ডেস্ক রিপোর্টঃ সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম  ব্যবহারের লক্ষ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতের ভিত্তিতে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনী প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গতকাল বৃহস্পতিবার ইসির সভায় এ প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয়। এতে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা ভিন্ন মত দিয়ে সভা বর্জন করেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের জন্য একটা প্রেক্ষাপট তৈরি করার লক্ষ্যে আরপিওতে বিষয়টি সংযোজনের প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয়েছে। পরিবেশ অনুকূল থাকলে আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদে এটা ব্যবহার করা যাবে কি না সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আজকের সভায় তেমন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’

আরপিও সংশোধন নিয়ে এর আগে ২৬ আগস্ট কমিশন সভা করলেও সিদ্ধান্ত ছাড়াই তা মুলতবি করা হয়েছিল। সেই মুলতবি সভা শুরু হয় গতকাল সকাল ১১টায়। প্রায় ২০ মিনিটের মাথায় ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়ে সভা বর্জন করেন মাহবুব তালুকদার। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার আপত্তির পরেও যেখানে সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে সিদ্ধান্ত হবে, সেখানে আমার  মূর্তির মতো বসে থাকাটা সমীচীন নয়।’

দুপুর দেড়টায় সভার বিরতির পর ৩টায় আবার শুরু হয়। গতকাল কমিশনের ওই সভায় দুটি প্রধান এজেন্ডা ছিল। এর মধ্যে প্রথমটি ছিল গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২ সংশোধন। অন্যটি ছিল এ বছর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ফেমবোসা সম্মেলনের প্রস্তুতি নিয়ে। সভা শেষে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন সিইসি। ওই সময় উপস্থিত ছিলেন নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম, ব্রি. জে. (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী ও ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ।

সংবাদ সম্মেলনে সিইসি বলেন, ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২-এর ওপর কিছুটা সংশোধনীমূলক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এসব সিদ্ধান্ত জাতীয় সংসদের মাধ্যমে অনুমোদন হওয়া প্রয়োজন। আমাদের প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। আইন মন্ত্রণালয় সম্মত হলে তা সংসদে পাঠানো হবে। আমরা সংসদ নির্বাচনে ইভিএম প্রবর্তনের বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি।’ তিনি আরো বলেন,  সভায় আরপিও সংশোধনের জন্য ১৫টি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এর মধ্যে ৮-১০টি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ইভিএম সংশ্লিষ্ট বিষয় ছাড়া অন্যগুলো উল্লেখযোগ্য নয়।

সিইসি বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হচ্ছে। এটি জাতীয় সংসদেও ব্যবহার করা যায় কি না সে বিষয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা রয়েছে। আমরা নির্বাচনের আগে ইভিএম প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করব।’

সিইসি আগে বলেছিলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের জন্য ইসি প্রস্তুত নয়। এখন হঠাৎ এ বিষয়ে উদ্যোগ নিচ্ছেন কেন জানতে চাইলে সিইসি বলেন, ‘আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হবেই সে রকম সিদ্ধান্ত এখনো নেওয়া হয়নি। তবে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে ভালোভাবে ইভিএম ব্যবহার হচ্ছে। এ অবস্থায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এর প্রেক্ষাপট তৈরির জন্যই আরপিওতে এটা অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’

সিইসি বলেন, ‘এ বিষয়ে একজন কমিশনার দ্বিমত পোষণ করেছেন। আর আমরা বাকি চারজন একমত হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সব ক্ষেত্রে ইভিএম ব্যবহারের সুফল না মেলা সত্ত্বেও তড়িঘড়ি করে কেন সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করতে চাওয়ার কারণ জানতে চাইলে সিইসি বলেন, ‘তড়িঘড়ি করে কিছু করা হচ্ছে না। ২০১০ সাল থেকে ইভিএম ব্যবহার হচ্ছে। মাঝে কিছুদিন বন্ধ ছিল, আবার শুরু হয়েছে। সম্প্রতি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার সম্পর্কে আমাদের অ্যাসেসমেন্ট ভালো।’

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এক-তৃতীয়াংশ আসনে ইভিএম ব্যবহার হবে বলে সম্প্রতি ইসি সচিব যে বক্তব্য দিয়েছেন সে বিষয়ে অভিমত জানতে চাইলে সিইসি বলেন, ‘উনি হবে বলেননি, বলেছেন হতে পারে।’ বিপুল অর্থ দিয়ে ইভিএম কেনার ক্ষেত্রে কোনো কোনো মহলের দুর্নীতির আশঙ্কা সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সিইসি বলেন, ‘এই টাকা আমাদের হাতে থাকবে না। সরকারের কাছ থেকেই ব্যয় হবে।’

এখন কয়টি দেশ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করছে জানতে চাইলে সিইসি বলেন, ‘সংখ্যাটা বলতে পারব না। অনেক দেশ অনেক রকমভাবে এটা ব্যবহার করে।’ অপর দুই প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘তিন শর মতো ইভিএম কেনা হয়েছে স্থানীয়ভাবে। এর সঙ্গে প্রস্তাবিত প্রকল্পের কোনো সম্পর্ক নেই। আর নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের অনুমোদনের মাধ্যমেই এ প্রকল্প প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে।’

পরে মাহাবুব তালুকদার এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘কমিশনের কোন সভায় এই প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হয়েছে বা সিদ্ধান্ত হয়েছে তা আমার জানা নেই।’

নোট অব ডিসেন্ট : মাহাবুব তালুকদার তাঁর নোট অব ডিসেন্টে বলেছেন, ‘বিগত ২৬ আগস্ট আরপিও সংশোধনকল্পে নির্বাচন কমিশনে তিন ধরনের প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। আরপিওটিকে বাংলা ভাষায় রূপান্তর ও পরিমার্জন করে প্রথম প্রস্তাবটি পেশ করা হয়, যা কমিশনের নিয়োজিত একজন পরামর্শক তৈরি করে দেন। দ্বিতীয় অপশনটি হলো, পূর্বের ইংরেজি আরপিওতে সুনির্দিষ্ট কিছু সংশোধন, সংযোজন বা পরিমার্জন। সর্বশেষ প্রস্তাবটি হলো, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সময়স্বল্পতা হেতু ইভিএম ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় সংশোধন আরপিওতে সন্নিবেশ করা। নির্বাচন কমিশনের ২৬ আগস্টের সভায় অন্য দুটি প্রস্তাব বাদ দিয়ে শুধু একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টি আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকে।’ তিনি আরো বলেন, ‘স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে এরই মধ্যে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে রাজনৈতিক দল ও ভোটারদের কাছ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে।

মাননীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রথম থেকেই বলে এসেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো সম্মত হলেই শুধু আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। সরকারি দলের পক্ষ থেকে ইভিএম ব্যবহারকে স্বাগত জানানো হলেও প্রধান বিরোধী দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল এর বিরোধিতা করে আসছে। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দলগতভাবে সংলাপকালে ইভিএম সম্পর্কে সরকারি দল ও প্রধান বিরোধী দলের অবস্থান ছিল পরস্পরবিরোধী। এমতাবস্থায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার ভিত্তিতে ইভিএম ব্যবহারের কোনো সম্ভাবনা নেই। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অধিকতর আলোচনা ও সমঝোতার প্রয়োজন ছিল।’

মাহাবুব তালুকদার বলেন, ‘বর্তমান নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ইভিএম ব্যবহারের প্রারম্ভে বলা হয়েছিল পরীক্ষামূলকভাবে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে। ওই পরীক্ষামূলক ব্যবহারের জন্য দুই হাজার ৫৩৫টি ইভিএম ক্রয়ের নিমিত্ত ৫০ কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দের ব্যাপারে আমি গত ৮ এপ্রিল তারিখে ভিন্ন মত প্রকাশ করেছিলাম। সম্প্রতি ইভিএমের জন্য যে প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে তাতে ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ৮২১ কোটি টাকা। রাজনৈতিক দলের বিরোধিতার মুখে আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার যেখানে অনিশ্চিত, সেখানে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে ইভিএম ক্রয় করা কতটা যৌক্তিক, তা বিবেচনাযোগ্য। এতে সরকারি অর্থের অপচয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।

বিগত রকিবউদ্দীন কমিশন ইভিএম ব্যবহার বাতিল করে অনেক ইভিএম ধ্বংস করে দেয়। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি কখনই কাম্য নয়। যে ইভিএম বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি থেকে সরকারি সংস্থার সুবাদে বিনা টেন্ডারে ক্রয় করা হচ্ছে, এর অরিজিন কী, কে উদ্ভাবন করেছে কিংবা কোত্থেকে আমদানি করা হচ্ছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। কারিগরি দিক থেকে এটি সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত কি না তা আরো পরীক্ষা করার প্রয়োজন ছিল। প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে প্রেরণ করার পর অদ্যাবধি প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি বলে জানা যায়।’

মাহাবুব তালুকদার আরো বলেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের জন্য অতি অল্প সময়ের মধ্যে আরপিও সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আরপিওতে শুধু ইভিএম ব্যবহারের জন্য যে সংশোধনটি আনা হয়েছে, তা ইতিমধ্যে কমিশন সভায় নানা প্রকার প্রশ্নের সম্মুখীন। আমি ধারণা করি, সর্বসম্মত রাজনৈতিক মতের বিরুদ্ধে ইভিএম ব্যবহৃত হলে তা নিয়ে আদালতে অনেক মামলার সূত্রপাত হবে। অন্যান্য কারণ ব্যতিরেকে কেবল ইভিএম ব্যবহারের কারণেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের পক্ষে এই অনাবশ্যক ঝুঁকি নেওয়া সংগত হবে না।’

মাহাবুব তালুকদার বলেন, ‘ইভিএম ব্যবহারের জন্য নির্বাচন কমিশন যাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, তাদের প্রশিক্ষণ অপর্যাপ্ত এবং জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান সম্পর্কে আমি সন্দিহান। দ্বিতীয়ত, অনেক ভোটার অজ্ঞতাপ্রসূত কারণে ইভিএম ব্যবহার সম্পর্কে অনীহা প্রকাশ করেছেন। তাঁরা ইভিএমের বিষয়ে যে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, তা নিরসনের জন্য ব্যাপক প্রচার ও ভোটারদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ছিল। বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম নিয়ে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটেছে, যা ছিল নিতান্তই অনভিপ্রেত।

সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কেন্দ্র দখল করে ইভিএমে একটি দলের পক্ষে ভোট প্রদানের অভিযোগও রয়েছে। তবে আমি মনে করি, স্থানীয় নির্বাচনগুলোয় ধীরে ধীরে ইভিএমের ব্যবহার বাড়ানো হলে ভোটাররা তাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়বেন। এই অভ্যস্ততার জন্য যে সময়ের প্রয়োজন তা একাদশ জাতীয় সংসদের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। তবে স্থানীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবস্থা সাফল্য লাভ করলে পাঁচ-সাত বছর পরে ব্যবহারের বিষয়ে কমিশনের সিদ্ধান্তে ভিন্নমত পোষণ করে নোট অব ডিসেন্ট প্রদান করছি।’

সিইসির সংবাদ সম্মেলনের পর মাহাবুব তালুকদার নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের কাছে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে তাঁর আপত্তির কারণগুলো ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, ‘আমি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে নই। কিন্তু আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে প্রস্তুতি থাকা দরকার তা আমাদের নেই। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যেভাবে ইভিএম ব্যবহার হচ্ছে তাতে আগামী পাঁচ-সাত বছরে হয়তো সংসদ নির্বাচনে ইভিএম অনিবার্য হয়ে উঠবে।’

K/K/N.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে