………………………………….মোঃ আঃ মান্নান: লোকগীতি মানুষ কোন স্কুলে শিখে না, স্মৃতিই হলো তাদের লোকগীতি শেখার বড় যন্ত্র। ছোটরা ছড়া ও জাতীয়গীত, তরুনেরা প্রেমমূলকগীত এবং বয়স্করা বা প্রবীণরা আধ্যাত্মিক বা রহস্যবাদমূলক গীত পছন্দ করে এবং মেয়েরা পছন্দ করে তাদের পছন্দের গীত। আর এভাবে নানা গীত থেকে লোকগীতি অগ্রসর হয়ে প্রকৃতির উদার আবহাওয়ার সংগীতে সরলতায় এর আবেদন সাধারন মানুষের হৃদয়ে স্পর্শ করে। প্রকৃতপক্ষে খাঁটি লোকগীতি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ হিসেবে কালের স্রোতে প্রবাহিত হয়ে আসছে। আমরা জানি গানের মাধুর্য বর্ণনায় উৎকর্ষে নয়, সুরলালিত্যে। আদিকাল থেকে আমাদের দেশের নানা অঞ্চলে লোকগীতি, কবিগান, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া গান গীতিকার ও শিল্পীগণ নানা বিষয়বস্তু নিয়ে চিত্তবিনোদনের জন্য রচনা করে আসছেন। লোক সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতই লোক ঐতিহ্য নিয়ে এগুলো গান বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন রূপ নিয়েছে। রংপুর অঞ্চলে লোকগীতির গানের রূপ, ভাওয়াইয়া গান। এ গান রংপুর ছাড়াও দেশ ও বিদেশে জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছে এবং কিছু গুণী মানুষের হাতে পড়ে তা পরিবর্তিত হয়ে নানা বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এমনি একজন বরেণ্য শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার হলেন নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার পুটিমারী গ্রামে জন্ম নেয়া ভাওয়াইয়া শিল্পী ও ভাওয়াইয়া গানের প্রাণপুরুষ বাবু মহেশ চন্দ্র রায়। ১৯১৯ সালের ১ ফেব্রæয়ারি বাবা, বাবুরাম রায় ও মাতা বিমলা রানী রায়ের ঘরে জন্ম নেয়া এক কিংবদন্তি। জন্মের ৫/৬ বছর বয়সেই তাঁর বাবা তাঁকে স্থানীয় গ্রাম্য পাঠশালায় ভর্তি করান। ৩ বছর সেখানে লেখাপড়া শেষ করে তিনি কিশোরীগঞ্জ বহুমুখী মডেল হাই স্কুলে ভর্তি হন। নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস, মাত্র ১১/১২ বছর বয়সেই শিল্পীর মা মারা গেলে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহনের সমাপ্তি ঘটে। মায়ের মৃত্যুর পর স্থানীয় গ্রাম্য যাত্রা ও কীর্তন দলে যোগ দেন শিল্পী মহেশ চন্দ্র রায় এবং অল্প সময়ের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেন তিনি। কিন্তু বাবা বাবুরাম রায় ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তৎকালিন নীলফামারী মহকুমার প্রবীণ আইনজীবি বাবু সুরথ কুমার ঘোষের তত্ববধানে শিল্পীকে রেখে আসেন। এখানে থাকতেই ঘটনাচক্রে পরিচয় ঘটে ‘ভারতবর্ষ অবতার’ পত্রিকার লেখক অধ্যাপক তাঁরা প্রসন্ন মুখোপধ্যায় ও লেখক বলাই দেব শর্মার সাথে। তাঁরা উভয়ই শিল্পীকে পুরাতন পুঁথি সংগ্রহ করে তা ধারণ করতে বলেন। শিল্পী তাদের পরামর্শক্রমে পুঁথি সংগ্রহ করে এর আলোকে কণ্ঠে ধারণ করেন অনেক গান। এরপর বাবু সুরথ কুমার ঘোষের মৃত্যু হলে মহেশ চন্দ্র রায় শহর ছেড়ে নিজ গ্রামে ফিরে আসেন। এর কিছুদিন পর গান গাওয়ার সুবাদে তিনি নীলফামারী সদর থানার জয়চন্ডি গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সুযোগ পান। সেখানে ২ বছর শিক্ষকতা শেষে নীলফামারীর সংগলসী ইউনিয়নের দীঘলডাংগী গ্রামের গগন চন্দ্র রায়ের কন্যা, বীণাপানি রায়ের সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয়ে শ্বশুর বাড়ীতেই স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৩৪৯ বঙ্গাব্দে স্ত্রী বীণাপানির মৃত্যু হয়। শিল্পী তখন ২টি নাবালক সন্তান নিয়ে বিপদে দিনাতিপাত করতে থাকেন এবং ১৩৫০ বঙ্গাব্দে কামিনী বালাকে বিয়ে করে পুনরায় সংসার শুরু করেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, তাঁর ২য় স্ত্রীও ৪ সন্তান রেখে মারা যান। এরপর মহেশ চন্দ্র রায় মা হারা সন্তানদের লালন-পালন এবং তাদের বড় করে তোলার পর শেষ বয়সে সরলা বালা নামে এক বিধবাকে স্ত্রী রূপে গ্রহন করেছিলেন।
শিল্পীর জীবনে এতসব ট্রাজেডির পরও উত্তরবঙ্গের জনপ্রিয় লোকসংগীত ভাওয়াইয়া গান লেখা ও তা গাওয়া কোনটাই তিনি ছাড়েন নি। তিনি তাঁর লেখা ভাওয়াইয়া গানকে নিজের সুর দিয়ে এমনভাবে সাঁজিয়েছেন যা আজ অবধি কোন শিল্পী তাঁর গানের সুরের কোন ধারা পরিবর্তন করতে পারেনি এবং করলেও বিকৃত সুর বলে শ্রোতা সাধারন তা অগ্রাহ্য করেছে। যে কারণে শিল্পী মহেশ চন্দ্র রায় আজও সবার মাঝে খ্যাতিমান হিসেবে নিজেকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন।
গুণী এ শিল্পীর লেখা, সুর করা ভাওয়াইয়া গানের এ বিশাল ভান্ডার, ভাওয়াইয়ার সমৃদ্ধ বিরাজমানতা ও তাঁর নানা দিক উম্মোচনের আন্তরিক প্রয়াসের সাথে যুক্ত করে নিজের দৃৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বিশ্লেষণ এবং লোকজ উপাদান ও উদাহরণগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করছি। চেনা-জানা যেসব লোকজীবন নিয়ে মহেশ চন্দ্র রায় তাঁর গানগুলো রচনা করেছেন সেগুলোর আঞ্চলিক ভাষা এবং কথ্য ও আঞ্চলিক ভাষা এবং সেগুলোর যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে গুণী এ শিল্পীর মনের গভীরের কথাগুলোকে সরল ভাষায় তিনি ভাওয়াইয়া প্রেমীদের জন্য তুলে ধরছেন। যুগ চেতনা যেমন তেমনি মানবিক বেদনাও। সত্য সুন্দরের প্রকাশ অপ্রিয় হলেও তা প্রকাশ করতেই হয়।
যুগে যুগে কিছু মানুষ আসে, যাদের সৃষ্টিকর্ম প্রকাশের কোন ব্যবস্থা থাকে না, তা যতই সুন্দর হোক কিংবা যতই আকর্ষনীয় হোক তা কখনই প্রকাশ পায় না। শিল্পী মহেশ চন্দ্র রায়ের লেখা, সুর করা ও তা প্রচার মাধ্যমে (বেতারে) প্রচার হলেও এক সময় তা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। মহেশ চন্দ্র রায়ের লেখা এরূপ কিছু হারিয়ে যাওয়া ভাওয়াইয়া গান যা তিনি নিজে সুর করেছেন এবং গেয়েছেন, এ গানগুলো শিল্পী গ্রাম বাংলার মানুষের চিরায়ত প্রেম-ভালবাসা, সুখ-দুঃখ, বেদনা-, আশা আকাংখাসহ ধর্মকর্মের কথায় সাঁজিয়ে অন্তরের অন্তরস্থল থেকে অত্যন্ত আবেগ ও দরদ দিয়ে গেয়েছেন যা কোন শিল্পী এককভাবে করতে পেরেছেন কি না আমার কাছে অজানা। তিনি লিখেছেন গ্রাম বাংলার অবলা নারীর বিবাহের পর গরুরগাড়ীতে চড়ে শ্বশুর বাড়ীতে যাওয়ার সময় বাপের বাড়ী আর একবার দেখার আকুতি এবং ছোট ভাই-বোনের কথা, মায়ের কান্দোনের কথা গানের মাধ্যমে বুঝাতে গাড়িয়ালকে কাকুতি-মিনতি করে গাড়ী ধীরে চালানোর অনুরোধ- এরূপ একটি গান-
ধীরে বোলান গাড়ী মোর গাড়িয়াল….
আস্তে বোলান গাড়ী…..
আর এক নজর দেখিয়া নেও মুই
দয়াল বাপের বাড়ীরে গাড়িয়াল
আস্তে বোলান গাড়ী…।
ভাওয়াইয়া গানের যে পাঁচটি শ্রেণির কথা বলা আছে, মহেশ চন্দ্র রায় তাঁর রচিত গানে, দীঘলনাসা সুরই ব্যবহার করেছেন বেশি। ভাওয়াইয়া গানের বিবরিত গ্রামীণ জীবনচিত্র এবং অনবদ্য লোকজ উপদান, প্রকৃতি আপন বৈশিষ্ঠ্যে দৃষ্টিগ্রাহ্য। ভাওয়াইয়ায় শরীরের বহুভঙ্গিমার বিবরণ আকর্ষনীয় ও যথাযথ। এমনি ধারার আর একটি গান উল্লেখ করা হলো-

তিস্তা নদীরে…
এই কি রে তোর খেলা
ভাসেয়া দিনু
সাধের ডিঙ্গা…
মোক থুইয়া একেলারে
মোক থুইয়া একেলা।
শিল্পী এখানে নদী ভাঙ্গা, বাস্তভিটা হারা অসহায় গরীব মানুষের আবেগের কথা তুলে ধরেছেন। তিনি এখানে গ্রাম বাংলার সাধারন অশিক্ষিত মানুষের অন্তরের বেদনার কথাগুলোকে তাদের প্রাণের ভাষায়, আবেগের ভাষায় তুলে ধরেছেন তাঁর লেখা গানে যেখানে অকাতরে উঠে এসেছে সেই ভয়াল নদীর তীরের বাস্তভিটা হারা মানুষের আবেগের সাথে বলা কষ্টের কথা।
ভাওয়াইয়া গান, নানা শ্রেণিতে বিভাজিত। ভাওয়াইয়ার সুর ও ভাবগত বৈশিষ্ঠ্য বিচার করে পাঁচটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন ভাওয়াইয়া লেখক-হরিশ্চন্দ্র পাল। ভাওয়াইয়া গানের নায়ক চরিত্র কেন্দ্রিক ভাগ হলো, গাড়ীয়াল বন্ধুর গান, মাহুত বন্ধুর গান, মইশাল বন্ধুর গান, চেংড়া বন্ধুর গান ও বানিয়া বন্ধুর গান। এ সব গানে নারী-পুরুষের জীবন ধারা ও ভাবনা গভীরভাবে রূপায়িত হয়। এ সব ধারণ করেই ভাওয়াইয়া সমৃদ্ধির সুবাতাস বইছে আমাদের সমাজে। এক সময়ের গ্রামীণ সৃষ্ট ভাওয়াইয়া গান আলপথ থেকে রাজপথে এবং অবশেষে বিশ্বের সংস্কৃতিতে স্থান করে নিয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ভাওয়াইয়া গান জননন্দিত হয়ে আরও ব্যাপক প্রসার লাভ করবে। আর এর আজকের সমৃদ্ধি অর্জনে শিল্পী মহেশ চন্দ্র রায়ের নাম বাদ দেয়ার কোন সুযোগ নেই। ভাওয়াইয়া গানের এ মহান শিল্পী ১৯৯৩ সালে ২৯ জানুয়ারি ৭৫ বছর বয়সে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। কিশোরগঞ্জ উপজেলা শিল্পীর জন্মস্থান হলেও এখানে শিল্পীকে ঘিরে কোন সংগঠন গড়ে উঠে নাই। আগামীতে শিল্পীকে স্মরণীয় করে রাখতে শিল্পীর স্মৃতি রক্ষার্থে এখানে একটি প্রতিষ্ঠান করা অত্যন্ত জরুরী। স্থানীয় প্রশাসন ও নেতৃবৃন্দ এ ব্যাপারে দৃষ্টি দিবেন এ প্রত্যাশা রাখছি।

লেখক ও সাংবাদিক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে