আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কেরালার ছোট একটি শহর কদুনগাল্লুর।

শহরটিতে যে ৬০টি ব্যতিক্রম ফিল্ম ক্লাব রয়েছে তার একটি কদুনগাল্লুর ফিল্ম সোসাইটি।

গত সপ্তাহের এক বিকেলে ওই শহরেরই এক বাড়ির ছাদে সিনেমা দেখানোর আয়োজন করে ক্লাবটি যেখানে প্রায় দুইশোর মতো দর্শক ছিলো।

‘ফোর মান্থস থ্রি উইকস এন্ড টু ডেজ’ ২০০৭ সালের একটি সিনেমা দেখানো হয়, রোমানিয়ায় কমিউনিস্ট শাসনের শেষ দিনগুলো নিয়েই এ ছবিটি নির্মিত হয়েছে।

“দর্শকরা এ ছবিটি বেশ পছন্দ করেছে, আমাদের দেখানো সব ছবিই আসলে ভালোলাগার মতো” -বলছিলেন কদুনগাল্লুর ফিল্ম সোসাইটির সদস্য অনুপ কুমারান।

এই ক্লাবটি প্রতি শুক্রবার বিকেলে ‘রুফটপ সিনেমা শো’ এর আয়োজন করে এবং গত ছয় বছর ধরে তারা এটি করছে।

আর এই আয়োজনের কারণে সিনেমার দর্শকরা ঐতিহাসিক শহর কদুনগাল্লুরের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। এই শহরে ভারতের প্রথম মসজিদ গড়ে উঠেছিল, এছাড়াও রয়েছে আরো ঐতিহাসিক নিদর্শন।

কদুনগাল্লুর ফিল্ম সোসাইটি আয়োজিত সিনেমার দর্শকরাও বিভিন্ন স্তরের মানুষ। এখানে ছাত্র-শিক্ষক থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, লেখক, আইনজীবী, ইঞ্জিনিয়ারসহ দিনমজুররাও আসেন তাদের ছবি দেখতে।

৪৭ বছর পুরনো এই ক্লাবটির ১৭৫ জন সদস্য রয়েছে যারা নিয়মিত ক্লাবটিতে অর্থ দিয়ে থাকেন।

এখানে ছবি দেখতে আসার জন্য কোনো টাকা দিতে হয় না, আয়োজনের দিন আগে এসে প্লাস্টিকের চেয়ার দখল করতে হয়

টিনের ছাদের নীচে দেখানো হয় ভারতের আঞ্চলিক ছবি ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ছবি।

প্রত্যেকটি শো এর জন্য ক্লাবটি ৫০০ রুপি করে প্রদান করে।

তবে হলিউড ও বলিউডের কোনো ছবি তারা দেখায় না।

প্রত্যেক বছর ক্লাবটি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করে। যেখানে চলচ্চিত্র নিয়ে যাদের উৎসাহ আছে তাদের জন্য প্রণোদনা কোর্স ও থিয়েটার পারফরম্যান্সেরও আয়োজন থাকে। এছাড়াও মালায়লাম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ‘কিংবদন্তী’ একজনকে প্রতি বছর ৩৮৪ ডলার অর্থ পুরষ্কার দেয় ক্লাবটি।

তবে সম্প্রতি কদুনগাল্লুর ফিল্ম সোসাইটি খবরের আলোচনায় এসেছে ভিন্ন কারণে।

ছোট এই শহরটির সিনেমাপ্রেমীরা গত বছর ভারতের সুপ্রিম কোর্টের দেয়া বহুল আলোচিত একটি রুলিংকে চ্যালেঞ্জ করেছে।

গত বছর এক রায়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলে- দেশের প্রতিটি সিনেমা হলে প্রতিটি ছবি প্রদর্শনের আগে জাতীয় সঙ্গীত বাজাতে হবে এবং সেসময় সব দর্শককে উঠে দাঁড়াতে হবে।

এখন প্রশ্ন হলো ভারতের সিনেমা হলে জাতীয় সঙ্গীত বাজানো নিয়ে কী আইন রয়েছে?

  • ১৯৭১ সনের আইন অনুযায়ী জাতীয় সঙ্গীত গাইবার সময় কোনো ধরনের অবমাননা করা হলে বা কোনোভাবে সেটায় বাধা দেয়ার চেষ্টা করা হলে তিন বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানা দেয়ার বিধান ছিলো।
  • ১৯৬০ ও ১৯৭০ এর দশক পর্যন্ত জাতীয় সঙ্গীত বাজানোটাই ছিল রেওয়াজ।
  • ভারতে জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর বিষয় নিয়ে তেমন কোনো নিয়মনীতি ছিল না এবং এ নিয়ে দেশটির ২৯টি রাজ্যের নিজস্ব বিধান রয়েছে। সিনেমা হলে জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হবে কি হবে না, সে সংক্রান্ত নিয়ম-কানুন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন রকম ছিল। এ নিয়ে ভারতীয় জনমতও ছিল বিভক্ত।
  • কিন্তু গত বছর ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এক রুল জারি করে এটাকে জাতীয় আইনের আওতায় আনে।
  • এক আবেদনের প্রেক্ষিতে গত বছর ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে দেশের প্রত্যেক সিনেমা হলে ছবি দেখানো শুরুর আগে জাতীয় পতাকা দেখিয়ে জাতীয় সঙ্গীত বাজাতে হবে এবং এ সময় সবাইকে দাঁড়িয়ে সম্মান দেখাতে হবে।
  • এছাড়া এটাও বলা হয়-জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর সময় হলের দরজা বন্ধ থাকতে হবে যেন ওই সময় কেউ প্রবেশ বা বের হয়ে যেতে না পারে।
  • তবে পরবর্তীতে আদালত তার রায়ে কিছুটা পরিবর্তন এনে বলে যে জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর সময় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দাঁড়ানোর কোনো প্রয়োজন নেই।

দেশপ্রেমের আবেগে ভাটা পড়ে যাচ্ছে, জাতীয় সঙ্গীতের নিয়মকানুন মানা হচ্ছে না এমন সব মন্তব্য ও দেশপ্রেম প্রদর্শনের অংশ হিসেবে সিনেমা হলে জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর সময় উঠে দাঁড়ানোর জন্য ভারতীয়দের দাবির অংশ হিসেবেই আদালত সেই রায় দিয়েছিল। ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছিল।

তবে ওই রায়ের পরে বেশ কয়েকটি অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে।

গোয়া প্রদেশের একটি সিনেমা হলে হুইলচেয়ারে বসে থাকা এক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে ব্যাপক লাঞ্ছনার মুখে পড়তে হয়েছিল। জাতীয় সঙ্গীত চলাকালে ওই ব্যক্তি উঠে দাঁড়াননি বলে হলের অন্য দর্শকরা ওই ব্যক্তিতে ‘পাকিস্তানি’ বলে অপমান করে ও নানা কটূক্তি করে।

ওই রায়ের পর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে পুলিশ বহু মানুষকে আটক করে, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে তারা সিনেমা হলে জাতীয় সঙ্গীত চলাকালে চেয়ারে বসে ছিল।

কেরালার রাজধানী ত্রিভানদ্রুমে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গিয়েছিলেন কদুনগাল্লুর ফিল্ম সোসাইটির কয়েকজন সদস্য।

“এটা দিনে দিনে এটা হাস্যকর ও বিরক্তিকর পরিস্থিতিতে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে” বলেন কদুনগাল্লুর ফিল্ম সোসাইটির সদস্য পিভি দিনেশ, তিনিই আদালতের রুলের বিরুদ্ধে পিটিশন আবেদন করেন।

বিবিসিকে মি: দিনেশ বলেন “প্রত্যেক দিন বারোটির মতো ছবি প্রদর্শিত হয় এবং প্রত্যেকবার ছবি প্রদর্শনের আগে জাতীয় সঙ্গীত বাজছে ও সবাইকে দাঁড়াতে হচ্ছে”। মানুষের ওপর জোর প্রয়োগের এ রায় ‘মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করছে’ বলে উল্লেখ করেন পিটিশনকারী ব্যক্তি মি: দিনেশ।

তিনি এটাও বলেন যে এ ধরনের আইন মানুষের সত্যিকারের দেশপ্রেম ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করে না, বরং দেশপ্রেম প্রকাশের আইন করে মানুষের ওপর জোরজবরদস্তি করা হচ্ছে এবং এটা ‘সম্মান প্রদর্শনের বাহ্যিক রূপ মাত্র’।

পিটিশনে বলা হয় “সিনেমা হল কোনো সম্মান ও সমৃদ্ধশক্তি প্রদর্শনের জায়গা নয় যেখানে জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা হবে”।

“সিনেমা হলে মানুষ বিভিন্ন কারণে যায়, মূল কারণ হলো সিনেমা বিনোদনের একটি অংশ। সিনেমা হলে প্রদর্শিত বিভিন্ন ছবিতে এমন কিছু বিষয় থাকে যা জাতীয় নীতি ও শ্রদ্ধার সাথে খাপ খায় না” বলা হয় পিটিশনে।

এরপর গত সোমবার দেশের শীর্ষ আদালতে ‘সিনেমা হলে জাতীয় সঙ্গীত বাজানো সংক্রান্ত’ সুপ্রিম কোর্টের রায় সংক্রান্ত পিটিশনটি নিয়ে শুনানি করে।

এ নিয়ে শুনানির সময় আদালত কক্ষে তকর্ব-বিতর্কের সময় একজন আইনজীবী বলেন যে-এমন একটা সময়ও আসবে শত শত মানুষ হয়তো রেলওয়ের ওয়েটিং রুমে বা বিমানবন্দরে থা পাবলিক টিভিতে সিনেমা দেখবে, তখন যদি জাতীয় সঙ্গীত বাজে তাহলে সবাইকে উঠে দাঁড়াতে হবে।

সিনেমাপ্রেমীদের যুক্তির পক্ষে সম্মতি প্রকাশ করতে দেখা যায় একজন বিচারককে। বিচারক ডিওয়াই চন্দ্রচূর সরস মন্তব্য করেন এই বলে- “এমনও হতে পারে আগামীকাল কেউ দাবি করতে পারে যে সিনেমা হলে র্শট ও টি-শার্ট পরে প্রবেশ করা যাবে না কারণ সেখানে জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হবে। এ ধরনের নিয়মনীতির শেষ কোথায়?”

“জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর সময় আপনি যদি না দাঁড়ান তাহলে আপনার মধ্যে দেশপ্রেম নাই-এমনটা আমরা কেন ধরে নেব?”

অনেক ভারতীয় নাগরিকের মনে এমন প্রশ্ন আছে।

প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র সিনেমা হলে জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হবে কি হবে না এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি বলেছেন “সিনেমা হলে জাতীয় সঙ্গীতে কে দাঁড়ালো কে দাঁড়ালো না এটা দেশপ্রেম মাপকাঠির বিষয় হতে পারে না, দেশপ্রেম এমন একটি বোধ যা আদালত জোর করে চাপিয়ে দিতে পারে না”। আদালত চায় এ নিয়ে সরকার কোনো সিদ্ধান্তে আসুক।

এ সংক্রান্ত পরবর্তী শুনানি হবে আগামী ৯ই জানুয়ারি যাতে সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানা যাবে।

এদিকে কদুনগাল্লুরের সিনেমাপ্রেমীরা পরবর্তী ছবি দেখার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আগামী শুক্রবার তারা দেখবেন ‘ওয়াদজাদা’ ছবিটি। ২০১৩ সালের এ ছবিটির মূল কাহিনী গড়ে উঠেছে রিয়াদে বসবাসরত এক তরুণীকে নিয়ে। এটিই প্রথম ফিচার ফিল্ম যেটার পুরোটাই সৌদি আরব ভিত্তিক। এর কাহিনী গড়ে উঠেছে সৌদি নারীকে ঘিরে। এর নির্মাতাও সৌদি নাগরিক। এছাড়াও ছবিটি পুরোটাই সৌদি আরবে নির্মাণ করা হয়েছে।

B/B/C/N

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে