ডেস্ক রিপোর্ট :কিছুদিন আগে আমার বরের এক বন্ধুর বাসায় বেড়াতে যাচ্ছিলাম। যাওয়ার আগে ওই বন্ধুর ছেলের জন্য একটা খেলনা কেনার জন্য মার্কেটে গেলাম। দোকানে অনেকগুলো পুতুল ছিল, কিন্তু সেগুলোর দিকে আমরা ফিরেও তাকালাম না। ছেলে শিশুর জন্য খেলনা গাড়ি, উড়োজাহাজ, ফুটবল জাতীয় খেলনার কথাই আমাদের মাথায় ছিল। অতএব একটি খেলনা গাড়ি কিনলাম।ওই ছেলে শিশুটির জন্য আমরা কিন্তু একটা পুতুলও কিনতে পারতাম। কিন্তু কিনলাম না। কেন? কারণ, পুতুল আমরা মেয়ে শিশুদেরই খেলনা হিসেবে দিয়ে থাকি বেশি। পুতুলকে মনে করা হয় মেয়ে শিশুদের খেলনা।আমার তিন বোনের পাঁচটি ছেলে, তাদেরকে কখনও আমি পুতুল নিয়ে খেলতে দেখিনি।আবার, আমার এক বান্ধবীর মেয়েকে দেখতে গিয়ে খেয়াল করেছিলাম, শিশুটির জন্য আত্মীয়-স্বজনরা যতগুলো উপহার এনেছিল, তার সবই ছিল পুতুল। ছিল না কোন গাড়ি, উড়োজাহাজ, হেলিকপ্টার, ফুটবল বা ফিশিং গেম জাতীয় খেলনা!এমনকি আমরা নিজেরাও ওই মেয়ে শিশুটির জন্য একটা পুতুলই নিয়ে গিয়েছিলাম!আমি বলছি না যে, দুনিয়ার সব শিশুর বেলায় এমনটিই ঘটছে, নিশ্চয়ই এর ব্যতিক্রমও ঘটছে কোথাও কোথাও।আমাদের সমাজে একটা বদ্ধমূল ধারণা আছে যে, মেয়েরা জন্মগতভাবেই একটু নরম-শরম স্বভাবের হয় আর ছেলেরা হয় একটু ডানপিটে স্বভাবের। এমনকি, একটি ছেলে শিশু ও একটি মেয়ে শিশুর আচার আচরণ লক্ষ্য করলেও এমন চিত্রই ফুটে ওঠে হয়তো।অস্বীকার করছি না, ছেলে আর মেয়ে শিশুর মধ্যে দৃশ্যমান একটি পার্থক্য আছে, সেটি শুধুই শারীরিক। কিন্তু মানুষের শরীর তো পরিচালিত হয় মস্তিষ্ক দ্বারা। আর এই মস্তিষ্কে শিশুকালেই ঢুকিয়ে দেয়া হয়, নারী-পুরুষ বিভেদ।আমার শৈশবের দিকে ফিরে তাকালে দেখতে পাই, আমাকে কখনও গাড়ি বা ফুটবল জাতীয় খেলনা দেয়া হয় নি। আমার শৈশব কেটেছে হাড়ি-পাতিল, পুতুল, বৌচি, গোল্লাছুট খেলা খেলেই।

একটু বড় হওয়ার সাথে সাথে শিশুর খেলনাও বদলে যায়। ছেলে শিশুদের দেয়া হয় সাইকেল জাতীয় খেলনা আর মেয়ে শিশুদের দেয়া হয় হাড়ি-পাতিল জাতীয় খেলনা।সাইকেল বা রিকশা জাতীয় খেলনা দিয়ে শুরুতে ছেলে শিশুরা ঘরের মধ্যেই ছুটোছুটি করে এবং পরবর্তীকালে তাদের পদচারণয় মুখর হয় মহল্লার মাঠ অথবা বাড়ির সামনের রাস্তাটি। এভাবেই ছেলে শিশুটি ঘরের বাইরে চলাফেরায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।অন্যদিকে, যে মেয়ে শিশুটিকে খেলনা হিসেবে দেয়া হয়েছিল, হাড়ি-পাতিল, সে ইটের ভাঙা টুকরা আর বালি দিয়ে ভাত-তরকারি রান্নার খেলা খেলতে খেলতে এক সময় নিজের মায়ের হেঁশেলের দায়িত্বটাও তুলে নেয় নিজের কাঁধে।

আর এভাবেই, কন্যা শিশুরা অন্দরমহলে নিজের অবস্থানটাও পাকাপোক্ত করে ফেলে।খেলনা বস্তুটিকে আমরা যত হালকা ভাবে দেখি না কেন, বিষয়টা কিন্তু ততটা হালকা নয়।এই খেলনাই শিশুর মানসিক বিকাশে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে এবং তাদের ক্যারিয়ার বা পরবর্তী জীবন পরিকল্পনাকে প্রভাবিত করছে।

গবেষণা বলছে, মেয়ে শিশুদের পুতুল জাতীয় খেলনা দিয়ে আমরা তার মস্তিষ্ককে বুঝিয়ে দিচ্ছি যে, তোমার কাজ ঘর-কন্না সামলানো বা সৌন্দর্য চর্চা করা। আর ছেলে শিশুদের গাড়ি জাতীয় খেলনা দিয়ে, তাকে বুঝিয়ে দেয়া হয় যে, বড় হয়ে তুমি গাড়ি চালাবে, প্রকৌশলী হবে বা নতুন কিছু উদ্ভাবন করবে এই যে শিশুদের মস্তিষ্কে অল্প বয়সেই লিঙ্গ বৈষম্য ঢুকিয়ে দেয়া হয়, পরবর্তীকালে সেটাই হয়তো বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।গবেষণা বলছে, যেসব শিশু নারী-পুরুষ বিভেদ বা বৈষম্য পূর্ণ পরিবেশে বড় হয়, পরবর্তীতে তারাই নারী-পুরুষের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে বেশি। এ তো গেল শুধু খেলনার কথা। পোশাকও যে কতভাবে শিশুর মধ্যে নারী-পুরুষ বিভেদ তৈরি করে দিচ্ছে, আমরা হয়তো তা খেয়ালই করি না।

মনে করার চেষ্টা করুন তো, ছেলে শিশু আর মেয়ে শিশুদের পোশাক কেমন হয়! আমার বিশ্বাস, মেয়ে শিশুদের পোশাকের কথা ভাবলেই আপনার চোখে ভেসে উঠবে অনেক সুন্দর সুন্দর ফুলেল নকশার বা লেইস-ফিতা ও কুচির বাহুল্যে তৈরি কোন পোশাক। আর ছেলে শিশুদের পোশাক হয় খুব সাধারণ।অর্থাৎ, পোশাকের মাধ্যমে একটি মেয়ে শিশুর মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেয়া হয় যে, “তুমি মেয়ে, তোমাকে সবসময় সেজে গুজে সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসে থাকতে হবে।”পক্ষান্তরে, ছেলে শিশুদের পোশাক ফুলেল নকশা বা লেইস-ফিতা ও কুচির বাহুল্য বর্জিত হয়। কারণ পোশাকের মাধ্যমে তাকে বুঝিয়ে দেয়া, ” নিজেকে সুন্দর করে রাখা তোমার কাজ নয়, তোমার কাজ উদ্ভাবন করা, নির্মাণ করা, অ্যাকশনধর্মী কাজ করা”।

এমনকি শিশুদের খেলনা বা পোশাকের রং নির্বাচনের ক্ষেত্রেও কিন্তু বিভাজন করা হয়। মেয়ে শিশুদের জন্য পছন্দ করা হয় পিংক বা একটু লালচে রং আর ছেলে শিশুদের জন্য পছন্দ করা হয় নীল বা নীলের কাছাকাছি কোন রং।শিশুর মস্তিষ্ক খেলনা বা পোশাকের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়া এসব বার্তা গ্রহণ করে অনায়াসে। যার ফল স্বরূপ আমরা দেখতে পাই, নারীরা উদ্ভাবন, উন্নয়ন, যন্ত্র কৌশল এর চাইতে সৌন্দর্য চর্চা বা সংসারের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে বেশি।ঘরের একটি বাতি জ্বলছে না, পাশের বাড়ির ছেলেটিকে ডেকে আনছি তা সারানোর জন্য। অথচ, এসব ছোট-খাটো বৈদ্যুতিক কাজ কিন্তু মেয়েরাও করতে পারে অনায়াসে।

অতএব, বাচ্চা কাঁদছে বলে, তার কান্না থামানোর জন্য আপনি যে খেলনাটি তার হাতে তুলে দিচ্ছেন, তা ভেবে চিন্তে দিন। আপনি চাইছেন, আপনার মেয়েটি বড় হয়ে পাইলট হবে, অথচ খেলতে দিচ্ছেন শুধু পুতুল!আবার আপনি চাইছেন আপনার ছেলেটি শান্ত-শিষ্ট স্বভাবের হোক, কিন্তু খেলার জন্য তার হাতে তুলে দিচ্ছেন রোবট অথবা ভিডিও গেম!মস্তিষ্কের সাথে শিশুর বোঝাপড়াটা যে ঠিক মত হচ্ছে না!আমাদের মেয়েরা কিন্তু এখন আর শুধু রান্না-বান্না আর ঘরকন্না সামলানো নিয়েই বসে নেই। তারা ঘর-সংসার সামলানোর পাশাপাশি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পুলিশ, বৈমানিক, সাংবাদিক থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরণের চ্যালেঞ্জিং পেশাই গ্রহণ করছে।

তেমনি, অনেক পুরুষই কিন্তু এখন চাকরি করার পাশাপাশি ঘরে মায়ের কাজে বা বউয়ের কাজে সাহায্য করছে। তবে, এই সংখ্যাটা খুবই সীমিত।কর্মক্ষেত্রে প্রায় সবখানেই পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা কম। তেমনি, খুব কম সংখ্যক পুরুষই পরিবারে মা বা বউয়ের কাজে সাহায্য করে।এখনও রান্না করা বা সন্তান সামলানো পুরুষদের নিয়ে ঠাট্টা করে অন্য পুরুষরা। এসব কাজকে পুরুষালি স্বভাবের বিরুদ্ধে দাঁড় করায় কেউ কেউ।ওই যে, শৈশবে মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, পুতুল মেয়েদের খেলনা আর গাড়ি ছেলেদের খেলনা। সমস্যা তো ওখানেই। ওখান থেকে তো বের হয়ে আসতে পারছে না বেশিভাগ পুরুষই।কদিন আগে আমার এক পরিচিত নারী অভিযোগ করলেন, তার স্বামী সংসারে একটুও সময় দেয় না। তার শিশুপুত্রটির অসুখ-বিসুখ, খাওয়ানো-পড়ানো সব দায়িত্বই পালন করে ওই নারী একা।আমি তার বাসায় গিয়ে দেখলাম তার শিশুপুত্রটি বিছানায় নানা রকমের গাড়ি নিয়ে খেলছে। ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, ওর কোন পুতুল নেই কেন? আমি ছেলে শিশুটিকে একটা পুতুলও কিনে দিতে চাইলাম।

ভদ্রমহিলা কোনোভাবেই তার শিশুপুত্রের জন্য পুতুল কিনতে দিলেন না। তিনি এক কথায় বলে দিলেন, তার ছেলে পুতুল খেলতে পছন্দ করে না। এর আগেও আমি কয়েকজন ছেলে শিশুর মায়ের সাথে কথা বলে দেখেছি, বেশিভাগ মা’ই চায় না তাদের ছেলেটি ঘর-কন্নার খেলা খেলুক।অথচ তারা আশা করেন, তাদের স্বামীরা ঘর-কন্নার দায়িত্ব পালন করুক। কীভাবে সম্ভব?আজকের ছেলে শিশুটিই তো আগামী দিনের স্বামী অথবা বাবা। কিন্তু, আমরা মায়েরাই তো আমাদের পুত্রটিকে তেমন দায়িত্ববান স্বামী অথবা বাবা হিসেবে গড়ে তুলতে চাইছি না! প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই প্র্যাকটিস অব্যাহত রয়েছে। আর কত? ভাবুন না, নিজের শিশু পুত্রটিকে নিয়ে?

বি/বি/সি/এন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে