………………মোঃ আব্দুল মান্নান

 

 শিক্ষাগুরুকে অসম্মানের ধৃষ্ঠতা কেউ দেখায়নি। চাণক্য শ্লোকে আছে, এক অক্ষরদাতা গুরুকে ও গুরু বলিয়া মান্য করিবে । গুরুকে যে গুরু বলে মান্য করে না, সে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে নিম্ম মানসিকতারই পরিচয় দিয়ে থাকে। শিক্ষকগণ সবসময়ই সম্মানের আসনে আসীন।

মোঘল শাসন আমলে বাদশাহ্ আলমগীরের ছেলেকে দিল্লীর এক মৌলভি পড়াতেন। একদিন বাদশাহ দেখেন তাঁর ছেলে ওস্তাদজীর পায়ে পাািন ঢালছেন আর ওস্তাদ নিজ হাতে পা দু- খানা পানি দারা পরিস্কার করছেন । ওস্তাদজী বাদশাহ্র এ বিষয়টি লক্ষ্য করলেন এবং একটু ভয় পেয়ে গেলেন । বাদশাহ্র ছেলে দ্বারা পানি ঢেলে নেয়ায় তিনি নিজেকে অপরাধি মনে করলেন এবং চিন্তিত হয়ে পড়লেন; তবে তিনি নিজে নিজে আশ্বস্ত হলেন এ ভেবে যে তিনি হলেন শিক্ষক, তিনিই শ্রেষ্ঠ। পরদিন বাদশাহ্ আলমগীর ঐ শিক্ষককে দরবারে তলব করলেন এবং তার উদ্দেশ্যে বললেন , আমার ছেলে আপনার কাছে কি কিছু শিখেছে ? শিখেছে বেয়াদবী ও গুরুজনে অবহেলা । এর পর তিনি আগের দিনের সকালের ঘটনা উল্লেখ করে বললেন , আমার ছেলে আপনার পায়ে পানি ঢালছে আর আপনি পানি দ্বারা পাঁ পরিস্কার করছেন। আমার ছেলে কেন নিজ হাতে আপনার পা পরিস্কার করল না ? আপনি কেন তাকে সে শিক্ষা দেননি ? শিক্ষক নিজের ভূল বুঝতে পারলেন এবং বাদশাহ্র নিকট উচ্ছাস ভরে উচ্চ কন্ঠে বললেন :“ আজ হতে চির উন্নত হ’ল শিক্ষা গুরুর শির , সত্যিই তুমি মহান , বাদশাহ্ আলমগীর ’’ কবি কাজী কাদের নেওয়াজ ‘‘ শিক্ষা গুরুর মর্যাদা ’’ কবিতায় বিষয়টি সুন্দর করে শিক্ষকদের সম্মান তুলে ধরেছেন। শিক্ষকের কত সম্মান, কবি তাঁর লেখা কবিতার প্রতিটি ছন্দে যেন ফুঁটিয়ে তুলেছেন। মধ্য যুগের অন্যতম কবি শাহ্ মোহাম্মদ সগীরের কবিতায় বলা হয়েছে শিক্ষকের মর্যাদার কথা, ‘‘ ওস্তাদে প্রণাম করো পিতা হস্তে বাড়ে, দোসর জনম দিলা তিহো সে আম্বার। ’’ শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর, শিক্ষকের দেয়া শিক্ষায় একজন মানুষ প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠে । জগতে পিতা- মাতার পরই শিক্ষকের স্থান। আলোকিত মানুষ, মনুষত্বের বিকাশ ঘটানো তথা একজন মানুষ হিসেবে জীবন যাপনের জন্য দরকার প্রকৃত শিক্ষার ।এ যেন অন্ন- বস্ত্রের মতই মানুষেরও মৌলিক অধিকার। আর সে শিক্ষা অর্জন করতে অবশ্যই শিক্ষা গুরুর দরকার হয় । তাঁদের দেখানো পথই শিক্ষার্থীদের পাথেয়। শিক্ষা গুরুর দেয়া শিক্ষার মাধ্যমেই আমরা ভাল-মন্দের পার্থক্য নির্ণয় করি । আমরা তাঁদের চোখেই জগৎ দেখি । মানব সভ্যতার উন্নয়ন একমাত্র শিক্ষকের মাধ্যমেই সম্ভব এবং এটা তাঁদেরই অবদান ।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষককে অসম্মান , অবমাননা ও লাঞ্চিত হওয়ার প্রকাশিত সংবাদ দেখে এ দেশের শিক্ষক সমাজসহ প্রত্যেকেই বিস্মিত হয়েছে। আর অবমাননার কারনে রচিত হয়েছে শিক্ষক সমাজের কলঙ্কিত অধ্যায়। শিক্ষককে মানুষ গড়ার কারিগর বলা হয় । সমাজে আমরা কোন না কোন ভাবে শিক্ষকের শিক্ষার্থী । যিনি একটি মাত্র অক্ষর শিক্ষা দিয়েছেন তিনিও একজন শিক্ষক । পিতা-মাতা জন্মদাতা হলেও প্রকৃত মানুষ গড়ার দায়িত্ব অর্পিত হয় একজন শিক্ষকের উপর। শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। আর সে মেরুদন্ড দন্ডায়মান রাখার দায়িত্বটুকু পালন করেন শিক্ষক । এ জন্য স্বয়ং স্রষ্ঠাই তাঁদেরকে মর্যাদার মুকুট পড়িয়েছেন । আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) বলেছেন, ‘‘ তোমরা জ্ঞান অর্জন কর এবং জ্ঞান অর্জনে আদব, শিষ্ঠাচার শিখো তাঁকে সম্মান কর যার থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন কর।’’ এক সময়ে ভারতের শিক্ষা সচিব তাঁর প্রাইমারী শিক্ষা গুরুকে কদমবুচি করে একজন ছাত্র হিসেবে শিক্ষককে সম্মান করার সাক্ষর রেখেছেন। তেমনি ভাবে তিনি শিক্ষা গুরুর মর্যাদাকে আরও বেশি মর্যাদাশীল করে তুলেছেন । একজন শিক্ষার্থী যখন অতিসম্মানী ব্যক্তি হয়ে শিক্ষাগুরুর কদমবুচি করেন তখন সে শিক্ষকের অন্তর কত যে আনন্দে ভরে উঠে তা একমাত্র জানেন মহান সৃষ্টিকর্তা এবং জানেন সেই শিক্ষক।

আমি নিজেও এক সময় শিক্ষকতা করেছিলাম । আমার সে সময়ের কিছু শিক্ষার্থীর মধ্যে অনেকেই এখন সমাজে মর্যাদাশীল ব্যক্তি। তারা যখন আমাকে সামনে দেখে বিনয়ের সাথে সম্মান করে , সালাম জানায় তখন আমার অন্তরে কি আনন্দ বয়ে যায় , সেটা একমাত্র আমি আর সৃষ্টিকর্তা ছাড়া অন্য কারো উপলদ্ধি করার মত নয় । একদিন আমার একজন শিক্ষক আমাকে কাছে টেনে বললেন , তুমি বলত আমি কি পাগল? আমি বললাম স্যার, আপনি কেন এ কথা বলছেন, আমি কি আপনার সাথে বেয়াদবী করেছি ? স্যার তখন আমাকে তাঁর একজন ছাত্রের নাম বললেন, যে তাঁকে পাগল বলেছিলেন এবং এ কথা বলে কেঁদে ফেললেন । আমার চোখ দিয়েও তখন অজান্তে অশ্রু বর্ষন হয়েছিল । আমি স্যারকে অনুরোধ করলাম স্যার, আপনি আপনার ঐ ছাত্রকে মাফ করে দিবেন । বর্তমান সমাজে শিক্ষার্থী কতৃর্ক শিক্ষক লাঞ্চিত হওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে। প্রাথমিক পর্যায় হতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষক লাঞ্চিত হওয়ার ঘটনা পত্রিকায় প্রতিনিয়ত প্রকাশিত হচ্ছে। অভিভাবককে বেঁধে রেখে মহিলা শিক্ষককে ধর্ষণ করার খবরও পত্রিকায় দেখা গেছে। পারিবারিক কলহের জের ধরেও মিথ্যা অপবাদ দিয়ে শিক্ষকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করার খবরও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষকের অমর্যাদা, অপমান এর প্রকাশিত খবর পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষার্থীর ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, যা সংশ্লিষ্ট সকলকে এখন থেকে ভাবতে হবে। গুরুকে অসম্মানের ধৃষ্টতা আগে কখনও কেউ দেখেছি বলে মনে হয় না। আর বর্তমান সমাজে আমরা এ সব কি দেখছি ? আগামীতে এর পরিণাম কি হবে, তা এখন ভাববার বিষয় ।

শিক্ষকের সম্মান রক্ষার নজির ইতিহাসের পাতায় দেখা যায় । শিক্ষকগণ সব সময় সম্মানের আসনে আসীন । জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখমুজিবুর রহমান এঁর সুযোগ্য কন্যা ও বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে তাঁরই শিক্ষক ড. নীলিমা ইব্রাহীম কে দেখতে পেয়ে সব প্রটোকল ভেঙ্গে তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করলেন এবং দোয়া নিলেন । এতেই প্রমাণিত হয় শিক্ষকগণ কত সম্মানের । প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক তাঁর শিক্ষককে সম্মান প্রদর্শন যেন সমস্ত শিক্ষকগণের মর্যাদা পাওয়ার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত । কিন্তু জাতির বিবেক সে শিক্ষকগণের মুখেই আজ শুনতে হয় তাঁদের নির্যাতনের কাহিনী, যখন লাঞ্চিত শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের মুখে শোনা যায় এদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কর্তৃক নির্মমভাবে লাঞ্চিত করার কথা, কান ধরে উঠবোস করানোর কথা। এর চেয়ে লজ্জা আর কি হতে পারে ! যা কোন ভাবে মেনে নেয়া যায় না । ভবিষ্যতে শিক্ষকদের উপর এ ধরনের মানহানিকর ঘটনা আর যা‘তে কেউ ঘটাতে না পারে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।। এ ধরনের যে কোন অনাকাঙ্খিত ঘটনার সুষ্ট তদন্ত সাপেক্ষে যাচাই এর ব্যবস্থা নিয়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে ।

মানুষ গড়ার কারিগর এ শিক্ষকগণের মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার। কারন শিক্ষকগণ এ সমাজেরই অংশ, তাঁরাও অপরাধ করতে পারে এবং অনেকেই করছেন । মাঝেমধ্যে পথভ্রষ্ঠ কিছু দূঃশ্চরিত্র শিক্ষককের অপকর্মের খবর পত্রিকায় পাওয়া যায় । যা শিক্ষক সমাজের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক । তাদের এ অপকর্ম শিক্ষকদের সম্মানের অপর কালিমা লেপন করে । এ ধরনের দুঃখজনক অবস্থা থেকে শিক্ষকদের বের হতে হবে। শিক্ষকের এ ধরনের অপরাধ গোটা শিক্ষক সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কয়েক দশক ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ও সংস্থার মধ্যে মত বিনিময়ের পর জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থা, ইউনেস্কো এবং আই এল ও কর্তৃক ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবরে গৃহীত ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে শিক্ষকদের সম্মানের স্বীকৃতি স্বরূপ ৫ অক্টোবর কে ‘ বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ ঘোষণা করা হয় এবং পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে সংযোজিত প্রাথমিকভাবে উচ্চস্তরে পাঠদানকারি শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের অধিকার করনীয় ও মর্যাদা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদের স্মারক হিসেবে দিনটি ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস ’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। যা নিঃসন্দেহে শিক্ষকগণের মর্যাদারই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। যুগে যুগে শিক্ষকগণের মর্যাদা সবার উপরে আসীন থাক এ প্রত্যাশাই রইল ।

 

লেখকঃ  সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে