মীর কাসেম

বিডি নীয়ালা নিউজ (০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬)-ডেস্ক রিপোর্টঃ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। শনিবার রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে গাজীপুরে অবস্থিত কাশিমপুর কারাগার-২ এ ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। দণ্ড কার্যকরের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের এ কথা জানান। আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শেষে কারা কর্তৃপক্ষ রাতেই মীর কাসেম আলীর লাশ তার জন্মস্থান মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর থানার চালা গ্রামে পাঠিয়ে দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর পাহারায়।

মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে গতকাল শনিবার বিকেলে মীর কাসেম আলীর সাথে পরিবারের সদস্যরা শেষ দেখা করেন। এর আগে বিকেল ৩টায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর বিষয়ক সরকারের নির্বাহী আদেশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কারাগারে পৌঁছায়। গত শুক্রবার মীর কাসেম আলী কারা কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেন তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে মার্জনার আবেদন করবেন না।
পারিবারিক সূত্র জানায়, গতকাল সকালে কারা কর্তৃপক্ষ তাদেরকে মীর কাসেম আলীর সাথে দেখা করার জন্য খবর দেয়। দুপুর সাড়ে ১২টায় মনিপুর রহমত মঞ্জিল থেকে কাশিমপুর কারাগারের উদ্দেশে রওনা দেন পরিবারের সদস্যরা। মীর কাসেম আলীর পরিবার ও নিকটাত্মীয় মিলে ৪৫ জন সদস্য পৌনে ৪টায় কারাগার চত্বরে পৌঁছেন। বিকেল ৪টা ৩৫ মিনিটের সময় মীর কাসেম আলীর স্ত্রী খোন্দকার আয়েশা খাতুন, মেয়ে সুমাইয়া রাবেয়া, তাহেরা তাসনিম, ছেলের বউ সাইয়্যেদা তাহমিদা আক্তার ও তাহমিনা আক্তার, বড় ভাই ডা: মীর নাসিম আলী, ভাতিজা, ভাতিজীসহ ২৫ জনকে কারাগারের ভিতরে নিয়ে যায় কর্তৃপক্ষ। মীর কাসেম আলীর সাথে সাক্ষাৎ শেষে ৬টা ৪০ মিনিটের সময় তারা কারাগার থেকে বের হয়ে আসেন।
মীর কাসেম আলীর পরিবারের একজন সদস্য নয়া দিগন্তকে জানান, শেষ সাক্ষাতের সময় তিনি ধীরস্থির স্বাভাবিক এবং শান্ত ছিলেন। তার মনোবল অটুট ছিল। তবে নিখোঁজ ছেলে আরমানের জন্য তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
কারাগারের সামনে থেকে আমাদের প্রতিনিধি জানান বেলা ১টা ৪০ মিনিটে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল ইকবাল কাশিমপুর কারাগারে প্রবেশ করেন। সন্ধ্যা ৭টায় কারাগারে প্রবেশ করেন কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন।
রাত সাড়ে ৯টায় গাজীপুর জেলা প্রশাসক এস এম আলম ও সিভিল সার্জন ডা: আলী হায়দার খান কারাগারে প্রবেশ করেন। এর আগে রাত ৮টা ৫০ মিনিটে কারাগারে তিনটি অ্যাম্বুলেন্স প্রবেশ করে। তা ছাড়া সেখানে আগে থেকেই অবস্থান করছিলেন পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ।
দণ্ড কার্যকর উপলক্ষে কারাগার এলাকায় সকাল থেকে কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয় বিপুল র‌্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য নিয়োগের মাধ্যমে। কারা ফটকের সামনের সব দোকানপাট বন্ধ করে দেয়া হয়। ঢাকা ও গাজীপুরে বিজিবি মোতায়েন করা হয়।
মীর কাসেম আলীর আগে চলমান যুদ্ধাপরাধ মামলায় যে কয়জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে তার সবগুলো হয়েছে রাজধানীর নাজিমউদ্দিন রোডের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। বর্তমানে এই কারাগার কেরানীগঞ্জে স্থানান্তর করা হয়েছে।
গত ৩০ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ মীর কাসেম আলীর রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেন। এর ফলে চূড়ান্ত রায়ে মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেন।
ওই দিনই রিভিউ আবেদন খারিজের লিখিত রায় প্রকাশিত হয় এবং ট্রাইব্যুনাল হয়ে তা কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয়। পরের দিন ৩১ আগস্ট মীর কাসেম আলীকে রায় পড়ে শোনানো হয় এবং তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে মার্জনা চাইবেন কি না জানতে চাওয়া হয়। মীর কাসেম আলী কারা কর্তৃপক্ষকে জানান, তিনি তার ছেলে ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেমের (আরমান) সাথে এ বিষয়ে পরামর্শ করতে চান (৯ আগস্ট থেকে আরমান নিখোঁজ রয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে সাদা পোশাকধারীরা আরমানকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গেছে)। এরপর ১ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার আবারো কারা কর্তৃপক্ষ মীর কাসেম আলীর কাছে মার্জনা বিষয়ে জানতে চাইলে পরের দিন শুক্রবার তিনি জানিয়ে দেন তিনি মার্জনার আবেদন করবেন না।
১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মীর কাসেম আলীকে মৃত্যুদণ্ড দেন ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর।
মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ১৪টি অভিযোগ আনা হয় ট্রাইব্যুনালে। এর মধ্যে ১০টি অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ট্রাইব্যুনালের রায়ে দু’টি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। অপর আটটি অভিযোগে তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়।
ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে মীর কাসেম আলী আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। গত ৮ মার্চ আপিল বিভাগের রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ডের দু’টি অভিযোগের মধ্যে একটি থেকে তাকে খালাস দেয়া হয় এবং একটিতে সাজা বহাল রাখা হয়।
এ ছাড়া ট্রাইব্যুনালে দোষী সাব্যস্ত অপর আটটি অভিযোগের মধ্যে আপিল বিভাগের রায়ে দু’টি অভিযোগ থেকে মীর কাসেম আলীকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
৩০ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে রিভিউ আবেদন খারিজের মাধ্যমে এ মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হয় এবং একই সাথে এ মামলার আইনি কার্যক্রমও শেষ হয়। প্রধান বিচারপতি ছাড়া পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমান।
যে অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড : যে অভিযোগে মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ডের সাজা বহাল রাখা হয়েছে সেটি ছিল ১১ নং অভিযোগ। এ অভিযোগে বলা হয়েছে ১৯৭১ সালে নভেম্বর মাসের কোনো এক দিন মীর কাসেম আলীর পরিকল্পনায় জসিম উদ্দিন নামে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে ঈদুল ফিতরের পর দিন অপহরণ করে চট্টগ্রাম শহরের ডালিম হোটেলে নিয়ে আসা হয়। মীর কাসেম আলীর নির্দেশে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা তাকে নির্যাতন করে হত্যা করে। পরে জসিমসহ আরো পাঁচজনের লাশ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেয়া হয়। জসিমের সাথে অপর যে পাঁচজনের লাশ নদীতে ফেলা হয় তারাও ডালিম হোটেলে বদর বাহিনীর নির্যাতনে নিহত হয়।
এ অভিযোগে মীর কাসেম আলীকে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড দেন। আপিল বিভাগের রায়েও এ দণ্ড বহাল রাখা হয়। আর রিভিউ আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ায় চূড়ান্তভাবে বহাল রইল ১১ নং অভিযোগের দণ্ড।
২০১২ সালের ১৭ জুন মীর কাসেম আলীকে মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর নির্দেশে। পরে মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-২ এ পাঠানো হয়।
মীর কাসেম আলীর পক্ষে আপিল বিভাগে আইনজীবী ছিলেন সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন, অ্যাডভোকেট এস এম শাহজাহান, ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন, ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম প্রমুখ।
রাষ্ট্রপক্ষে এ মামলায় আইনজীবী ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
মীর কাসেম আলীর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি : মীর কাসেম আলী ১৯৫২ সালে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর থানায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মীর তাইয়েব আলী। তিনি ১৯৬৫ সালে গণপূর্ত অধিদফতরের বিভাগীয় হিসাবরক্ষক হিসেবে ফরিদপুর থেকে চট্টগ্রামে বদলি হন। বাবার চাকরির সুবাদে ১৯৬৫ সাল থেকে মীর কাসেম আলী চট্টগ্রাম শহরে বসবাস শুরু করেন পরিবারের সাথে। তিনি ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং ১৯৬৭ সালে এসএসসি পাস করেন। ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ওই কলেজে পদার্থ বিজ্ঞানের অনার্সে ভর্তি হন। ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। মীর কাসেম আলী পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম এ পাস করেন।
রাজনৈতিক জীবনে মীর কাসেম আলী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাথে যুক্ত এবং এ দলের নির্বাহী পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। রাজনীতির অঙ্গন ছাড়াও একজন সংগঠক ও উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যাংকিং, চিকিৎসা, শিক্ষা, আবাসন, গণমাধ্যম, পর্যটন, পরিবহন খাতসহ আর্থ সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে মীর কাসেম আলীর নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রয়েছে। মীর কাসেম আলী দুই ছেলে ও তিন কন্যাসন্তানের জনক।

ন/দি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে