃদ্ধ হয়। এই সম্পদ রক্ষায় আমাদেরকে সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও হিসাবনিকাশ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জীববৈচিত্র্যে বা ইকো সিস্টেম রক্ষা আজ সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।

 

প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে