ডেস্ক নিপোর্ট : টেকনাফ থেকে নৌকায় করে থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ হওয়ায় রুট পরিবর্তন করেছে মানবপাচারকারীরা। এখন ব্যবহার করা হচ্ছে আকাশপথ। আকাশপথে চীন গিয়ে সেখান থেকে নৌকায় উঠিয়ে সাগর পাড়ি দিতে বাধ্য করছেন মানবপাচারকারীরা। আকাশ পথে ইন্দোনেশিয়া নিয়ে সেখান থেকে নৌকায় অস্ট্রেলিয়া পাঠানোর সংখ্যাও আগের তুলনায় বেড়েছে। আর রীতিমতো নতুন রেকর্ড স্থাপন হয়েছে লিবিয়া থেকে নৌকায় ইউরোপ যাত্রায়। চলতি বছর বিশ্বের যে কোনো দেশের চেয়ে বেশি বাংলাদেশি শরণার্থী হিসেবে নৌকায় ইতালি গিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। সংঘবদ্ধ চক্র এখন বাংলাদেশ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিদের ইউরোপ নেওয়ার কথা বলে লিবিয়ায় নৌকায় উঠিয়ে দিচ্ছে। ইউরোপের পাশাপাশি আমেরিকা যাওয়ার মেক্সিকো রুট আবারও যেন জেগে উঠেছে। তবে হংকং সীমান্তে এক বাংলাদেশির করুণ মৃত্যু সবকিছু ছাপিয়ে গেছে।

সূত্র জানায়, ২৪ মে হংকংয়ের উত্তর সীমান্তের একটি লাতাউ-সংলগ্ন সাগরে ঘটে মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি। লাতাউয়ের সমুদ্রপাড়ে খাড়া ওপরের দিকে উঠে গেছে পর্বত। যে কোনো পর্বতারোহীর জন্য এ ধরনের পাহাড়ে ওঠা ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু বিদেশ যাওয়ার নেশায় থাকা ছয় বাংলাদেশিকে হংকংয়ে প্রবেশ করানোর জন্য সমুদ্রে ভাসমান নৌকা থেকে ওপরের দিকে খাড়া উঠে যাওয়া পাহাড় ডিঙাতে বলা হয়। ভোররাতে সমুদ্রপৃষ্ঠের কাছাকাছি পৌঁছানোর পর পাহাড়ে উঠতে গিয়ে ছয় বাংলাদেশির একজন আনোয়ার হোসেন (৪০) ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন। পা পিছলে নিচে পড়লে পর্বতের একটি খাড়া অংশ সরাসরি আনোয়ারের পিঠ দিয়ে ঢুকে বুক দিয়ে বের হয়ে যায়। হতবিহ্বল ও ভীতসন্ত্রস্ত অপর যাত্রীদের একজন এমার্জেন্সি নম্বরে ফোন করলে তাদের উদ্ধারে সরব হয় হংকং প্রশাসন। সকাল ৮টার কিছু আগে ফোন করার পর থেকেই তাদের উদ্ধারের জন্য ঘটনাস্থলে যাওয়ার চেষ্টা শুরু করে হংকং পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজন। কিন্তু হেলিকপ্টার ব্যবহার করার পরও উত্তাল ঢেউ, বৈরী আবহাওয়া ও দুর্গম পাহাড় ডিঙিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা লেগে যায় সুপ্রশিক্ষিত উদ্ধারকর্মীদের। প্রথমে নিজেদের পর্বতারোহী দাবি করলেও পরে হংকং পুলিশ যখন মানবপাচারের বিষয়ে নিশ্চিত হয়, তখন উদ্ধার হওয়ার পাঁচ বাংলাদেশি জানান, ৩ মে দালালদের মাধ্যমে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় চীনের গুয়াংজুতে। সেখান থেকে তারা যান শেনজেন অথবা জুহাইতে। সেখান থেকে স্পিডবোট ও নৌকায় তাদের হংকং সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয়। কথা ছিল হংকং গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করার। সেখানে দালালও ঠিক করা ছিল তাদের। দালালরা প্রলোভন দেখিয়েছিলেন, কোনোভাবে হংকংয়ের আদালত রাজনৈতিক আশ্রয়ের স্ট্যাটাস অনুমোদন করলে জাতিসংঘের মাধ্যমেই উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্থানান্তর হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। চীনে আরও কয়েকজন পাকিস্তানি তাদের সঙ্গে ছিলেন বলেও জানান হংকং পুলিশের হাতে গ্রেফতার ২৪ থেকে ৩০ বছর বয়সী ওই বাংলাদেশি যুবকরা।

শরণার্থী ও অভিবাসী বিষয়ক গবেষণা সংস্থা রামরুর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. সি আর আবরার বলেন, ‘মানবপাচার থেমে নেই। মালয়েশিয়ায় পাচার কমেছে। তবে অন্য দেশগুলোতে পাচার ঠিকই হচ্ছে। ইউরোপে পাচার করার জন্য লিবিয়াকে রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার আমেরিকায় পাচারের জন্য মেক্সিকোকে রুট হিসেবে ব্যবহার করছে পাচারকারীরা। আমি যতদূর জানি, মেক্সিকোর বর্ডারে আমেরিকা অনেক কড়াকড়ি টহল দিলেও দালালরা এ পথ দিয়েই নাগরিকদের পাঠিয়ে দিচ্ছে। যাদের ভাগ্য ভালো তারা আমেরিকার পুলিশের হাতে ধরা পড়ে না। আর যাদের কপাল খারাপ তারা ধরা পড়ে যায়। তাদের জীবন কাটে জেল-জুলুমের মধ্য দিয়ে। এভাবেই দেশে দেশে মানব পাচার হচ্ছে। ’

হংকংয়ের সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদন অনুসারে, শেনজেনকে ধরে হংকংয়ে অবৈধভাবে প্রবেশের প্রবণতা গত দশকে বেড়েছে। ২০০৬ সালে বাংলাদেশি নাগরিকদের ভিসামুক্ত প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকেই এ অবস্থা। তবে অতিসম্প্রতি এ সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ চীনের গুয়াংডং প্রদেশের বড় শহর শেনজেনের অবস্থান হংকংয়ের উত্তর সীমান্ত ঘেঁষে। বাংলাদেশিরা চীনের মূল ভূখণ্ডে এসে শেনজেনে চলে যায়। সেখান থেকে মাথাপিছু ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার হংকং ডলার দালালদের দিয়ে যন্ত্রচালিত সাম্পানে চড়ে ঢুকে পড়ে হংকংয়ের তাইও এবং ফান লাউতে। প্রতিটি নৌকায় ১০ থেকে ১২ জন থাকে। হংকং পুলিশের সূত্র উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় ১১০০ বাংলাদেশি বর্তমানে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য হংকংয়ের আদালতে আবেদনরত আছেন। হংকংয়ের জন্য এ সংখ্যা বিশাল।

অবশ্য কয়েক বছর ধরেই হংকংয়ে অবৈধ অনু্প্রবেশ না করতে দেশটির অভিবাসন দফতর বাংলাদেশি নাগরিকদের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছে। হয়রানি এড়াতে এ ক্ষেত্রে কোনো সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রলুব্ধ না হতেও অনুরোধ জানান তারা। প্রতিনিধিদের ঢাকা সফরে পাঠিয়ে হংকং অভিবাসন দফতর থেকে সতর্ক করা হয় বাংলাদেশিদের। ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়, ‘হংকং সরকার কোনো রাজনৈতিক আশ্রয় দেয় না, কাউকে শরণার্থী হিসেবেও গ্রহণ করে না। কোনো টুরিস্ট হংকংয়ে কাজ করার অনুমোদনও পায় না। ’ কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। চীন হয়ে হংকং যাওয়ার সংখ্যা বাড়তেই থাকে। ২০১৫ সালে ৪১৪ জন অবৈধ অভিবাসী বাংলাদেশিকে হংকংয়ে আটক থাকলেও এখন সে সংখ্যা ১১০০। অন্যদিকে উন্নত জীবন, আকর্ষণীয় বেতনের আশায় চরম ঝুঁকি নিয়ে আড়াই হাজারের বেশি বাংলাদেশি নাগরিক দালালচক্রের হাত ধরে পাড়ি জমিয়েছে মেক্সিকোয়। গুয়াতেমালা-মেক্সিকো হয়ে আমেরিকা যাওয়ার সময় গত কয়েক বছরে আটক হয়েছেন এই বাংলাদেশিরা। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মাইগ্রেশন মেক্সিকো (আইএনএম) সমপ্রতি এক জরিপে বলেছে, ২০১১ থেকে ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে ২ হাজার ৭৯৯ বাংলাদেশি আটক হয়েছেন। অন্যদিকে আমেরিকার বর্ডার প্রটেকশন এজেন্সির হাতে গত ছয় বছরে আটক হয়েছেন দুই হাজারের বেশি বাংলাদেশি। মানবপাচার চক্র উন্নত ও সচ্ছল জীবনের লোভ দেখিয়ে স্বপ্নের আমেরিকায় পাঠাতে প্রতিজনের কাছ থেকে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা নিচ্ছে। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জাবেদ আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবপাচারের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে কড়াকড়ি অবস্থানে আছে সরকার। কিন্তু এর পরও তৃতীয় কোনো দেশে যাওয়ার কথা বলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এগুলো রোধ করতে সর্বস্তরে বাড়তি নজরদারি রেখেছে সরকার। এমনকি সন্দেহ হলে বিমান থেকেও নামিয়ে আনা হচ্ছে। এখন মানবপাচারের আইনও কঠোর করা হয়েছে। যে কোনো মূল্যে মানবপাচারের হার আরও কমিয়ে আনা হবে।

ব/প/দ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে