ডেস্ক রিপোর্টঃ রাজধানীর শেরেবাংলানগরের শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আগুনের ঘটনা ঘটেছে। হাসপাতালের নতুন ভবনের গুদামঘর (স্টোররুম) থেকে আগুনের সূত্রপাত। রোগী স্থানান্তরের সময় এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে।  আগুনের ঘটনায় হাসপাতালের রোগী ও স্বজনদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আগুন লাগার পরপরই হাসপাতালের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। পরে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে ফায়ার সার্ভিসের ১৬টি ইউনিট। এ সময় আইসিইউ, সিসিইউসহ হাসপাতালে ভর্তি এক হাজারেরও বেশি রোগীকে দ্রুত অন্য হাসপাতালে সরিয়ে নেওয়া হয়। রাত ৮টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহমেদ খান। আগুন লাগার কারণ জানতে এরই মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে আলাদা দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ওয়ার্ড ছাড়া অন্য ওয়ার্ডের স্বাভাবিক কার্যক্রম আজ শুক্রবার সকাল থেকে শুরু হবে বলে জানা গেছে।

ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, সন্ধ্যা ৬টার দিকে হাসপাতালের একটি ভবনের তৃতীয় তলার গুদামঘর থেকে আগুন লেগে দ্রুত অন্য ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। ধোঁয়া দেখে রোগীদের অনেকেই ভয়ে ছোটাছুটি করতে থাকে। হাসপাতালে ভর্তি এক হাজারেরও বেশি রোগীকে এ সময় সরিয়ে নেওয়া হয়। রোগীদের হাসপাতাল থেকে প্রথমে সামনের করিডরে নেওয়া হয়। পরে সেখান থেকে তাদের অন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়। এর মধ্যে আড়াই শ রোগীকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।

আগুন লাগার খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান, স্বাস্থ্যসচিব আসাদুল ইসলামসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. মামুন মোর্শেদ বলেন, হাসপাতালের গুদামঘর থেকে আগুন লাগার খবর পান তিনি। এরপর দ্রুত সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। তাত্ক্ষণিকভাবে আইসিইউসহ সব বিভাগের রোগীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

এদিকে আগুন লাগার পরপরই চিকিৎসক, নার্স, মেডিক্যালের শিক্ষার্থী, পাশের শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসহ শত শত মানুষ রোগীদের সরিয়ে নেওয়ার কাজে যোগ দেয়। রোগীদের সরিয়ে নিতে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালের অ্যাম্বুল্যান্স পাঠানো হয়। গতকাল সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত শতাধিক সরকারি-বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্স বিনা পয়সায় রোগীদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে প্রায় ১২০০ রোগী ভর্তি ছিল। আইসিইউতে ছিল ১০ জন রোগী। সবাইকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে। রোগীদের কাছ থেকে জানা যায়, হাসপাতালের তৃতীয় তলার শিশু ওয়ার্ডের দিকে আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে সেটি দোতলায় ছড়িয়ে পড়ে। একটি সূত্রের দাবি, অক্সিজেন সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে পুরো এলাকা।

ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়েছে হাসপাতাল : আগুন লাগার পর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে শত শত ছাত্র, পুলিশ, র‌্যাব, ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুল্যান্স কর্মী রোগী সরিয়ে নেওয়ার কাজ করছে। সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররাই রোগীদের সরিয়ে নিতে প্রথম এগিয়ে আসে। একজন ছাত্র জানান, রোগী সরানোর সিদ্ধান্ত নিতে কিছুক্ষণ দেরি হলে প্রাণহানির শঙ্কা ছিল। ধোঁয়ায় কার্বন মনোঅক্সাইড তৈরি হয়। আগুনে নয়, এই ধোঁয়ায় রোগী মারা যেত। এক ছাত্র জানায়, আগুন লাগার খবর পেয়ে শত শত ছাত্র, চিকিৎসক, নার্স, রোগীর স্বজনরা রোগীদের সরানোর কাজে লেগে যায়।

সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের পঞ্চম বর্ষের ছাত্র রেশাদ বলেন, ‘সন্ধ্যায় হাসপাতালে আগুন লেগেছে। আগুন লাগার খবর পেয়েই আমরা এখানে চলে আসি। পরিস্থিতি দেখে আইসিইউ ও পোস্ট অপারেটিভ থেকে রোগীদের সরানোর কাজ শুরু করি আমরা। আইসিইউতে যারা ছিল তাদের অন্যান্য হাসপাতালের আইসিইউতে রাখা হয়েছে। আরেক ছাত্র সজীব জানান, যারা আইসিইউতে থাকে তাদের অক্সিজেন দেওয়া হয়।’

কলেজছাত্র মো. শাহাবুদ্দিনকে রাত ৮টার দিকে দেখা যায় এক রোগীকে অ্যাম্বুল্যান্সে তুলে দিতে। তিনি জানান, টিভিতে আগুন লাগার খবর শুনে তিনি ও তাঁর সহপাঠীরা এসেছেন সাধারণ মানুষকে সহযোগিতা করতে। ধানমণ্ডির একটি হাসপাতালে রোগী আনা-নেওয়া করেন হাজি আবুল বাশার। গতকাল একজন রোগী নিয়ে তিনি এসেছিলেন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। এসে দেখতে পান আগুন লেগেছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি অন্য অ্যাম্বুল্যান্সে রোগীদের অন্য হাসপাতালে নেওয়ার কাজে নেমে যান। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কয়েকজন রোগীকে তিনি ঢাকা মেডিক্যালসহ কয়েকটি হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছেন।

ভোগান্তি :  ৫৫ বয়স বয়সী আবদুল মমিন ঘরের সিঁড়িতে পিছলে পড়ে পা ভাঙায় তাঁকে ভর্তি করা হয়েছিল সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। গতকাল আগুন লাগার পর তাঁকে একটি স্ট্রেচারে করে শিক্ষার্থীরা হাসপাতালের বাইরে বের করে দেয়। এর পর রাতে তাঁকে একটি অ্যাম্বুল্যান্সে ঢাকা মেডিক্যালের দিকে নিয়ে যেতে দেখা যায়। তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী কুলসুম বেগম। তিনি জানান, রোগী নিয়ে তিনি খুব বিপদে পড়েছেন। ছাত্ররা তাঁর স্বামীকে বের করে দিয়েছে। অ্যাম্বুল্যান্সে জায়গা না পাওয়ায় তাঁর স্বামীকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের চত্বরে রাখা হয়েছিল। অ্যাম্বুল্যান্সটি তাঁকে ওঠানোর সময় কুলসুম বেগম জানতে চান কত ভাড়া দিতে হবে। এ সময় শিক্ষার্থী ও অ্যাম্বুল্যান্সের চালক জানান, কোনো টাকা লাগবে না। একই রকম চিত্র দেখা গেছে আরো অনেকের ক্ষেত্রে।

তদন্ত কমিটি : ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. মুরাদ হাসান বলেন, এ ঘটনায় হাসপাতালের পরিচালক উত্তম কুমারের নেতৃত্ব সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের আগামী তিন থেকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

এদিকে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক আলী আহমেদ খান বলেন, অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানতে ফায়ার সার্ভিসের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক অপারেশনকে প্রধান করে ওই কমিটি গঠিত হয়েছে। কমিটিকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

K/K/N.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে