সিরাজগঞ্জ থেকে ,মারুফ সরকারঃখোকা নেই বলে মা তুমি কেঁদনা, আমরা সবাই বাঙালি- যেখানে থাকি যতদূরে মায়ের ভাষাই কথা বলি-আমরা সবাই বাঙালি, আমার মায়ের মতন মা ত্রিভূবনে ঘুরে আমার চোখে পড়েনা, জনতা জেগেছে জনতা-এরকম প্রায় ছয় হাজার গানের গীতিকার হাসান আনোয়ার আজ অনাহারে-অর্ধাহারে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।নুন আনতে পানতা ফুরায় অবস্থার পাশাপাশি সিরাজগঞ্জ শহরের দিয়ার ধানগড়া মহল্লার একটি ঝুপড়ি ঘরে সন্তানদের নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন বলে জানা গেছে । এমন একজন গীতিকারের এ অবস্থা দেখে মানুষ হতবম্ব হয়ে গেছে ।মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নিয়ে লেখা হাসান আনোয়ারের ‘খোকা নেই বলে মা তুমি কেঁদনা’ গানটি প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর এলেই সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন সংগঠনের শিল্পীদের কণ্ঠে ঢেউ তোলে। এতে বিমোহিত হয় দর্শকরা। তার আরও একটি বিখ্যাত গণসঙ্গীত ‘জনতা জেগেছে জনতা’ দেশের বিভিন্ন মঞ্চে গেয়ে প্রতিবাদ জানায় শিল্পীরা।সিরাজগঞ্জের কৃতি সন্তান বিশিষ্ট কবি, সুরকার ও গীতিকার হাসান আনোয়ার। পরিচিতজনরা অবশ্য আনোয়ার নামেই চেনেন-জানেন। তিনি পল্লী গীতি, ছড়াগান, দেশের গান, আধুনিক, গণসঙ্গীতসহ প্রায় সব ধরনের গান লেখেন।তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা, মুক্তিযোদ্ধা, শেখ রাসেল, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী, মোহাম্মদ নাসিম, অধ্যাপক ডা. হাবিবে মিল্লাত মুন্না এমপি, সেলিনা বেগম স্বপ্না আওয়ামী লীগসহ বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে প্রায় তিন শতাধিক গান লিখেছেন। তার এ পর্যন্ত লেখা গানের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ছয় হাজারের মতো।এছাড়াও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিভিন্ন দলীয় প্রাথীদের গুণকীর্তন করে গান লিখে দিয়ে দেন বিনা পারিশ্রমিকে। যা নির্বাচনের দিনগুলোতে বিভিন্ন জনবহুল রাস্তার মোড়ে মোড়ে, দোকান, হোটেলে ক্যাসেট প্লেয়ারে বেজেছে। এছাড়াও সিরাজগঞ্জের নাট্যচক্র, দুর্বার নাট্য গোষ্ঠী, জহির রায়হান থিয়েটার, ভাসানী সঙ্গীত বিদ্যালয়, সানফ্লাওয়ার কিন্ডার গার্টেন, পাবনার সঙ্গীত বিদ্যা বিথীর সূচনা সঙ্গীত হাসান আনোয়ার লিখেছেন।হাসান আনোয়ার সিরাজগঞ্জ জেলার পরিচিতিমূলক সংগীতসহ বঙ্গবন্ধু সেতুর উদ্বোধনী সঙ্গীতও লিখেছেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের উন্নয়নমূলক কথামালা দিয়ে তার লেখা গান সিরাজগঞ্জ সদর, কাজীপুরসহ বিভিন্ন জেলায় পরিবেশন করা হয়েছে।সম্প্রতি কাজিপুরে শহীদ এম. মনসুর আলী সাংস্কৃতিক উৎসবে শহীদ এম. মনসুর আলীকে নিয়ে হাসান আনোয়ারের বিনা পারিশ্রমিকে লেখা গান শুনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম আবেগে আপ্লুত হন এবং আয়োজন সংগঠনকে নগদ এক লাখ টাকা পুরস্কার দেন। এখান থেকেও হাসান আনোয়ার পায়নি কোনো সহযোগিতা।গত ৭ বছর আগে প্রায় ২ লাখ টাকা ধার-দেনা করে হাসান আনোয়ার তার মেয়ে সঞ্চিতা হাসান ও সুমিতা হাসানকে বিয়ে দেন। এই ঋণ তিনি এখনও পরিশোধ করতে পারেননি। যে কষ্টটি তাকে সবসময় তাড়িয়ে বেড়ায়।জানা যায়, ১৯৯০’র দশকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সভামঞ্চেও হাসান আনোয়ার লেখা ‘এবার পাটে হলো সর্বনাশ, কৃষক ঘরে হাহুতাশ, বাঁচবে কি আর বাঁচা, বনমালী তুমি আর জনমে হইয়ো চাষা’ উদ্বোধনী সঙ্গীত হিসেবে পরিবেশন করা হয়। এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বর্তমান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ও সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত মোতাহার হোসেন তালুকদার। এছাড়াও ১৯৯০ দশকে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ওবায়দুল কাদের সিরাজগঞ্জে ছাত্রলীগের সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে হাসান আনোয়ারের ৯টি জাগরণমূলক সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়।প্রধান অতিথির বক্তব্যে ওবায়দুল কাদের তার লেখা গানের প্রশংসা করে বলেছিলেন, আমি সারা বাংলায় ঘুরেছি কিন্তু কোথাও এক গীতিকারের এত সুন্দর গান দিয়ে এ রকম অনুষ্ঠান করতে দেখেনি। সুদিনে ও দুর্দিনে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সকল অঙ্গসংগঠনের অনুষ্ঠানগুলোতে তার লেখা গান ছাড়াও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় না। অথচ এ রকম অসংখ্য গানের গীতিকার হাসান আনোয়ারের ভাগ্যে জোটেনি কোনো সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা।শুধু তাই নয় ১৯৯৮ সালে জিয়া রায়হান নিদের্শিত প্যাকেজ প্রোগ্রাম ‘কান পেতে শোন’ বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। এ অনুষ্ঠানের সবগুলো গানই ছিল হাসান আনোয়ারের লেখা। অনুষ্ঠানে মো. খোরশেদ আলম গেয়েছেন ওমা তোর বাংলাতে আজ একটি মুজিব চাই, ইয়াসমিন মুস্তারী গেয়েছেন সোনা আমার জাদুরে আমার আয় ফিরে আয় শোন, কৃষ্ণচুড়া পলাশ বকুল ডাকে তোরে ফাল্গুন ও শাম্মী আখতার গেয়েছেন খোকা নেই বলে মা তুমি কেঁদোনা ও সৈয়দ আব্দুল হাদী গেয়েছেন সুখেও হাসো-দুখোও হাসা মাগো তুমি আর কেঁদোনা-আছে তোমার লক্ষ কোটি সোনায় সোনা মুক্তিসেনা।তার লেখা গান সুর করে সিরাজগঞ্জে’র শিল্পী আজাদ খানকে দিয়ে গাইয়েছেন বিখ্যাত সুরকার প্রনব ঘোষ। তার গান জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী মনির খান ও সিরাজগঞ্জের কৃতি সন্তান জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী কনকচাঁপাও গেয়েছেন। তার লেখা গানগুলোর অপূর্ব শব্দের গাঁথুনি, গতিশীল ছন্দ, দর্শক হৃদয়ে খুব সহজেই আসন করে নেয়।১৯৯৮ সালে জাতীয় শিশু-কিশোর প্রতিযোগিতায় হাসান আনোয়ারের লেখা ‘আমার মায়ের মতন মা ত্রিভূবনে ঘুরে আমার চোখে পড়েনা’ সিরাজগঞ্জের মেয়ে সোমা সেন গান গেয়ে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন।হাসান আনোয়ার ২০১৬ সালের শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আর্থিক সহযোগিতার জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু আজও তার ভাগ্যে জোটেনি সেই আর্থিক সহযোগিতা। পরবর্তীতে সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল লতিফ বিশ্বাস, সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আবু মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবে মিল্লাত মুন্না এমপির সুপারিশকৃত আরও একটি সাহায্যের আবেদন পুনরায় প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে।অনল প্রবাহের কবি সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজীর পবিত্র জন্মভূমি সিরাজগঞ্জ পৌরসভার দিয়ার ধানগড়া গ্রামে জন্মগ্রহণকারী হাসান আনোয়ারের মনের মানুষের অন্যত্র বিয়ে হয়ে যাওয়ায় লোহার ইস্পাতের সাহায্যে বোর্ড পেপারে প্রথম গান লেখা শুরু করেন। উৎসাহিত হন অনুপ্রেরণা পান অনল প্রবাহের কবি সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর বাড়িতে পবিত্র ওরশ মুবারক থেকে। গান বাজনা হচ্ছে, তাদের গান শুনে সবাই মুগ্ধ। হাসানের মনের মধ্যে স্বপ্ন জাগে গান লেখার। আরেকটি অনুপ্রেরণা পান ভাসানী মিলনায়তনে নাটক দেখে। টিকেট কেনার টাকা ছিল না। কিন্তু নাটক তাকে দেখতেই হবে। ওঠে পড়লেন হলরুমের বারান্দায়। দেয়ালের ভেন্টিলেটর দিয়ে দেখলেন নাটকে পরিবেশিত গান দেখে পুরোদমে শুরু করলেন গান লেখা। সৃষ্টিতেই যাদের আনন্দ তারা সবাই কাউকে না কাউকে অনুসরণ করে থাকেন। হাসান আনোয়ারও এর ব্যতিক্রম নয়। গৌরী প্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দোপ্যাধায়, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল তার অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব।জীবনের শেষ প্রান্তে এসে হাসান আনোয়ার বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান এবং বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও শেখ রাসেলকে নিয়ে তার লেখা গানগুলো প্রধানমন্ত্রীর হাতে দিতে চান এবং তাঁর লেখা গানগুলো যেন বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে প্রচারিত হয় সেটাও তিনি দেখে যেতে চান।এ বিষয়ে সিরজাগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফজল-এ-খোদা লিটন বলেন, যে দেশে গুণীর কদর হয় না সে দেশে গুণী জন্মাতে পারে না। স্বাধীনতার পক্ষের সৈনিক সিরাজগঞ্জের প্রতিভাবান গীতিকার হাসান আনোয়ার বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা, শেখ রাসেল ও শহীদ এম. মনসুর আলীসহ আওয়ামী লীগের উন্নয়নমূলক কথা দিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে অসংখ্য গান লিখেছেন। ইতোপূর্বে আর্থিক অনুদানের জন্য ৫ বার জেলা প্রশাসন ও শিল্পকলা একাডেমীর মাধ্যমে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করেছিলেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত তিনি কোনো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো সহযোগিতা পাননি। যা অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা।সিরাজগঞ্জ সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক শেখ ইমরান মুরাদ জানান, গীতিকার হাসান আনোয়ার একজন প্রতিভাবান মানুষ। সিরাজগঞ্জের অধিকাংশ সাংস্কৃতিক সংগঠনের সূচনা সঙ্গীত তিনি লিখেছেন। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নিয়ে লেখা তার গানগুলো প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর এলেই সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন সংগঠনের শিল্পীদের কণ্ঠে ঢেউ তোলে এবং আরও একটি বিখ্যাত গণসঙ্গীত ‘জনতা জেগেছে জনতা’ দেশের বিভিন্ন মঞ্চে গেয়ে প্রতিবাদ জানায় শিল্পীরা।জীবন যুদ্ধে পরাজিত এই গীতিকার জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও তার ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি। অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করছেন হাসান আনোয়ার। সরকারিভাবে তার জন্য অনুদানের জন্য বার বার চেষ্টা করেও আমরা ব্যর্থ হয়েছি।

বি/বি/সি্/এন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে