ডেস্ক রিপোর্ট : বাঁশের নিখুত কারিগর ধনঞ্জয় রায় (৭২)। তাঁর নিজস্ব শৈল্পিক চেতনায় বাঁশ দিয়ে নিজ হাতে করছেন নানা কারুকার্য। এসব শৈল্পিক কর্ম বলে মানুষের জীবনের অনেক কথা। জাগরিত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, প্রকাশ করে মানুষের প্রতি ভালোবাসা। বাঁশের তৈরি এসব কারুকার্য যেন এক জীবন্ত ছবি।
নীলফামারী জেলা সদর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে পলাশবাড়ী ইউনিয়নের খলিশাপচা গ্রামে তাঁর বাড়ি। এলাকার মানুষ তাঁকে চিনেন ডাকো সাধু নামে। বাঁশের তৈরি ওই শিল্পকর্ম এলাকায় বাড়িয়েছে তাঁর সুনাম। এখন ছোটবড় সকলের কাছে পরিচিত বাঁশের দক্ষ শিল্পী হিসেবে।
এক সময়ে তিনি ছিলেন বাঁশ দিয়ে ঘরবাড়ি তৈরির কারিগর। তাঁর নিখুত হাতের ছোয়ায় উজ্জল সাজে সজ্জিত হতো অনেকের ঘরবাড়ি। বাঁশের ঘর তৈরিতে সৌখিন মানুষের কাছে ছিল তাঁর কদর। ওই বাঁশের কাজ করতে করতে উজ্জীবীত হয় তাঁর শিল্প চেতনা। সেই চেতনার খেয়ালে কাজের ফাঁকে বাঁশে হাতের ছোয়া লাগিয়ে তৈরি করেছেন জাতীয় স্মৃতিসৌধ, শহীদমিনার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওই মানুষটি বাঁশদিয়ে তৈরি করেছেন মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্য, মুক্তিযোদ্ধা আর পাকসেনার প্রতিকৃতি। এসব প্রতিকৃতি সাজিয়ে ফুটিয়ে তুলে মুক্তিযুদ্ধ। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রতিকৃতি তৈরি করে প্রকাশ করেছেন বঙ্গবন্ধুর প্রতি অকৃতিম ভালোবাসা। শুধু তাই নয়, শিল্পীর মন দিয়ে দেখেছেন গ্রামবংলার দৃশ্য। তাঁর নিজের খেয়ালে ওই বাঁশ দিয়ে তৈরি করেছেন গ্রাম বাংলার নৌকা, মাঝি, গায়ের বধু, কুমির, হরিণ, ময়ুরসহ নানা ধরনের পশুপাখি, শিশুদের পাঠশালা, জাতীয় পতাকা। তাঁর হাতে এসব প্রতিকৃতি সাজানো হলে শিশুরা খুব সহজেই বুঝতে পারেন মুক্তিযুদ্ধ।
মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাক পাকহানাদার বাহিনীর পরাজয়, আত্মসমর্পণের দৃশ্য তুলে ধরেছেন তিনি। এসব শিল্পকর্ম খুব সহজেই নজর কাড়ে ছোট বড় সকল মানুষের। তাঁর শিল্প কর্ম দেখতে নিজ গ্রাম ছাড়াও দূরদুরান্তের অনকে মানুষ ছুটে আসেন শিল্পীর গ্রামের বাড়িতে।
গত শনিবার বিকেলে তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে বাঁেশর তৈরি এসব শিল্পকর্ম ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হয়েছে বাড়ির আঙ্গিনা ও ঘরের বারান্দায়। ছিমছাম ওই বাড়িতে এসময় দেখা গেছে শিল্পী নিজ হাতে কাপড় দিয়ে বাঁশের তৈরি স্মৃতিসৌধটি পরিস্কার করছিলেন। উজ্জল শিল্পকর্ম, তাঁর চেতনাও উজ্জল, কিন্তু উজ্জল ওই শিল্পের শিল্পী এবং তাঁর বাড়িঘরে দেখাগেছে দৈন্যতার ছাপ।
তিনি জানান, দরিদ্রতার সাথে সংগ্রাম করে বড় হতে হয়েছে তাঁকে। পঞ্চম শ্রেণীতে লেখাপড়া শেষ করেই পরিবারের অভাব অনটনে নামতে হয়েছে দিনমজুরীর পেশায়। সে পেশায় এক সময়ে বাাঁশের কাজে দক্ষ হন তিনি। এ দক্ষতায় ডাক পড়তো বাঁশের বাড়িঘর তৈরির কাজে। সে সময়ে আঞ্চলিক নাম ‘ছকরবন’ (বাঁশ দিয়ে ঘর বানানোর কারিগর) হিসেবে পরিচিত হন তিনি। তাঁর কাজের নৈপুণ্যতায় অনেক সৌখিন মানুষের বাড়িঘরের কাজে ডাক পড়তো সেসময়ে। কাজের ফাঁকে মনোনিবেশ করেন বাঁশের শিল্পকর্মের দিকে। সে সময়ে সামান্য দিনমজুরীর আয়ে সংসার চালিয়েও সেখান থেকে তিল তিল করে গড়ে তুলেন ওই শিল্প ভা-ার।
দিন কেমন কাটছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কোনভাবে বেঁচে আছি ভগবানের কৃপায়।’ এসময় লক্ষ্য করা গেছে, ওই শিল্পীর বয়সের ভারেরসাথে আর্থিক দৈন্যতায় হতাশার ছায়া নেমে এসেছে জীবনে।
কথা প্রসঙ্গে তাঁর জীবনের দৈন্যতা তুলে ধরে বলেন,‘বাড়ির ভিটের ১৯ শতক আর দেড় বিঘা আবাদী জমি নিয়ে আমার জীবন। বর্তমানে আয়ের একমাত্র উৎস এলাকার হালির বাজারে ছেলে প্রদীপের পানের দোকান। আগে যে দিনমজুরীর কাজ করতাম এখন বয়সের ভারে আর সেটিও করতে পারছি না। বাড়িতে বসে বাঁশের জিনিসপত্র তৈরী করছি। পশুপাখি ছাড়াও বিভিন্ন মুর্তি তৈরি করে বিক্রি করছি। কিন্তু যে দাম পাই তাতে বাঁশের দাম মিটিয়ে তেমন কিছু থাকে না। আমার মূলধন থাকলে বাঁশের তৈরি শিল্পকর্ম শহরে বিক্রি করে লাভ করতে পারতাম।’
ধনঞ্জয় রায়ের মেজ ছেলে প্রদীপ রায় (৪০) বলেন, ‘আমরা তিন ভাই। বড় ভাই সুভাষ চন্দ্র রায় (৪৫) এবং সবার ছোট নিরঞ্জন রায় (৩৫) আলাদা বাড়িতে বসবাস করছেন। আমি বাবারসাথে থেকে কাজ শিখে এখন বাবার কাজে সহযোগীতা করছি। পাশাপাশি একটি পানের দোকানের সামান্য আয়ে মা-বাবাসহ স্ত্রী এবং আমার চার কণ্যা সন্তান নিয়ে কোনভাবে দিন কাটাচ্ছি।’
ধনঞ্জয় রায়ের স্ত্রী সুন্দরী বালা রায় (৬৫) বলেন,‘আমার স্বামীর সুনাম ছড়িয়েছে চারিদিকে। অনেক দুর দুরান্তের লোকজন আসেন আমার বাড়িতে। স্বামীর কাজ দেখে সকলেই মুগ্ধ হন। কিন্তু অভাবের সংসারে আমারা খুবই কষ্টে আছি।’
খলিশাপচা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা জিতেন্দ্র নাথ রায় (৬৫) বলেন,‘আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি নয় মাস। আর আমাদের বাঁশের শিল্পী ধনঞ্জয় রায় তাঁর শিল্পকর্মের মধ্যদিয়ে সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন সারাজীবন। তাঁর নিখুত হাতের ছোয়ায় বাঁশের তৈরি মুক্তিযুদ্ধের শিল্পকর্ম আমাদেরকে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছে। ভবিষৎ প্রজম্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগরিত করছে।’
ধনঞ্জয় রায় থেকে ডাকো সাধু সেখান থেকে বাঁশের শিল্পী
শিল্পের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই ওই শিল্পীর। যা করছেন, তা শিখেছেন নিজের বুদ্ধিচর্চা করে। কাজ করতে করতেই নিজ খেয়ালেই বাঁশের শিল্পকর্ম চেপে বসে তাঁর মাথায়। আর তাঁর জীবনটা অনেকটাই খেয়ালীর।
জীবনের কথায় তিনি বলেন,‘বিভিন্ন খেয়ালে কেটে যাচ্ছে আমার জীবন। বাঁশের কাজ করতে করতে ওই বাঁশ দিয়ে বিভিন্ন শিল্প কর্মের চর্চা করি আমি। এক পর্যায়ে সেটি ছেড়ে সন্নাস জীবনের খেয়াল চাপে আমার। ওই খেয়ালে বাড়িঘর ছেড়ে বিভিন্ন মন্দিরে কাটাই জীবনের ১৪টি বছর। সেখান থেকে পরিচিত হই ডাকো সাধু হিসেবে। এখনও এলাকার মানুষ আমাকে ডাকে ডাকো সাধু বলে। এক পর্যায়ে ওই সন্নাস জীবন ছেড়ে সংসার জীবনে ফিরে আবারো মনোনিবেশ করি বাঁশের কাজে।’
শিল্পীর বাড়ির যোগাযোগ
জেলা শহর থেকে পশ্চিম দিকে নীলফামারী-নীলসাগর পাকা সড়কে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে হালির বাজার। সেখান থেকে উত্তরে দুই কিলোমিটার দূরে ধনঞ্জয় রায়ের বাড়ি। বাড়িতে যেতে পাড়ি দিতে হবে খানিকটা কাচা সড়ক।
পলাশবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মমতাজ আলী প্রামানিক বলেন, ‘ডাকো সাধুর ডাক সব সবখানে আছে। তিনি বাঁশের নিখুতভাবে বাঁশের করেন, না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না। কিন্তু একমাত্র পুঁজির অভাবে তার শিল্পের বিকাশ ঘটছেনা। আমি তাঁর বাড়িতে অনেকবার গেছি। সাধ্যমতো সহযোগিতা করেছি।

বি/এস/এস/এন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে