monkey

নীলফামারী প্রতিনিধিঃ তাঁর এ সফর বড় দীর্ঘ। তাঁকে দেখে কেউ দেয় পূজা, কেউ করে তাড়া। কারও মনে তিনি জাগান ভক্তি, কারও মনে তাঁকে ঘিরে অপার কৌতূহল। গত শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে তাঁর সাক্ষাৎ পেলাম। নীলফামারীর চাড়ালকাটা নদীর কিছু পরেই কচুকাটা বাজার। বাজারের আগে রাস্তার পাশে তিনি সম্ভবত নাশতা সারছিলেন। তাঁকে দেখতে জড়ো হয়েছে শ খানেক নর-নারী-শিশু-বৃদ্ধ। এক বেলুনওয়ালা আর এক আচার বিক্রেতাও চলে এসেছেন কোথা থেকে। জায়গাটায় মেলার আমেজ। রাস্তার ওপর ভিড় সরিয়ে সরিয়ে গাড়ি চলাচল করাতে হচ্ছে। কেউ তাঁর অঙ্গভঙ্গি দেখে হাসছে, কেউবা চিৎকার করে কিছু বলছে। তিনি কোনো দিকে কর্ণপাত না করে গাছের পাতা খেয়ে চলেছেন।

দিনমজুর হামিদুলের উৎসাহ বেশি। তিনি চিৎকার করে বলছিলেন, ‘নিচে নামিবেন না বাহে! নামিলে ভাতের থালি দিতাম।’ তাই শুনে সবিরুল নামের এক কিশোর রসিকতা করে বলে ওঠে, ‘বাড়িত নিয়া যান না কেনে? পাটি পাতি পোলাও খাওয়াইবেন!’ এসব চলতে চলতেই তিনি গাছের ওপর থেকে মূত্রপাত করে দিলেন! গা বাঁচাতে তলার লোক হুড়মুড় করে সরতে গেল। দু-একজন পারল না, তাদের গায়ে দু-এক ফোঁটা উষ্ণ গরল লেগেও গেল! একজন তো পড়ে গেল দাঁড় করিয়ে রাখা দুটি সাইকেলের ওপর। এত সব হুল্লোড়ের মধ্যেও তিনি মগডালে নির্বিকার!সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে হনুমান মহাশয়কে প্রথম দেখা গিয়েছিল দিনাজপুরের বিরামপুরের কাটলা সীমান্তের কাছে। সেই কাহিনিটা জানেন কাটলার বিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহবুবুর রহমান।

উৎসাহ নিয়ে গল্পটা বললেন, ‘এ কিন্তু একা না। এরা ছিল তিনজন। আমাদের কাটলার ওপারেই পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম দিনাজপুরের জামালপুর। সেখানটায় নরেশ নামে এক ব্যক্তির দোকানে এরা থাকত। দোকানের জিনিস নষ্ট করায় দুই পোষা হনুমানকে পেটান তাদের অভিভাবক।’
সীমান্তের এপার-ওপার গা-ঘেঁষা দুই গ্রাম। লোকজনের চলাচলও আছে। সেই নরেশের সঙ্গে কথা হয় মাহবুবের। নরেশও ছাড়ার পাত্র নন। তিনি পিছু নেন। সীমান্তের কাছেই দেখতে পান দুজনকে। কলা সাধেন, হাতের ইশারায় ডাকেন। একজনের হৃদয় নরম হয়। সে ফিরে যায়। কিন্তু অন্যজন, যিনি আমাদের এই গল্পের মূল চরিত্র, তাঁর অভিমান একটু বেশিই। তিনি ফিরলেন না। রাগ তো রাগই। দুষ্টুমি করেছে বলে পেটাবে? রাগে নরেশকেই কলা দেখিয়ে এক দৌড়ে ঢুকে পড়েন বাংলাদেশে।

কাটলা সীমান্তে তো কাঁটাতারের বেড়া। আর জিরো পয়েন্টে একটাই গেট। সেই গেটে তখন পাহারায় ছিলেন একজন মাত্র ভারতীয় সীমান্তরক্ষী। পাহারারত বিএসএফ সদস্যকে বোকা বানিয়ে তিনি ঢুকে পড়লেন বাংলাদেশে। জিজ্ঞাসাবাদ কিংবা ভিসা চাওয়ার সুযোগই পাননি কেউ। ঘটনাটা দেখেছেন কাটলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নাসির হোসেন। তিনি সাক্ষ্য দিচ্ছেন, ‘বিএসএফ কিন্তু ঠেকানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু একা বলে সামলাইতে পারে নাই। দুই দিন ছিল আমাদের এইখানে। হাজার হাজার লোক দেখতে আসত। ডাক দিলে বাসায় আসত।

ওই সময় বৃষ্টি হইছিল। তখন এক রাত কাটায় শহীদুল দরজির বারান্দায়, আরেক রাত শামসুল মিয়ার বাড়িতে। আমাদের এইখানে এ রকম আগে দেখি নাই। মেলা লাগি গেইছিল।’হনুমান হিন্দুদের দেবতা। পৌরাণিক রামায়ণে তিনি বায়ুদেবতার সন্তান এবং রামের লঙ্কা বিজয়ের অনুগত সঙ্গী। তাই এই তিন মাসে যেখানেই যে গাছে তাঁকে দেখা গেছে, হিন্দু সম্প্রদায়ের নর-নারীরা সেই গাছে প্রণাম করতেন। কলা, আপেল, জাম্বুরা সাধতেন। নাসির হোসেন যেমন বললেন, ‘কারওটা নিত, কারওটা নিত না। যারটা নিত না, সে কষ্ট পেত।’ বাজারের পর বাজারে তাঁকে নিয়ে এ রকম অনেক গল্প ছড়িয়ে আছে।

সেই যে তাঁর চলা শুরু, এখনো থামেননি। কাটলা থেকে ফুলবাড়ী। ফুলবাড়ীর পর পার্বতীপুরের রেলস্টেশনের তেঁতুলতলায়। তারপর সৈয়দপুর হয়ে নীলফামারীর রাস্তার পাশে। তাঁর গমনের অভিমুখ দক্ষিণ থেকে সরল পথে একেবারে উত্তরের দিকে। এর মধ্যে দুর্ঘটনা ঘটে। টেঙ্গনমারী বাজারে গেরস্ত যোগেন্দ্র বর্মণ বলেন, ‘অয় এক মাস আগে ছিল পঞ্চপুকুরে। সেইখানে ঘুমের ইনজেকশন মারি তাক অজ্ঞান করি ধরা হয়। গলায় জিঞ্জির (শিকল) নাগানো হয়। জানি অবাক হইবেন, সে মানুষের মতো সব বোঝে।’

স্থানীয় শামসু চেয়ারম্যানের বাড়িতে তাঁকে আটকে রাখা হয় তিন দিন। ওই সময় খাবার দিলে খেতেন না। মনমরা হয়ে থাকতেন। ইশারায় কিছু বলার চেষ্টা করতেন। শিকলের ঘষায় গলায় ঘা হয়ে গেলে মানুষের মায়া হয়। ঘায়ে মলম লাগিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। মাটি থেকে আবার তিনি উঠে বসেন গাছের ডগায়। কারও বাড়ির চালা, গাছের ডাল হয়ে একেক এলাকায় কয়েক দিন করে থাকতেন। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে তিনি ছিলেন টেঙ্গনমারীর ভূমি অফিসের কাছের এক ইউক্যালিপটাস গাছে।

তাঁর যাত্রাপথে ইতিমধ্যে অনেক গল্পের জন্ম হয়েছে। গল্প ও গুজব একসঙ্গেই জন্মায়। কেউ বলেন, হনুমানটি আসলে চলেছেন ভারতের এক সীমান্ত থেকে আরেক সীমান্তের দিকে। তাঁর গতিপথ দেখে সেটাই মনে হয়। প্রাণীরা সীমান্ত চেনে না, মানেও না। কবে কে দেশভাগ করেছে, কবে কে সীমান্তে কাঁটাতারের দেয়াল তুলেছে, সেসবের হিসাব ভারতীয় হাতি বঙ্গবীরও করেনি, এই হনুমানটিও করছেন না। কিন্তু মানুষের মতোই হনুমান নিঃসঙ্গ থাকতে পারে না। উত্তরবঙ্গের পথে পথে তাঁর নিঃসঙ্গ চলা কোথায় গিয়ে শেষ হবে, কোথায় গিয়ে তিনি পাবেন সঙ্গী-সাথি ভরা একদল হনুমান; কে জানে? তাঁর অভিমানী পথচলার সাক্ষী উত্তরবঙ্গের বহু জনপদ। এভাবে আবার হয়তো তিনি হাজির হবেন আরেক সীমান্তের না-মানুষি জমিনে।

কথাশিল্পী আনিসুল হকের না-মানুষি জমিন উপন্যাসের সেই বানরটির মতো হবে না তো তাঁর পরিণতি? রাতের অন্ধকারে না-মানুষি জমিনে হামাগুড়ি দিয়ে এগোনো সেই হনুমানকে ভুল করে মানুষ ভেবে বসবে না তো কোনো সীমান্তরক্ষী? পাশাপাশি মনে পড়ে যোগেন্দ্র বর্মণের কথা, ‘কেউ জানি তাক আর কষ্ট না দেয়!’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে