বাড়ি রাজশাহী বার বার কেন বাঁধ ভাঙছে?

বার বার কেন বাঁধ ভাঙছে?

17
0

ডেস্ক রিপোর্ট : নওগাঁর রানীনগর উপজেলার ঘোষগ্রাম নাম স্থানে ভেঙে গেছে বেড়িবাঁধ। ছবি: স্টারমেইলনদী তীরে নির্মিত বাঁধ বা বেড়িবাঁধ মানুষজনের ভরসাস্থল হলেও এবার একের পর এক বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বাঁধ ভেঙে বন্যার কারণে মারা যাচ্ছেন মানুষজন। ভেসে যাচ্ছে গবাদি পশু ও বসতবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা। বিভন্ন আলোচনায় পানি উন্নয়ন বোর্ডর সমালোচনা থাকলেও এবার বাঁধ ভাঙার ক্ষেত্রে সংস্থাটির একক দোষ দেখছেন না বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, বিভিন্ন কারণে এবার এমন সংকট দেখা দিয়েছে।

টানা বর্ষণে ভারতের আসাম ও নেপালের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি প্রভাবে উত্তরাঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা, ধরলা, আত্রাইসহ অন্যান্য প্রধান নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে দেশের বিভিন্ন জেলায় ভেঙে গেছে অসংখ্য বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণসচিব ১৭ আগস্ট বুধবার জানিয়েছেন, বন্যায় ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ২১ জেলার ৩২ লাখ ৮৭ হাজার মানুষ। তলিয়ে গেছে ১ লাখ ৭২ হাজার ২১৭ হেক্টর ফসলি জমি, নদীগর্ভে সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে ৮ হাজার ১৪০টি ঘরবাড়ি। ভয়াল এ বন্যায় প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৩৭ জন মানুষ। যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসেবে বন্যায় মৃত্যের সংখ্যা ৫৮

বিশ্লেষকরা বলছেন, এবার বাঁধ ভেঙে বন্যার কারণ কেনো একক মানদণ্ডে ব্যাখ্যা করা মুশকিল। তবে নিয়মিত রক্ষাণাবেক্ষণ আর দক্ষ লোকবলের অভাব বড় কারণ হতে পারে।

বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্যই নদী তীরে বাঁধ নির্মাণ করা হয়, কিন্তু বন্যার সময় কেন ভাঙে এমন প্রশ্নের জবাবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামন প্রিয়.কমকে বলেন, ‘এটাকে এক কথায় তো বলা যাবে না। তবে বাঁধের অবকাঠামোগত স্থাপনাগুলোর সমস্যা থাকতে পারে। কিন্তু যখন স্রোতের মাত্রা অতিরিক্ত হয় তখন উচিত হবে এগুলো দেখাশোনা করার।’

তবে যথাযথ তদারিক অভাবে এ বাঁধ ভাঙার মতো ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে করেন পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক। তিনি প্রিয়.কমকে বলেন, ‘আগে পানি উন্নয়ন বোর্ডে অনেক লোকবল ছিল। কিন্তু এক সময় বলা হলো, এদেরকে আর দরকার নেই। স্থানীয় লোকজনই বাঁধ দেখাশোনা করবে। ফলে ইঁদুরের গর্ত হচ্ছে। মানুষে ভাঙছে সেটা দেখার কেউ নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে আগে বলা হতো শ্বেত হস্তি। নেগেটিভ বিষয় মাথায় রেখে লোকগুলোকে ছাঁটাই করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর যেখানে ২৪ হাজার মানুষ ছিল, এখন এখানে সাত থেকে আট হাজার মানুষ আছে। বাংলাদেশের কোনো বিভাগে এমন করে সংকুচিত হয়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাঁধ তদারকি বিষয়টা আবার একা পানি উন্নয়ন বোর্ডর নয়। স্থানীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, জেলা প্রশাসনসহ সবাই তদারকি করে। সবার ওপরই দায়ভার বর্তায়। এটা আসলে কারও একার দায়িত্ব নয়। আর তদারকি করতে হলে আগের লোকবল দরকার ছিল। সেই লোকবল দিয়ে বোর্ড তদারকি করতে পারত। নির্মাণ হলেই তো সব শেষ নয়। এরপর তো অনেক কাজ থাকে। দৈনন্দিন রক্ষণাবেক্ষণের দরকার আছে।’

‘তবে বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডের ব্যর্থতা বলা যেতে পারে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাঠ পর্যায়ে লোকবল থাকলে অনেক জায়গায় হয়তো এমন সংকট নাও ঘটতে পারত’, যোগ করেন প্রকৌশলী ইনামুল হক।

বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে একই রকম কথা বলেছেন ড. ইফতেখারুজ্জামানও। তিনি বলেন, ‘বাঁধ দেখাশোনা করা শুধু পানি উন্নয়ন বোর্ডের একার দায়িত্ব নয়। এটা আসলে সংশ্লিষ্ট সকলের।’

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, বাঁধ ভাঙার জন্য ইঁদুরকে দায়ী করা হচ্ছে। কিন্তু ইঁদুরের কারণে তো বাঁধ ভাঙতে দিতে পারা যায় না। কিংবা ব্রিজ ভাঙতে দিতে পারা যায় না। এর মধ্যে অবকাঠামো রিলেটেড বিষয়ে দুর্বলতা থাকতে পারে।’

এ বিষয়ে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও পানি বিশেষজ্ঞ ড. ফিরোজ আহমেদ প্রিয়.কমকে বলেন, ‘বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রোপারলি যেভাবে কাজ করার কথা সেভাবে না করার কারণে এটা হতে পারে। আবার অনেক সময় আছে, বন্যার আকার অনেক বড় হলে বাঁধ ভাঙতে পারে। একটা বাঁধের ডিজাইন করা হয় নিদিষ্ট সময়ের মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে। তখন নির্ধারণ করা হয় বাঁধ কতটুকু করা হবে, কীভাবে করা হবে, কত বছরের জন্য হবে। সাধারণত ২০ বছর, ৫০ বছর কিংবা ১০০ বছর মাথায় রেখে বাঁধের ডিজাইন করা হয়। এই সময়ের পর যদি পানির চাপ বাড়ে তাহলে তাহলে তো এমনিই ভাঙবে। যত ভালো বাঁধই হোক না কেন।’

আমাদের দেশে বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণে সমস্যা আছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ফিরোজ বলেন, দেশে যেভাবে বাঁধ তৈরি হয় আমার মনে হয় প্রক্রিয়াটা ঠিক মতো হয় না। বাঁধ নির্মাণ করার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হয়, সেগুলো ঠিকমতো অনুসরণ করা হয় না। এরপর বাঁধ নির্মাণের পরে কিছু ঘাষ লাগিয়ে দেওযার কথা সেটাও ঠিকমতো লাগানো হয় না। বহুরকম সমস্যা। তদারকির করা হয় না। ইদুর গর্ত করলে তো পানির চাপ পড়লেই বাঁধ ভেঙে যাবেই। সেটাও দেখাশোনা করা হয় না।’

তিনি বলেন, ‘বাঁধ ভাঙার অনেক কারণ আছে। কারণের শেষ নেই। বিভিন্ন বাঁধ বিভিন্ন কারণে ভাঙে। এটাকে কেস বাই কেস আসলে দেখার দরকার। তবে বাঁধগুলো ভাঙার কতগুলো কমন কারণ থাকতে পারে। সেগুলো চিহ্নিত করে সেই ব্যাপারে পরবর্তীতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।’

এবার হাওর অঞ্চলে বাঁধ ভাঙা নিয়ে প্রশ্ন তুলে এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘হাওর অঞ্চলে বাঁধে বিভিন্ন অনিয়ম ধরা পড়েছে। এর কারণে এটা ভেঙেছে। ঠিকমতো কাজ করা হলে বাঁধ হয়তো ভাঙতো। তবে যে সময় ভাঙছে সেসময় ভাঙার কথা না। কিন্তু বড় রকমের বন্যা হলে ভাঙতেই পারে। কাজ প্রোপারলি করা হয়নি আর কি।’

বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে কেউ দোষী হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করেন ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বাঁধ ভাঙার বিষয়ে উচিত হবে আইনি প্রক্রিয়ায় অনুসন্ধান চালানো। অনুসন্ধান চালিয়ে দোষীদের চিহ্নিত করা। আর যদি কেউ দোষী হয় তার শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এটা না হলে কিন্তু চলতেই থাকবে ভাঙন।’

প্রি/ড/ক


একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে