আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ বিদায়ী ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারে সেনা অভিযান শুরুর পর চার মাসে ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে। এত কম সময়ে এত বেশি শরণার্থী বিশ্বের আর কোথাও প্রবেশ করেনি। ফলে এ সংকট সামাল দিতে গিয়ে সরকারকে হিমশিম খেতে হয়েছে। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তোলপাড় হয়। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে মিয়ানমারের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করলে মিয়ানমার খানিকটা নড়েচড়ে বসে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে চুক্তি সই করে। বাংলাদেশের কূটনীতি মূলত আবর্তিত হয় রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে। নতুন বছরেও চ্যালেঞ্জ হিসেবে থাকছে তা।

রোহিঙ্গা সংকটের ব্যাপারে ভারতের ভূমিকা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কেননা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ও মানবাধিকার কাউন্সিলে ভারত ভোটদানে বিরত ছিল। রোহিঙ্গাদের ওপর নিষ্ঠুর নিপীড়ন চলাকালে নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমার সফর করে অং সান সু চির সঙ্গে বৈঠক করেন। রাখাইনে নিষ্ঠুরতার কোনো নিন্দা তিনি করেননি।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন ও রাশিয়া মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় বাংলাদেশে সমালোচনা হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে এসে দ্বিপক্ষীয়ভাবে সংকট নিরসনে সহায়তার আশ্বাস দেন। চীনের মন্ত্রী মিয়ানমারে গিয়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার পর রোহিঙ্গাদের ফেরাতে বিদায়ী বছরের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে অ্যারেঞ্জমেন্ট সই হয়। এই চুক্তির আলোকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন তদারকি করতে দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে প্রত্যেক পক্ষে ১৫ জন করে ৩০ সদস্য বিশিষ্ট যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়। মাঠপর্যায়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের করণীয় সুনির্দিষ্ট করে দু’ দেশের মধ্যে কার্যপরিধি সই হয়। দু’ দেশের মধ্যে সই হওয়া চুক্তির আলোকে, আগামী ২৩ জানুয়ারির মধ্যে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কাজ শুরুর কথা রয়েছে। তবে চীন ও রাশিয়া জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে নিন্দা প্রস্তাবে বাধা দেয়।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু মুসলিমরা দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। তাই বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। প্রায় তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গা আগে থেকেই বাংলাদেশে ছিলেন। ২০১৬ সালের অক্টোবরে মিয়ানমারের একটি সীমান্তচৌকিতে জঙ্গি হামলা হলে দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নয়জন সদস্য নিহত হন। তারপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে অভিযান শুরু করে। ওই সময়ে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর নিষ্ঠুর নিপীড়ন চালানো হয়। ওই সময়ে ৭৫ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন।

তারপর বিদায়ী ২০১৭ সালের আগস্টে একইভাবে মিয়ানমারের সীমান্তচৌকিতে জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ১১ জন সদস্য নিহত হন। এ ঘটনার জের ধরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অভিযান শুরু করে। অভিযানে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালায় সেনারা। তাদের হত্যা, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, নারীদের ধর্ষণসহ নানা ধরনের নিষ্ঠুর নিপীড়ন চালায়। জীবন বাঁচাতে রোহিঙ্গারা দলে দলে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে থাকে। ওই সময়ে মানবিক কারণে বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দেয়। গত চার মাসে সাড়ে ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে বর্তমানে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখের বেশি।

রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের কূটনীতির সামনে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়। বিদায়ী বছরে রোহিঙ্গা সংকট শুরুর লগ্নে সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হয়। ওই সুযোগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের নেতৃবৃন্দের কাছে রোহিঙ্গা সংকট সম্পর্কে জানানোর সুযোগ পান। সাধারণ পরিষদের ভাষণেও প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দেয়ায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসা পান শেখ হাসিনা। তারপর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে এ নিয়ে একাধিকবার আলোচনা হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের প্রেসিডেন্সিয়াল বিবৃতি দিয়ে মিয়ানমারকে সহিংসতা বন্ধ রাখার আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ মিয়ানমারকে নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে।

ঘনবসতির বাংলাদেশে এত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করায় পরিবেশ, জনশক্তি রফতানি, স্বাস্থ্য সেবা, পর্যটনসহ সার্বিকভাবে বাংলাদেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে থাকে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশের সামনে দ্বৈত চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ফেরত পাঠানো। দ্বিতীয়ত মিয়ানমারে ফেরত না যাওয়া পর্যন্ত তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা।

রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর লক্ষ্যে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক চাপ বহাল রাখার প্রতি জোর দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা। বর্তমানে আন্তর্জাতিক চাপে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে রাজি হলেও চাপ কমলে উল্টো সুর ধরতে পারে। কারণ ২০০৫ সালের পর থেকে মিয়ানমার একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয়নি।

তারা দু’ হাজার রোহিঙ্গার যাচাই সম্পাদন করেও তখন ফেরত নেয়নি। ফলে এবারও আন্তর্জাতিক চাপ কমে গেলে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে গড়িমসি করতে পারে। সে কারণে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বহাল রাখার পক্ষে বিশ্লেষকদের অভিমত। পাশাপাশি, বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করাও বাংলাদেশের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আন্তর্জাতিকভাবে ত্রাণের ব্যবস্থা করাও বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়েছে।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যেভাবে বর্বর ও নিষ্ঠুর নির্যাতন হয়েছে তাতে রোহিঙ্গাদের সেখানে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টিও গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও উগ্রবৌদ্ধরা এই হামলা চালিয়েছে। চিকিৎসকদের আন্তর্জাতিক দল ‘মেডিসিন সান ফ্রন্টিয়ার্স’ (এমএসএফ) বলেছে, ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাদের ওপর নির্বিচারে হামলা শুরু হলে প্রথম মাসেই সাড়ে ছয় হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিনিধির পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, শুধু হত্যাযজ্ঞই নয়, হত্যার ক্ষেত্রে নিষ্ঠুরতা চালানো হয়েছে।

জাতিগত নিধনের লক্ষ্যে গণহত্যা চালানো হয়েছে বলেও অনেকে মনে করেন। অনেককে পরিবারের সদস্যদের সামনে হত্যা করা হয়েছে। আবার অনেককে ঘরের ভেতরে রেখে তালাবদ্ধ করে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। রোহিঙ্গা গ্রামগুলো একের পর এক পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। নারীদের গণধর্ষণ করা হয়েছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রধান এটাকে বলেছেন, জাতিগত নিধনের পাঠ্যবই দৃষ্টান্ত। এমন পরিস্থিতিতে স্বেচ্ছায় মর্যাদার সঙ্গে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টিও নতুন বছরে বিরাট এক চ্যালেঞ্জ।

 

 

J/N.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে