fol_chas

বিডি নীয়ালা নিউজ(২৭ই মার্চ১৬)-কৃষি ও প্রযুক্তি প্রতিবেদনঃ দানাশস্য ও সবজি উৎপাদনে অভাবনীয় সফলতার পর ফল উৎপাদনে বাংলাদেশের বিস্ময়কর অগ্রগতি বিশ্বের কৃষি প্রধান দেশগুলোর জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফল মানুষের প্রিয় খাদ্য। খাদ্য শস্যের মধ্যে ফল বেশি পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ রয়েছে। ফল আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং বুদ্ধি-বৃত্তি বিকাশে সহায়তা করে। এছাড়া অধিকাংশ ফলের রয়েছে বিরল ওষুধী গুণ।
বিগত কয়েক বছর যাবত ধান, পাট, আখ ও গম চাষে তেমন লাভবান না হওয়ায় এবং কৃষি শ্রমিকের স্বল্পতার কারণে কৃষক ঝুকছেন ফল চাষের দিকে। দানাশস্য ও শাক-সবজির তুলনায় ফল চাষ অধিক লাভজনক। ফল চাষের আর একটি সুবিধা হলো- আম, লিচু, পেয়ারা,কাঁঠাল, নারিকেল প্রভৃতি গাছের চারা একবার রোপণ করে ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছর পর্যন্ত তা থেকে ফল পাওয়া যায়। এছাড়া বাজারে অন্য ফসলের চেয়ে ফলের চাহিদা ও দাম বেশি।
বাংলাদেশের ফল উৎপাদনকারীদের জন্য একটি সুসংবাদ হলো- জাতি সংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে ফলের উৎপাদন বেড়েছে ১১ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ফলন বেড়েছে হেক্টর প্রতি ১০ শতাংশ। আর অন্য একটি সুসংবাদ হলো চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের সবচেয়ে খুচরা পণ্য বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্ট ৩৫ মেট্রিক টন আম আমদানি করেছে। এতোদিন বাংলাদেশের আমের ক্রেতা ছিল বিদেশে বসবাসকারী বাংলাদেশী , ভারতীয় ও পাকিস্তানী প্রবাসীরা। এখন বাংলাদেশের আম যুক্তরাজ্যের সুপার মার্কেটে স্থান পেয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে দেশের জন্য একটা গৌরবের বিষয়। ওয়ালমার্টের দেখাদেখি যুক্তরাজ্যের আরও কয়েকটি খুচরা পণ্য বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান গত বছর আমের মৌসুমে বাংলাদেশ থেকে ৬৫ মেট্রিক টন আম আমদানি করে।এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের ফ্রান্স, বেলজিয়াম, স্পেন ও নেদারল্যান্ডের বিভিন্ন খুচরা পণ্য বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে আম আমদানির জন্য যোগাযোগ শুরু করেছে। বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের আম রপ্তানির কিছু সুবিধা রয়েছে।এসব সুবিধার মধ্যে রয়েছে, এক. বাংলাদেশের আম অন্যান্য রপ্তানীকারক দেশের তুলনায় আগে পাকে ও বাজারে আসে।দুই.অন্য দেশের তুলনায় এ আম অধিক সুস্বাদু। আশার কথা বাংলাদেশ যদি আন্তর্জাতিক বাজারে আমের মান অক্ষুণ রাখতে সক্ষম হয় , তবে এদেশ থেকে অচিরেই প্রচুর পরিমাণ আম বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, গত চার বছরে বাংলাদেশে আম, কাঁঠার, লিচু, কলা, পেয়ারা ও আনারসসহ অন্যান্য দেশি ফলের উৎপাদন দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বিশেষ করে রংপুর ,দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ,পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর ,পাবনা, রাজশাহী, চাঁপাই নবাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গাও কুষ্টিয়া জেলায় গেলেই দেখা যায় মাঠের পর মাঠ জুড়ে গড়ে উঠছে পরিকল্পিত ফলের বাগান। এক সময় এসব উঁচু জমিতে আউস ধান ও আখ ছাড়া অন্য কোনো ফসলের চাষ হতো না।
দ্রুত নগরায়ন, মানুষের আয় বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সচেতনতা এবং খাদ্যাভাস পরিবর্তনের ফলে দেশে বাড়ছে ফলের চাহিদা। বাংলাদেশে বর্তমানে ১৮ প্রজাতির ফল বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে। এ ছাড়া স্ট্রবেরি, রাম্বুটান, প্যাশান ও ড্রাগন ফলের মতো কিছু বিদেশি ফলও চাষ করছেন কিছু সৌখিন ফল চাষি। দেশে গত চার বছরে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন বেড়েছে পেয়ারার। নব্বইয়ের দশকে কাজী পেয়ারা চাষের মাধ্যমে দেশে উন্নত জাতের পেয়ারার চাষের যাত্রা শুরু হয় ।তারপর বারি পেয়ারা-২ নামের একটি উন্নত জাত থাই পেয়ারা নামে সারা দেশে ব্যাপকভাবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ হচ্ছে। এই পেয়ারার একটি সুবিধা হলো- অমৌসুমেও এই জাতের গাছ থেকে প্রচুর ফল পাওয়া যায় ,ফল অধিক মিষ্টি , কচকচে ও সুস্বাদু। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে এই পেয়ারার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এবং প্রতি কেজি পেয়ারা স্থান ভেদে ৮০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হয়। রাজশাহী, নাটোর, পাবনা , জয়পুর হাট জেলায় এই জাতের পেয়ারার ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে এবং অনেক কৃষক এই পেয়ারা চাষ করে স্বল্প সময়ে তাঁদের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছেন।বিবিএসের হিসেবে ২০১৪-১৫ সালে পেয়ারার উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় আড়াই লাখ টনে। বিবিএসের আর এক হিসেবে জানান যায়, ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে দেশে প্রায় ২ লাখ টন লিচু, ৪ লাখ ৭০ হাজার টন পেঁপে, ৪০ হাজার টন কমলা, ৩ লাখ ৭০ হাজার টন আনারস এবং ১লাখ ৫৫ হাজার টন কুল উৎপাদিত হয়েছে।আর মোট ফল উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ১ কোটি মেট্রিক টন, যা কয়েক বছর আগেও ছিল ৫০ থেকে ৬০ লাখ টনের মতো।বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, ২০১০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়ে প্রতি বছর ফল উৎপাদন বেড়েছে ৩ থেকে ৪ শতাংশ হারে। আম, পেয়ারা ও কুলের বেশ কয়েকটি নতুন জাত উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ব বিদ্যালয়ের জার্ম প্লাজম সেন্টার। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্র্তক উদ্ভাবিত বারিআম-৩( আম্রপালি) বাংলাদেশে আম উৎপাদনে এক নীরব বিপ্লবের সৃষ্টি করেছে।আগে আমের চাষ শুধু উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে আম চাষের আধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নত জাত উদ্ভাবনের ফলে আম চাষ সিলেট, মৌলভী বাজার, ময়মনসিংহ ও মধুপুরের লালমাটি অঞ্চল থেকে পাবর্ত জেলার পাহাড়ী এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। কৃষি বিজ্ঞানী ও ফল চাষিদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে বাংলাদেশ আম উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে উঠে এসেছে। ২০১৩ সালে ফল উৎপাদনের দিক থেকে চীন, ভারত, যুক্তরাজ্যও ব্রাজিল ছিল শীর্ষ স্থানে । আর মোট ফল উৎপাদনে বিশ্বের ২৮তম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে দেশে আম উৎপাদিত হয় ১২ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন এবং এ বছর আম উৎপাদন ১৫ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে।
অপর দিকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মপ্লাজম কেন্দ্রে উদ্ভাবিত বাউ কুল -১, বাউ কুল-২ ও বাউ কুল-৩ শুধু সারা দেশে নয় , আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারতেও বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। শীত কালে দেশের ফলের চাহিদা পূরণে বাউকুল এক বিরাট ভূমিকা পালন করছে।
বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া ফল চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। আমাদের ফল চাষ উপযোগী রয়েছে প্রায় ২ কোটি বসত বাড়ির উঁচু জমি। এসব বসতবাড়িতে পরিকল্পিতভাবে ফল চাষের মাধ্যমে আমারা দেশের ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ করেও বিদেশে ফল রপ্তানি করে উপর্জন করতে পারি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা।এ ছাড়া উন্নত পদ্ধতিতে ফল চাষের মাধ্যমে আমরা গ্রামীণ মানুষের আয় বৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারি। বসত বাড়ি ছাড়াও গ্রামীণ রাস্তা, বন্যানিয়ন্ত্রন বাঁধ, স্কুল-কলেজ, অফিস আদালতের অব্যবহৃত জায়গা ও রেললাইনের দুই ধারে এবং নগরের বিল্ডিং এর ছাদে দেশি জাতের ফল গাছ রোপণ করে দেশে ফলের উৎপাদন বাড়াতে পারি। উৎপাদিত ফলের উপর ভিত্তি করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ফল প্রক্রিয়াকরণ শিল্প কারখানা গড়ে তোলারও রয়েছে অফুরন্ত সম্ভাবনা । ফল চাষকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার নার্সারী । এসব নার্সারী থেকে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার চারা ও কলম বিক্রি হচ্ছে , যা গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশে রাখছে উল্লেখযোগ্য অবদান। তা ছাড়া পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও জৈব বৈচিত্র রক্ষায় ফল গাছের ভূমিকা কোনো অবস্থাতেই খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।

লেখকঃ- নিতাই চন্দ্র রায়

সূত্রঃ কৃষিবার্তা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে