মানবাধিকারের কি দাম আছে? প্রশ্নটি চীনা কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত ট্যাবলয়েড গ্লোবাল টাইমসের। শুক্রবার এক বিশেষ প্রতিবেদনের শুরুতেই এ প্রশ্ন রেখেছে তারা। জবাবও দিয়েছে নিজেরাই- ‘হ্যাঁ! প্রশ্নটি যখন করবে পশ্চিমা ও যুক্তরাষ্ট্র আর তা করা হবে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য।’ প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্কার রাইটস কনসোর্টিয়ামের (ডব্লিউআরসি) বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তুলেছে গ্লোবাল টাইমস। তাদের দাবি, চীনের জিনজিয়াং অঞ্চলে ‘জোরপূর্বক শ্রম’ ইস্যুটি উসকে দেয়ার হুমকি দিয়ে একটি চীনা প্রতিষ্ঠান ও তাদের মার্কিন অংশীদারের কাছ থেকে তিন লাখ ডলার (২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা প্রায়) হাতিয়ে নিয়েছে ডব্লিউআরসি। একই পদ্ধতি অবলম্বন করে মার্কিন সংস্থাটি বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও অর্থ আদায় করেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।

উসকানিমূলক টপিক তৈরি
গ্লোবাল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগ থেকে তারা জানতে পেরেছে, ২০১৮ সালের ১৭ অক্টোবর জিনজিয়াংয়ের হোতান অঞ্চলের একটি পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের আইনবিষয়ক প্রতিনিধির কাছে মার্কিন বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) ও দ্য নিউইয়র্ক টাইমস থেকে ফোনকল আসে। প্রতিষ্ঠানটিতে ‘মার্কিন ব্র্যান্ডের কাপড় তৈরিতে অবৈধ শ্রম ব্যবহৃত হচ্ছে’ এ বিষয়ে ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হয় ওই প্রতিনিধির কাছে।

তিনি অবৈধ শ্রম ব্যবহারের অভিযোগ অস্বীকার করলেও পরে এপির প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, হোতানের ওই প্রতিষ্ঠানটি ‘পুনঃশিক্ষা শিবির’ থেকে লোক ভাড়া করে কাপড় তৈরি করছে। অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউটের (এএসপিআই) সাইবারনীতি গবেষক নাথান রুসারের বক্তব্য উঠে আসে এপির ওই প্রতিবেদনে। এতে স্যাটেলাইটে ধরা পড়া ছবি বিশ্লেষণের কথা জানানো হয়। নাথান দাবি করেন, তিনি হোতানের ওই গার্মেন্টস কারখানা ও চীন সরকার পরিচালিত তথাকথিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মধ্যে বেড়াযুক্ত একটি সংযোগপথ দেখতে পেয়েছেন।

jagonews24

এপির প্রতিবেদনটিতে মার্কিন স্পোর্টসওয়্যার প্রতিষ্ঠান ব্যাজারকেও ‘টার্গেট’ বানানো হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে গ্লোবাল টাইমস। তারা জানিয়েছে, মার্কিন শুল্ক বিভাগের তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সালের এপ্রিলে হোতানের প্রতিষ্ঠানটি থেকে শতভাগ পলিয়েস্টার টি-শার্ট ও প্যান্ট আমদানি শুরু করে ব্যাজার। তাদের শিপিং রেকর্ডসের ঠিকানার সঙ্গে ‘বন্দিশিবিরের’ ঠিকানার মিল পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করে এপি।

মার্কিন বার্তা সংস্থাটির ওই প্রতিবেদন পরে অন্য বিদেশি গণমাধ্যমগুলোতেও প্রকাশিত হয়। গ্লোবাল টাইমসের হিসাবে ‘কাকতালীয়ভাবে’ প্রায় একই সময় ডব্লিউআরসির নির্বাহী পরিচালক স্কট নোভা একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন, যা এপির প্রতিবেদনের সঙ্গে অনেকাংশে মিলে যায়। বিবৃতিতে বলা হয়, পশ্চিম চীনের অভ্যন্তরীণ শিবিরের বন্দিদের দিয়ে পণ্য উৎপাদনের বিষয়ে ব্যাজারের কাছ থেকে আরও তথ্য পাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখবে সংস্থাটি।

গ্লোবাল টাইমসের প্রতিবেদন অনুসারে, ডব্লিউআরসি কোনো প্রমাণ ছাড়াই ইস্যুটি উসকাতে থাকে এবং হোতানের সঙ্গে সম্পর্কিত ঝেজিয়াং প্রদেশের একটি প্রতিষ্ঠানকে চাপ দিতে থাকে যেন কারখানাটির কর্মীদের লিঙ্গ, নাম, পদের নাম, বেতনসহ সব ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করা হয়। ২৪ জুন একটি মূল্যায়নপত্র প্রকাশ করে ডব্লিউআরসি, যাতে বলা হয়, ব্যাজার ও চীনা মানবাধিকার গবেষকদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং মার্কিন শুল্ক বিভাগের রেকর্ড ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িক নথিপত্র পুনর্মূল্যায়নের ভিত্তিতে ওয়ার্কার রাইটস কনসোর্টিয়াম নিশ্চিত হয়েছে যে, ব্যাজার এমন কারখানায় পণ্য উৎপাদন করছে, যেখানে ‘জোরপূর্বক শ্রম’ ব্যবহৃত হচ্ছে।

মূল্যায়নপত্রে ডব্লিউআরসি স্যাটেলাইটের ছবি, অন্য গবেষকদের মতামতের পাশাপাশি একগাদা নথিপত্র পর্যালোচনার কথা বললেও জিনজিয়াংয়ের কোনো শ্রমিকের মন্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি বলে উল্লেখ করে। এটিকে চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলটিতে বিদ্যমান ‘দমনমূলক পরিবেশ’ হিসেবে বর্ণনা করে সংস্থাটি।

jagonews24

গ্লোবাল টাইমসের পক্ষ থেকে হোতানের সেই প্রতিষ্ঠানের আইনবিষয়ক প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটির বাড়তি কোনো সমস্যা এড়াতে তিনি গণমাধ্যমের সামনে মন্তব্য করতে রাজি হননি।

মাঠপর্যায়ে তদন্ত কী বলছে?
ডব্লিউআরসি যে অভিযোগ, চীনের জিনজিয়াংয়ে মাঠপর্যায়ে তদন্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই- সেটি কতটা সত্য? নাকি এটি পূর্বনির্ধারিত উপসংহার টানার কৌশল?

গ্লোবাল টাইমস জানতে পেরেছে, ডব্লিউআরসি ও মার্কিন শুল্ক বিভাগের চাপে ব্যাজার আইনবিষয়ক ফার্ম রোপসঅ্যান্ডগ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে। পরে বৈশ্বিক পেশাদারি সেবাপ্রতিষ্ঠান আলভারেজঅ্যান্ডমার্সালের হংকং শাখার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। হংকং শাখা এরপর সাংহাই শাখাকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়। অভ্যন্তরীণ তদন্তের যোগ্যতা অর্জন ছাড়াই ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সাংহাই শাখা থেকে কর্মীদের জিনজিয়াং ও ঝেজিয়াংয়ে পাঠানো হয়। এপ্রিলের ৭ তারিখ চীনের বাজার পর্যবেক্ষণ ও পরিসংখ্যান বিভাগের কর্মকর্তারা সাংহাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটির ‘অবৈধ তদন্ত’ নিয়ে তদন্ত শুরু করে। এছাড়া স্থানীয় পুলিশও তাদের বিরুদ্ধে জাতীয় নিরাপত্তা হুমকিতে ফেলার সন্দেহে তদন্তে নামে।


গ্লোবাল টাইমসের খবর অনুসারে, তদন্তকালে চীনা পুলিশ জানতে পারে, আলভারেজঅ্যান্ডমার্সালের সাংহাই শাখার কর্মীরা বলেছেন, তারা তদন্তে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো প্রমাণ পাননি। এ ফল যুক্তরাষ্ট্র গ্রহণ না করায় ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন পেশাদারি প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা। জিনজিয়াংয়ে তদন্তে যাওয়া এক মাঠকর্মী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের [জিনজিয়াং নিয়ে] খবর অযৌক্তিক… আমরা যা দেখেছি তা তারা চায় না…স্পষ্টত আমাদের প্রতিবেদন তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেনি… তারা নেতিবাচক কিছু চায়।

jagonews24

গ্লোবাল টাইমস বলছে, আলভারেজঅ্যান্ডমার্সালের সাংহাই অফিস ছাড়াও একই ইস্যুতে তদন্ত করেছে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। সেসব তদন্ত প্রতিবেদন দেখতেই চায়নি ডব্লিউআরসি। ২০১৯ জুড়ে তারা হোতানের প্রতিষ্ঠানটির আইনবিষয়ক প্রতিনিধিকে ক্রমাগত চাপ দিতে থাকে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন ও জোরপূর্বক শ্রমের অভিযোগ তুলে একটি মূল্যায়নপত্র ইস্যু করে। এসবের সঙ্গে জিনজিয়াংয়ের স্থানীয় সরকার জড়িত বলেও আঙুল তোলে মার্কিন প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি চীনা সংশ্লিষ্টতা ছিন্ন করতে ব্যাজারকে চাপ দেয়া এবং পশ্চিমা মিডিয়ায় বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টির হুমকি দিতে থাকে ডব্লিউআরসি।

শান্ত হতে অর্থ আদায়
কেন এমন করছিল ডব্লিউআরসি? কিছুদিন পরই তা পরিষ্কার হয়ে যায়। ‘মুক্তহস্তে দান’ হিসেবে ব্যাজারের কাছে তারা ছয় লাখ ডলার দাবি করে। এরপর স্কট নোভার সঙ্গে কয়েক দফায় আলোচনার পর শেষমেশ তিন লাখ ডলারে সমঝোতা হয়। ব্যবসা ধরে রাখতে এবং বাড়তি ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে ব্যাজারের সঙ্গে এ অর্থ ভাগাভাগি করে দিতে রাজি হয় ঝেজিয়াংয়ের প্রতিষ্ঠানটি।

গ্লোবাল টাইমস বলছে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) নির্ধারিত মানবাধিকার সংস্থায় তিন দফায় এক লাখ ডলার করে দিতে রাজি হয়েছিল ব্যাজার। এর প্রথম দফার অর্থ ২০১৯ সালের নভেম্বরে পরিশোধ করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

jagonews24

চীনা গণমাধ্যমটির দাবি, বাংলাদেশের একটি পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও একই কৌশলে অর্থ আদায় করেছে ওয়ার্কার রাইটস কনসোর্টিয়াম।

মার্কিন সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন বলছে, ব্যাজার জোরপূর্বক শ্রম ব্যবহার না হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করলেও ডব্লিউআরসি প্রস্তাবিত ‘প্রয়োজনীয় পুনরুদ্ধার ব্যবস্থা’য় সম্মত হয়, যার মধ্যে তিন লাখ ডলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২০১৯ সালের ২৫ অক্টোবর ডব্লিউআরসির একটি মিটিংয়ের নথি অনুসারে, সংস্থাটির কৌশলগত গবেষক পেনিলোপ কিরিস্টিস ও নির্বাহী পরিচালক স্কট নোভা ব্যাজারের ‘দান করা’ অর্থ দেয়ার জন্য নির্বাসিত উইঘুরদের চিহ্নিত করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন এইচআরডব্লিউ’কে।

শেষমেশ কোথায় গেল সেই অর্থ?
গ্রেজোন নামে একটি মার্কিন ওয়েবসাইট গত এপ্রিলে এর উত্তর দিয়েছে। তারা জানতে চেয়েছিল, ব্যাজারের দেয়া অর্থ কোন ‘স্বাধীন মানবাধিকার সংস্থা’র হাতে গেছে? এর জবাব দিতে গিয়ে পেনিলোপ কিরিস্টিস তালগোল পাকিয়ে ফেলেন বলে জানিয়েছে গ্লোবাল টাইমস। তার উত্তর ছিল, ‘উমমম, একটি গ্রুপ আছে কাজাখস্তানে।’ তবে সেই গ্রুপের নাম মনে করতে পারেননি ডব্লিউআরসি কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে চায়না ইনস্টিটিউট অব কনটেম্পোরারি ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনসের রিসার্চ ফেলো লি ওয়েই বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠানকে তত্ত্বাবধানের আইনি অধিকার ডব্লিউআরসির নেই। প্রমাণবিহীন অভিযোগ ছড়িয়ে তারা প্রতিষ্ঠানগুলোকে হয়রানি করে এবং ‘অনুদান’ দিতে বাধ্য করে। এটি পরিষ্কার ব্ল্যাকমেইল।

Jag/N

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে