অবাক করা এই তথ্য পাওয়া যায় চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের (ডিএফপি) হিসেবে৷ আর সেই তথ্যটি হলো করোনায় আক্রান্ত এই বছরেও সংবাদপত্রের প্রচার সংখ্যা কমেনি, একই জায়গায় আছে।যদিও বাংলাদেশের সংবাদপত্র মালিক ও সম্পাদকেরা করোনায় পত্রিকার বিক্রি অনেক কমে যাওয়ার কথা বলছেন৷ তারা প্রণোদনাও দাবি করেছেন৷ আর একই কারণে বড় থেকে ছোট বিভিন্ন সংবাদপত্রে সংবাদকর্মী ছাঁটাই করা হয়েছে৷ বেতন বন্ধ আছে কোনো প্রতিষ্ঠানে৷ কোথাও বেতন ঝুলে গেছে৷ আবার কোথাও বেতন কমিয়ে দেয়া হয়েছে৷

ডিএফপি সংবাদপত্রের প্রচার সংখ্যার সর্বশেষ হিসাব প্রকাশ করে গত জুন মাসে৷ যখন বাংলাদেশে করোনার পিক টাইম৷ তার আগের হিসাবটি এই বছরেরই জানুয়ারি মাসে৷ তখন বাংলাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিলো, করোনা হানা দেয়নি৷ কিন্তু দুইটি হিসাবে কোনো পার্থক্য নাই৷ দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র প্রথম আলোর জানুয়ারি মাসে প্রচার সংখ্যা বলা হয়েছে পাঁচ লাখ এক হাজার ৮০০৷ কিন্তু করোনার সময় জুন মাসেও প্রথম আলোর প্রচার সংখ্যা পাঁচ লাখ এক হাজার ৮০০৷ ডিএফপির হিসেবে সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের জানুয়ারি মাসে প্রচার সংখ্যা ছিলো পাঁচ লাখ ৫৩ হাজার ৩০০৷ জুন মাসেও তাদের প্রচার সংখ্যা ঠিক একই ছিলো৷

ডিএফপি ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকার যে প্রচার সংখ্যা প্রকাশ করেছে তাতে শীর্ষে রয়েছে দ্য ডেইলি স্টার৷ জানুয়ারি মাসে তাদের প্রচার সংখ্যা ছিলো ৪৪ হাজার ৮১৪৷ জুন মাসে করোনার সময়ও তাদের প্রচার সংখ্যা একই আছে৷ একটিও কমেনি৷ডিএফপি ঢাকা ও ঢাকার বাইরে মোট ৪৩৫টি বাংলা দৈনিক এবং ৩৪টি ইংরেজি দৈনিকের প্রচার সংখ্যা প্রকাশ করেছে এই বছরের জানুয়ারি ও জুন মাসে৷ তাতে কোনো পত্রিকারই প্রচার সংখ্যা একটিও কমেনি বা বাড়েনি৷ করোনার সময়ও একই আছে৷ এমনকি প্রকাশনা বন্ধ থাকা দৈনিক আমার দেশের প্রচার সংখ্যাও বলা হয়েছে ৯৮ হাজার ৫৮০টি৷ আর ৫০ হাজার থেকে এক লাখ সার্কুলেশনের এমন এমন দৈনিকের নামও তাদের তালিকায় আছে যা পাঠকের কাছে আদৌ পৌঁছায় কিনা সন্দেহ আছে৷

বাস্তব চিত্র 

কলাবাগানের বশিরউদ্দিন রোড এলাকায় দৈনিক পত্রিকা বিক্রি করেন মো. সাজু মিয়া৷ এই করোনায় তিনি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন৷ আগে তিনি ওই এলাকার বাসা ও অফিসে ২৫০টি পত্রিকা দিতেন৷ কিন্তু মার্চ এপ্রিল মাস থেকে গ্রাহক কমে অর্ধেকের নিচে নেমে যায়৷ তিনি জানান, ‘‘আগস্টের পর থেকে আবার অল্প গ্রাহক বেড়েছে৷ তবে তা শতকরা ১০ ভাগেরও কম৷’’ তিনি একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকের নাম উল্লেখ করে বলেন, শুধু ওই পত্রিকাটির চাহিদা ছিলো ১১০ কপি৷ কিন্তু করোনা আসার পর সেটার চাহিদা ৭০ কপিতে নেমে আসে৷

তিনি জানান, করোনায় ভয়ে অনেক বাসায় পত্রিকা রাখা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ আর অফিস বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে সেখানে আর পত্রিকা দেয়া যাচ্ছেনা৷ অনেক অফিস খুললেও তারা এখন আর পত্রিকা নিচ্ছে না৷ সাজু জানান, ‘‘অফিসে তার ২২-২৩ হাজার টাকা বকেয়া পড়ে আছে তুলতে পারছেন না৷ আর কমিশনও আগের চেয়ে কিছুটা কমিয়ে দেয়া হয়েছে৷’’

বাংলাদেশ সংবাদপত্র হকার্স কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতির হিসেবে জুন- জুলাই মাসে করোনার পিক টাইমে বাংলাদেশে সংবাদপত্র বিক্রি স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় শতকরা ২০ ভাগে নেমে এসেছিলো৷ প্রতিষ্ঠানটির উপদেষ্টা এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন আহমেদ জানান, ‘‘সেপ্টেম্বর মাস থেকে গ্রাহক আবার বাড়ছে৷ তবে এখনো তা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ৫০ ভাগে আসেনি৷’’ তিনি জানান স্বাভাবিক সময়ে সারাদেশে সব পত্রিকা মিলে বিক্রি ১০ লাখ কপির বেশি না৷ আর এর অর্ধেক বিক্রি হয় ঢাকা শহরে৷ ঢাকা শহরেই পত্রিকা বিক্রি সবচেয়ে বেশি কমে গেছে৷ কারণ এখানে করোনার কড়াকড়ি বেশি আবার কোনো কোনো এলাকায় পত্রিকার হকার প্রবেশই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷

তিনি জানান, ‘‘এই সময়ে শুধু পত্রিকার বিক্রিই কমেনি অনেক ছোট ছোট পত্রিকা ছাপা বন্ধ হয়ে গেছে৷’’ তবে যে পত্রিকার দাম কম সেগুলো কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানান তিনি৷

ডিএফপির সাথে দ্বিমত 

বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম বলেন, করোনায় বাংলাদেশের সব সংবাদপত্রেরই কম বেশি ক্ষতি হয়েছে৷ বিক্রি কমে গেছে৷ কেউ কেউ হয়ত এই অবস্থা বিছুটা কাটিয়ে উঠেছেন৷ কিন্তু পরিস্থিতি কেনোভাবেই স্বাভাবিক নয়৷ তিনি মনে করেন, ‘‘করোনায় পত্রিকার সার্কুলেশন কোন পর্যায়ে আছে তার একটা বাস্তব চিত্র প্রকাশ হওয়া দরকার৷ এটা সবার জন্যই প্রয়োজন৷ এতে পত্রিকার সক্ষমতা এবং প্রয়োজন হলে সহায়তার বিষয়টি বোঝা যায়৷ কিন্তু ডিএফপি সার্কুলেশনের যে হিসাব প্রকাশ করে তার ওপর আস্থা রাখা যায়না৷’’

নঈম নিজাম বলেন, ‘‘ডিএফপি তার নিজের ইচ্ছেমত প্রচার সংখ্যা বসিয়ে দেয়৷ ৪৩টি প্রথম শ্রেণির দৈনিক তারা বলছে ৷ তাদের প্রথম শ্রেণি হিসেবে সরকারি বিজ্ঞাপন দেয়া হয়৷ এরমধ্যে এমন অনে পত্রিকা আছে যা খুঁজে পাওয়া যায় না৷ পাঠকেরা হয়ত ওই পত্রিকার নামও জানেন না৷ এতে পেশাদার ও বহুল প্রচারিত পত্রিকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷’’তার মতে, পত্রিকার প্রকৃত প্রচার সংখ্যা প্রকাশ করা জরুরি৷ সেটা না করায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে ভালো পত্রিকাগুলো৷

ডিএফপি যা বলছে

ডিএফপি বলছে, করোনার সময় সব পত্রিকারই সার্কুলেশনই কমেছে৷ তার একটা অভ্যন্তরীণ হিসাব তাদের কাছে আছে৷ কিন্তু তারা তা প্রকাশ করেননি এবং করবেনও না৷ কারণ তাতে পত্রিকাগুলো বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্থ হবে৷ ডিএফপির মহাপরিচালক স ম গোলাম কিবরিয়া জানান, ‘‘জুনে যে পত্রিকার সার্কুলেশনের হিসাব দেয়া হয়েছে তা আসলে জানুয়ারি মাসের৷ করোনার সময় বিবেবেচনা করে নতুন হিসাব প্রকাশ করা হয়নি৷ কারণ কয়েক মাস আগে সরকারি বিজ্ঞাপনের নতুন (বাড়তি) রেট কার্যকর হয়েছে৷ আর তা কার্যকর করা হয়েছে গত বছরের নভেম্বর থেকে৷ সে কারণেই জানুয়ারি হিসাবই আমরা জুনেও একই রেখেছি৷’’

তিনি আরো দাবি করেন, ‘‘আমরা পত্রিকাগুলোর প্রতি সদয় হয়েই করোনার সময়ও আগের স্বাভাবিক সময়ের সার্কুলেশন দেখিয়েছি৷ সেটা না করলে অনেক পত্রিকা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে৷ বিজ্ঞাপনের রেট কমে যেতে পারে৷ আমরা সময় দিচ্ছি দেখি তারা পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পারে কিনা৷’’

তবে ডিএফপি সার্কুলেশনের যে হিসাব দেয় তা নিয়ে যে অভিযোগ তা তিনি মানতে নারাজ৷ তার কথা, তারা যে হিসাব দেন তা মোটামুটি ঠিকই আছে৷ একটু হেরফের হতে পারে৷ তিনি দাবি করেন, ‘‘আমাদের সুপারভাইজার আছেন৷ তারা পত্রিকা অফিসে যান, প্রেসে যান, হকার সমিতিতে যান৷ তাদের একটা সিস্টেম আছে ৷ সেই সিস্টেমেই তারা প্রকৃত সার্কুলেশনের হিসাব বের করেন৷’’ তিনি বলেন, বড় পত্রিকাগুলো এনিয়ে বেশি অভিযোগ করে৷ কিন্তু আসলে তাদের অভিযোগ যাচাই করে খুব বেশি হেরফের পাওয়া যায় না! তথ্যসূত্র-ডয়েচে ভেলে।

BSSN

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে