ডেস্ক রিপোর্টঃ ঢাকার ধানমণ্ডির সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় পুলিশের ওপর বোমা হামলা হয় গত শনিবার রাত সোয়া ৯টার দিকে। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জঙ্গিগোষ্ঠীর অনলাইন তৎপরতা নজরদারির যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ এক টুইট বার্তায় জানায়, আইএস ওই হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করেছে।

সাইট ইন্টেলিজেন্সের ওয়েবসাইটে এসংক্রান্ত একটি বিবৃতিও রয়েছে। কিন্তু তা শুধু সাইটের নিবন্ধিত গ্রাহকের জন্যই উন্মুক্ত। সাইট ইন্টেলিজেন্স এর আগেও বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলাসহ বিভিন্ন হামলার তথ্যের পাশাপাশি আইএসের দায় স্বীকারের তথ্য প্রচার করেছে। বরাবরের মতো এবারও আইএসের দায় স্বীকার সম্পর্কিত আরবি ভাষায় বার্তার ছবি সাইট ইন্টেলিজেন্সের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। এবারের বার্তাটি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়—‘আল্লাহর ইচ্ছায় খেলাফত প্রতিষ্ঠার সৈনিকরা রাজধানী ঢাকায় (যাদের অনেকে মুরতাদ হয়ে গেছে) হামলা চালাতে সক্ষম হয়েছে। তবে এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। আমরা আল্লাহর কাছে প্রত্যাশা করি, অতি দ্রুত তারা যেন ধ্বংস হয়ে যায়।’

মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়ার (আইএসআইএস) অস্তিত্ব এ দেশে না থাকলেও তাদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়া বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর তৎপরতা বিভিন্ন সময় ধরা পড়েছে। তবে তাদের সঙ্গে আইএসের সরাসরি যোগাযোগের সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

আইএসের মতো গোষ্ঠী বাংলা ভাষায়ও পোর্টাল খুলে প্রচারণা চালায় বলে বিভিন্ন সময় পশ্চিমা গণমাধ্যম প্রচার করেছে। এর পরও সাইট ইন্টেলিজেন্সে দায় স্বীকারের বার্তাগুলো কেন সব সময় আরবি ভাষায় প্রকাশ করা হয় তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। একইভাবে কথিত ওই হামলাকারীদের সঙ্গে সাইট ইন্টেলিজেন্সের কী সম্পর্ক আর কিভাবেই বা তারা এত দ্রুত খবর পেয়ে যায় এ নিয়েও প্রশ্ন আছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আইএসের দায় স্বীকারের তথ্য যে সাইট ইন্টেলিজেন্স উদ্দেশ্যমূলকভাবে বলে এটি বহুবার ও বহু আগেই প্রমাণিত হয়েছে। সাইট ইন্টেলিজেন্সের কথার ওপর ভিত্তি করে কোনোভাবেই বলা যাবে না যে আইএস ওই হামলা চালিয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, আইএসের মতো গোষ্ঠী ‘পটকা ফোটাবে’—এটা তো হাস্যকর বিষয়। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে হলি আর্টিজানে হামলার আগে নাটোরের মুদি দোকানি সুনীল গোমেজ হত্যার পরও বলা হয়েছিল সেটি নাকি আইএস করেছে।

আইএসের ধ্বংসাত্মক তৎপরতা আরো অনেক বিস্তৃত—এমনটি ইঙ্গিত করে মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, আইএসের কর্মকাণ্ড ও হামলার লক্ষ্যবস্তু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তারা এমন লক্ষ্য কখনো ঠিক করে না। সুতরাং সাইট ইন্টেলিজেন্সের দায় স্বীকারের প্রচারণা প্রশ্নবিদ্ধ।

তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহ্মুদ গতকাল রবিবার ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলাদেশে আইএস বলতে কিছু নেই। গাড়ির চাকা বার্স্ট হলেও বলে আইএস করেছে। আবার ককটেল বিস্ফোরণ হলেও বলে আইএস করেছে। কারা যে এগুলো ছড়ায় আমরা জানি না।’

তবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আইএস আছে কি না বা আইএসের নাম ব্যবহার করে প্রচার চালানো হচ্ছে কি না খতিয়ে দেখা দরকার। তিনি বলেন, বাংলাদেশে জঙ্গি আছে। তারা দুর্বল হয়েছে। নির্মূল হয়েছে—এ কথা সরকার বলেনি। আর জঙ্গিবাদ শুধু বাংলাদেশ নয়, বৈশ্বিক সমস্যা।

গোয়েন্দারা সায়েন্স ল্যাবের ওই হামলাকে রিমোট কন্ট্রোল নিয়ন্ত্রিত হামলা বলছেন—এ কথা উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, এটি বড় কোনো হামলার ‘টেস্ট কেস’ হতে পারে।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় এ দেশে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র এ দেশে জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় সহযোগিতা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, গত ১৪ আগস্ট ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশকে জঙ্গি-সন্ত্রাস দমনে নতুন করে সহযোগিতার প্রস্তাব দেন। এ দেশে জঙ্গি-সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে আছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল।

জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে শুধু জঙ্গি-সন্ত্রাস দমনে সহযোগিতাই নয়, সামরিক বা প্রতিরক্ষা সহযোগিতা দিতেও অতি আগ্রহ দেখাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদ দমন ও সহিংস জঙ্গিবাদ মোকাবেলাবিষয়ক ব্যুরোর আঞ্চলিক ও বহুপক্ষীয়বিষয়ক উপসমন্বয়কারী জন টি গডফ্রে গত মাসে বাংলাদেশ সফরকালে নির্বাচিত কিছু গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, বাংলাদেশের দিকে আইএস ও অন্যান্য জঙ্গিগোষ্ঠীর আগ্রহ আছে।

অথচ এই আইএসের উত্থানের নেপথ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার কথা মার্কিন নেতারাই আগে বিভিন্ন সময়ে স্বীকার করেছেন। একইভাবে আইএস ইরাক ও সিরিয়ায় তৎপরতা চালানোর সময় কারা তাদের অস্ত্রশস্ত্র দিয়েছিল তা নিয়েও নানা প্রশ্ন আছে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালের ১১ আগস্ট নির্বাচনী প্রচারকালে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট ওবামাই আইএস সৃষ্টি করেছেন। আর এর সহস্রষ্টা ওবামা সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন।

টাইম ম্যাগাজিনের অনলাইনে সেদিন প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে এককভাবে ওবামা ও হিলারিকে আইএস সৃষ্টির জন্য দায়ী করা বক্তব্যকে ‘রাজনৈতিক’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে আইএস সৃষ্টির জন্য দায়ী করা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রকেই। ‘প্রেসিডেন্ট ওবামা আইএসের স্রষ্টা নন। সত্যিই যিনি শুরু করেছিলেন তিনি এখানেই আছেন’ শীর্ষক ওই বিশ্লেষণে বলা হয়েছিল, জাতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলেছেন, ২০১১ সালে ইরাক থেকে যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে আসার ফলে ওই দেশটি পুরোপুরি অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল। আর এমন প্রেক্ষাপটে সেখানে সৃষ্ট পরিবেশ আইএসের বিস্তৃতি ও বিকাশে সহযোগিতা করেছে। তবে অনেক বিশ্লেষক বলেন, সত্যিকারের ভুলটি করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ। স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই তিনি ইরাক আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি সভার একটি কমিটির শুনানিতে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন স্বীকার করেছিলেন, ভূরাজনৈতিক স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রই আল-কায়েদা সৃষ্টিতে অর্থায়ন করেছিল।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, যুক্তরাষ্ট্র যখনই কোনো দেশে নিরাপত্তা ও সামরিক খাতে সহযোগিতা দিতে অতি আগ্রহ দেখায় তখনই তাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা হয়। এর যথেষ্ট কারণও আছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন আইএসের সম্ভাব্য উত্থান ঠেকাতে বাংলাদেশকে সহযোগিতা দেওয়ার কথা বলছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রেই আইএসের অস্তিত্ব রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের উগ্রবাদ পর্যবেক্ষণ কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালের মার্চ থেকে গত জুলাই মাস পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে অন্তত ১৯১ জনকে আইএসসম্পৃক্ততার অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়াসহ ২৮টি অঙ্গরাজ্যে আইএসের অস্তিত্ব ধরা পড়েছে।

K/K/N

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে